ছাদে স্নাইপার, পাশে SPG, প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষায় দুর্ভেদ্য বলয়

ছাদে স্নাইপার, পাশে SPG, প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষায় দুর্ভেদ্য বলয়

বেঙ্গালুরু: স্বামী বিবেকানন্দের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২৬তম জাতীয় যুব উৎসবের সূচনা করতে গিয়েছিলেন। গাড়ির দরজা খুলে, পাদানিতে দাঁড়িয়ে পথসভা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর সেখানেই ঘটল বিপত্তি। কর্নাটকের হুবলিতে নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে মোদির কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন এক যুবক। মালা হাতে ছুটে আসা ওই যুবকের হাত থেকে মালা নিয়ে নেন মোদি। কোনও রকমে তড়িঘড়ি ওই যুবককে সরিয়ে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিন্তু এই ঘটনায় আরও একবার প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল (PM Modi Security Breach)।

কর্নাটকের হুবলিতে নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে মোদির কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন এক যুবক

আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ছায়াসঙ্গী হিসেবে যেমন থাকে সিক্রেট সার্ভিস, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও কম ধোপদুরস্ত নয়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ (SPG)-র হাতে থাকে। দেশ-বিদেশে যেখানেই প্রধানমন্ত্রী যান না কেন, সেখানে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবকিছু তদারকি করে এই এসপিজি। একই সঙ্গে, দেশের অন্দরে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকে। ফলে শুধু একস্তরীয় নয়, বেশ কয়েক স্তরের নিরাপত্তায় ঘেরা থাকেন প্রধানমন্ত্রী (PM’s Security Details)।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার যাবতীয় দায়দায়িত্ব, পরিকল্পনা এসপিজি-র হাতেই ন্যস্ত থাকে। সেই সংক্রান্ত নির্দেশাবলী সম্বলিত একটি ‘ব্লু বুক’ও রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। কোনও রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর সফর থাকলে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় এসপিজি-র। তাতে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর আধিকারিকরাও উপস্থিত থাকেন। কোথায় নামবেন প্রধানমন্ত্রী, কোন পথ ধরে এগোবে তাঁর কনভয়, কোথায় সভা, তার বিশদ নকশা প্রথমে ছকে নেওয়া হয়। সেই নিয়ে তৈরি হয় অ্যাডভান্স সিকিওরিটি লায়াসন (ASL), অর্থাৎ আগাম রিপোর্ট। তার পর প্রধানমন্ত্রীর সফরের তিন দিন আগে থেকে শুরু হয় মাছি গলতে না পারে এমন নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার কাজ।

