#কলকাতা: অতিমারির দাপটে গোটা বিশ্বেই যেন একটা অনিশ্চয়তার ছায়া তৈরি হয়েছিল। ২০২০ সালে যখন প্রথম করোনাভাইরাস হানা দেয়, তখন থেকেই লকডাউন, আর্থিক অনিশ্চয়তা, চাকরির ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা – এই সব নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে যদিও করোনার দাপট অনেকটাই কম। মানুষও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে শুরু করছে।
কিন্তু অতিমারির দাপটে যা যা ক্ষতি হয়েছে, তার প্রভাব কিন্তু এখনও অবধি কাটানো যায়নি। বরং বলা যায় যে, এই প্রভাব বেশ দীর্ঘস্থায়ীই হতে চলেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা আর্থিক ক্ষেত্রের পাঁচটি আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করব, যা সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্তও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু যা পরবর্তী কালে পুরোপুরি ভাবে ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। শুনে নেওয়া যাক, বিশেষজ্ঞদের মতামত।
ফার্মা স্টকই বিনিয়োগের সেরা মাধ্যম:
এটা বোঝা খুবই সহজ, কারণ অতিমারীর সময়ে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির কদর কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ ফার্মা স্টককেই বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছিলেন। এমনকী ২০২০-২১ সালের মধ্যে ফার্মা স্টক ভালই লাভের মুখ দেখিয়েছিল। আবার কিছু ভিন্ন ভিন্ন স্টক মাল্টিব্যাগারেও পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এই উর্ধ্বগতি বেশি দিন স্থায়ী থাকেনি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র নয় মাসের এই ব্যবধানে বিএসই হেলথকেয়ার ইনডেক্স-এ ২০ শতাংশেরও বেশি পতন হয়েছে। বিশেষ করে ডায়াগনস্টিক স্টকগুলিই বেশি পরিমাণে মার খেয়েছে। যে-সব ফার্মা কোম্পানি এই অতিমারীর সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছে, তারাই শেয়ারহোল্ডারদের ভাল লাভের মুখ দেখাতে পারবে বলে আশা বিশেষজ্ঞদের। আসলে এটা সত্যি যে, সেক্টর হিসেবে ফার্মা কখনওই সেরা বিনিয়োগের মাধ্যম নয়। তবে কিছু বাছাই করা ফার্মা স্টক সত্যিই ভাল ফল করবে।
টেক স্টক সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাবে:
যদিও এটা সঠিক হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে, তবে তা কিছু সময়ের জন্য মাত্র। যার অর্থ হচ্ছে টেক স্টক একটা সময় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রায় কুড়ি মাস ধরে বেশ কয়েক বার US NASDAQ সূচকে উর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছে। যার ফলে কিছু কিছু টেক স্টকের মূল্য রেকর্ড সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। ভারতে আবার আইটি সেক্টরের ক্ষেত্রেও উর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছিল।
কারণ ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জেরে খরচ কমেছিল এবং সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি জুড়ে উচ্চ পরিমাণ রাজস্ব এসেছিল। তবে পরিস্থিতিতে খুব শীঘ্রই বদল আসে। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে খবরের শিরোনাম দেখলেই। বিশ্বব্যাপী সঙ্কট ও মন্দার আশঙ্কার জেরে আমাদের দেশের সবথেকে শক্তিশালী সেক্টর অর্থাৎ আইটি সেক্টর বেশ চাপেই রয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আরও ভাল সুযোগের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে বহু সংখ্যক কর্মী। এর জেরেও ভারতীয় আইটি স্টক বেশ সমস্যার সম্মুখীন রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এখানেই আশাহত হওয়ার কিছু নেই। কারণ মন্দা যদি তীব্র আকার ধারণ না-করে আর কর্মীদের কাজ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যদি কোম্পানি আয়ত্তের মধ্যে এনে ফেলতে পারে, তা-হলেই আবার টেক স্টক ভাল লাভ করতে পারবে।