প্রত্যেক সেকেন্ডে, প্রত্যেক মিনিটে, প্রধানমন্ত্রী কখন কী করবেন, কোথায় থাকবেন, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। জরুরি পরিস্থিতি দেখা দিলে যাত্রাপথ থেকে সভা, কোথায় কী সম্ভাব্য রদবদল করতে হবে, তা-ও ঠিক করে নেওয়া হয় সেই সময়ই। প্রধানমন্ত্রীর সভাস্থলের প্রবেশ পথ, বাহির পথে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হয়। যে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করার কথা থাকে প্রধানমন্ত্রীর,  তার ভারক্ষমতা, কাঠামোও সরেজমিনে দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরের দিন আবহাওয়া অনুকুল থাকবে নাকি প্রতিকূল, তাও জেনে রাখা হয়। জলপথে কোথাও যাওয়ার থাকলে, যে নৌকায় চাপার কথা প্রধানমন্ত্রীর, তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সার্টিফিকেটও দিতে হয় এসপিজি-কে। ঘন জঙ্গল রয়েছে এমন জায়গায় যাওয়ার থাকলে, আগে থেকে গাছপালা নিরাপদ উচ্চতা পর্যন্ত ছেঁটে ফেলা হয়।  কোনও কোনও ক্ষেত্রে কেটে ফেলতে হয় গাছই। যাত্রাপথে বাঁক থাকলে, ঝোপঝাড় থাকলে আগে থেকে তার আলাদা রেখচিত্র তৈরি করে, ওই বিশেষ জায়গায় অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কোথাও কোনও ঝুঁকি রয়েছে কিনা, তা জানাতে হয় গোয়েন্দাদের। প্রধানমন্ত্রীর সফল বানচালের কোনও ইঙ্গিত পেলে, তা জানাতে হয় আগাম। প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাপথে, নিরাপদ দূরত্বে, আশপাশের বাড়ি বা বিল্ডিংয়ের ছাদে মোতায়েন থাকে স্নাইপারও, বেগতিক দেখলে যাতে নির্ভুল লক্ষ্যে গুলি চালানো যায়। কোথাও প্রধানমন্ত্রীর রাত্রিবাস বা বিশ্রামের কথা থাকলে, সেখানে রাজ্য পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদমর্যাদার আধিকারিক ক্যম্প কমান্ডান্ট হিসেবে মোতায়েন থাকেন। এ ছাড়াও এসপি পদমর্যাদার আধিকারিকরা প্রধানমন্ত্রীর পথসভা, জনসভা এবং যাত্রাপথে সাদা পোশাকে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকেন। এত কিছুর পরও রাজ্য পুলিশের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করা হয়। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত পেলে, তবেই সফরে বেরোন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিশেষ গাড়িও রয়েছে। আগে রেঞ্জ রোভার ভোগ এবং টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ব্যবহার করতেন মোদি। ২০২১ সালে তা বদলে মার্সিডিজ মেব্যাক কিনেছেন। এটি একটি বুলেট প্রুফ গাড়ি এবং বিস্ফোরণ প্রতিরোধীও। এমনকি তাতে যে S 650 গার্ড রয়েছে, তা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিরোধীো। গাড়ির কাচ লক্ষ্য করে অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে এলোপাথাড়ি গুলি চালালেও ছিদ্র তৈরি হবে না। এ ছাড়াও বিষাক্ত গ্যাস গাড়ি থেকে বার করে দিতে রয়েছে বিশেষ প্রযুক্তি। গাড়িটির দাম পড়েছে ১২ কোটির বেশি। তার পরও প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ে আরও একডজন গাড়ি থাকে।

উচ্চ প্রযুক্তি সম্বলিত একটি অ্যাম্বুল্যান্স যেমন থাকে, তেমনই শুধুমাত্র জ্যামারের জন্য একটি গাড়ি থাকে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ে বহিরাগতকোনও ফোন বা স্যাটেলাইট সংযোগ না থাকে। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির মতো অবিকল দেখতে আরও দু’টি গাড়ি থাকে কনভয়ে, যাতে হামলার সম্ভাবনা থাকলে প্রধানমন্ত্রী যে গাড়িতে রয়েছেন, সেটিকে শনাক্ত করা না যায়। ন্যাশনাল সিকিউরিটি গ্রুপের শার্প শ্যুটারার প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেন। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি যে রাস্তা ধরে এগোয়, সেই রাস্তা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সাইরেন বাজিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ের সঙ্গে এগেতো থাকে রাজ্য পুলিশের গাড়িও। গাড়িতে ওঠা থেকে বেরনো, হাত নাড়া, বা নামা, সবসময় তাঁকে ঘিরে থাকেন এসপিজি কম্যান্ডোরা। প্রায় শতাধিক পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষী থাকেন প্রধানমন্ত্রীর কনভয়ে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়

সব প্রস্তুতির পরও শেষ মুহূর্তে আবহাওয়াজনিত কারণে বা অন্য কোনও সমস্যার জন্য যদি পরিকল্পনা মতো প্রধানমন্ত্রীর সফর না এগোতে পারে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প পরিকল্পনাও আগে থেকে তৈরি করে রাখা হয়। বিমানে প্রধানমন্ত্রী যেতে না পারলে সড়কপথ আগাগোড়া মুড়ে ফেলা হয় কড়া নিরাপত্তায়। এমনকি আচমকা কোথাও হেলিকপ্টার বা বিমানেও উড়ে যেতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে, কপ্টার বা বিমানের যাত্রাপথকে অনুসরণ করে, মাটিতেও আগাগোড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। তাই এত কিছুর পরও নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি যুবকের পৌঁছে যাওয়াকে ঘিরে প্রশ্ন উঠছে।

(Feed Source: abplive.com)