আইপিও-তে লাভের দিকটা লিস্টিং করা একটা নিশ্চিত বিষয়:
জোম্যাটো, নাইকা-র মতো নতুন ধারার টেক স্টক আইপিও-র বাজারে আসার পরেই লাভ লিস্টিং করাটা অত্যন্ত বেশি পরিমাণে হতে থাকে। এমনকী গত বছরের গোটাটাই ছিল আইপিও বাজারের জন্য সেরা। অনেকেই স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করার কথা ভাবলেই আইপিও-কে সবথেকে বেশি গুরুত্বই দিতেন।
তাঁরা কিন্তু ভুল ছিলেন না, বিশেষ করে প্রাথমিক দিকে তো বটেই। ফলে আইপিও-র জন্য ২০২১ সালটা ছিল এক ঐতিহাসিক বছর। ওই বছরেই ৬৩টি সংস্থা আইপিও এনেছিল। যা ভারতীয় বাজার থেকে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রা তুলেছিল। আর মাত্র এক বছরে এটাই সবথেকে বেশি অর্জিত টাকা।
সকলেই হয়তো ভেবেছিলেন যে, আইপিও মার্কেট একই গতিতে চলতি বছরেও দারুন ফল করবে। এমনকী এলআইসি-র মতো মেগা আইপিও ছিল। কিন্তু আদতে কী ঘটল? আসলে কোম্পানিগুলিও সাবধান হয়েছে। ফলে গত বারের মতো তেমন উৎসাহ নিয়ে আর বাজারে আইপিও আনছে না। আইপিও মার্কেট কি আবার পুনরুজ্জীবিত হবে? বিশেষজ্ঞদের দাবি, কিছু আশার আলো রয়েছে কারণ কিছু কোম্পানি ফের প্রাইমারি মার্কেটে আসছে। এই সব কোম্পানির মধ্যে অন্যতম হল – সুলা ভাইনইয়ার্ডস ও ল্যান্ডমার্ক কারস।
ট্রাভেল এবং হসপিটালিটি সেক্টর মৃতপ্রায়:
এই ধারণাটা সব থেকে বড় ভুল। বহু বিনিয়োগকারীই নিজের হোটেল, এয়ারলাইন এবং ট্রাভেল স্টক বিক্রি করে দিয়েছেন, আর তা পরে কেনেননি। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের আফসোসের শেষ নেই। এই সেক্টরগুলি শেষ হয়ে যায়নি, বরং তা আবার ফুলেফেঁপে উঠছে। যেহেতু মানুষ প্রায় দুই বছর বাড়িতে বন্দি ছিল, ফলে এখন অবসর পেলেই বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ছে তারা।
গোটা বিশ্ব জুড়েই রয়েছে এই ট্রেন্ড। অথচ অতিমারীর সময় এই বিষয়টা কেউ ভাবেনইনি। আর হসপিটালিটি সেক্টরের ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঠিক একই রকম। আর এটাই বিনিয়োগকারীদের একটা শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে।
গোটা বিশ্বই হয় তো আর এই অতিমারীর দাপট কাটিয়ে উঠতে পারবে না:
সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, সব কিছু আবার স্বাভাবিক হচ্ছে। গোটা বিশ্বই এই দাপট ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। আর্থিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বিপত্তির মতো ঘটনা ঘটবেই। আর তা ঘটলেও সেই পরিস্থিতি কাটানোও যাবে। আসলে দিনের শেষে সকলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। আসলে ২০২০ সালের আগে বা করোনা পূর্ববর্তী সময়ে আমরা যেমন জীবনযাপন করতাম, সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি।
অতিমারি সব কিছু বদলে দিলেও এটা মানুষের ব্যবহার পরিবর্তন করতে পারেনি। ফলে মানুষের বিনিয়োগের অভ্যেসটাও বদলে যায়নি। আর তা বদলাবেও না। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, যাঁরা আজকের দিনে স্টক কিনতে চাইছেন, তাঁদের এটা জেনে রাখা উচিত যে, কোম্পানির মৌলিক বিষয় এবং স্টকের দাম কিন্তু করোনা পূর্ববর্তী ও করোনা পরবর্তী সময়ের জন্য একই থাকবে।