করোনার পর থেকেই বেড়েছে ‘সাময়িক পেশার’ চাহিদা, আদতে কি ক্ষতি ডেকে আনছে?

করোনার পর থেকেই বেড়েছে ‘সাময়িক পেশার’ চাহিদা, আদতে কি ক্ষতি ডেকে আনছে?

Gig Workers of India: সময়ের সঙ্গে ভারতে ‘গিগ কর্মী’-র সংখ্যা বাড়ছে। পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন স্টার্টআপের সাহায্য নিচ্ছেন পেশাদাররা। ‘গিগ’ বলতে আক্ষরিক অর্থে সাময়িক পেশা বোঝালেও এর মাধ্যমেই সংসার চালাচ্ছেন বহু কর্মী।

গিগ প্ল্যাটফর্মের কর্মী চাহিদাও তুঙ্গে। এদিকে ভারতে কর্মীর অভাবও নেই। ফলে গিগ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন আরও কর্মী। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়। সাধারণত এই গিগ কর্মীদের মধ্যে দু’টি ভাগ হয়। একটি হল কম প্রশিক্ষণের কাজ। যেমন ফুড, পণ্য ডেলিভারি। অপরটি হল প্রশিক্ষিত পেশাদারি গিগ। যেমন বাড়িতে স্যাঁলো পরিষেবা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদি মেরামত, এসি সার্ভিস, কল মিস্ত্রি, ম্যাসাজ ইত্যাদি। অর্থাত্, এমন কোনও পরিষেবা, যার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে এই জাতীয়, তালিমপ্রাপ্ত গিগ কর্মীদেরও সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে তাঁদের চাহিদাও।

একটা সময় ছিল, যখন কল মিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান খুঁজতে অনেকে হন্যে হতেন। এলাকায় নতুন এলে তো কথাই নেই। তবে সময়ের সঙ্গে এই খোঁজের প্রক্রিয়াও ডিজিটাল হয়েছে। আরবান কোম্পানির মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই জাতীয় পরিষেবা বুক করছেন অনেকেই।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের তুলনায় বর্তমানে Urban Company-তে কর্মী সংখ্যা ৫০%-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সংস্থায় প্রায় ৪৫ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। এমনটাই জানালেন সংস্থার কমিউনিকেশন ও ইএসজির ডিরেক্টর ভাব্য শর্মা। তিনি বললেন, এই সময় যোগদানকারী বেশিরভাগ কর্মীদেরই দ্রুত বৃদ্ধি আছে, এমন ক্ষেত্রে নিয়োগ করা হয়েছে। চাহিদামাফিক নতুন নতুন পরিষেবায় নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদের।

এর সব থেকে বড় সুবিধা হল, গিগ কাজের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামিদিনে অন্য কাজ বা স্বাধীন ব্যবসাও করতে পারবেন এই কর্মীরা।

তবে গিগ আর টেম্প কর্মীর মধ্যে গুলিয়ে ফেললে ভুল করবেন। গিগ বলতে স্বল্পমেয়াদের কাজকে বোঝায়। অন্যদিকে টেম্প বেশ কয়েক মাসের জন্য কার্যত নিয়োগ-ই বলা যেতে পারে। টেম্প কর্মীরা তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত। স্টাফিং ফার্মগুলির মাধ্যমে টেম্প কর্মী নিয়োগের সময়ে তাঁরা বিমার মতো কর্মীবান্ধব সুবিধাগুলিও পান।

করোনা লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন পেশায় অনিশ্চয়তা এসেছে। কিন্তু গিগ কাজের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড়সড় পরিবর্তন আসে। সেই সময়ে একধাক্কায় গিগ কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ফলে সাময়িকভাবে আয়ের নিশ্চয়তাও পেয়েছেন অনেকে।

ফাইল ছবি: মিন্ট

Swiggy-তে কর্মরত এমনই এক ডেলিভারি পার্টনার বিকাশ জানালেন, ‘ওষুধের দোকানে কাজ করতাম। ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে হঠাত্ই বসিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময়েই সুইগিতে জয়েন করি। এর ফলে বাড়ির খরচ, মোটরবাইকের EMI, সবই মেটাতে পেরেছি।’ আগামিদিনেও কি এই লাইনেই থাকবেন? এর উত্তরে বিকাশ জানালেন, আপাতত কাজের স্বাধীনতায় তিনি খুশি। নতুন পেশার বিষয়ে ভাবছেন। তবে যতদিন না সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, এই গিগ কাজই তাঁর খরচ চালাতে সাহায্য করছে।

দক্ষতার ভিত্তিতে গিগ কাজেও ভাল আয় করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, Urban Company-র এক মুখপাত্র জানালেন, মাসে ৩০ বারের বেশি পরিষেবা প্রদান করেছেন, এমন কর্মীরা অনেকেই ৩১ হাজার টাকার বেশি আয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সেরা ২০% কর্মীরা মাসে গড়ে ৩৮ হাজার টাকারও বেশি আয় করে থাকেন। ভালো কাজ করা প্রায় ৫০০ কর্মীকে ৫.২ কোটি টাকার স্টকও প্রদান করেছে সংস্থা। সংস্থা জানিয়েছে, তাদের মোট কর্মীর এক-তৃতীয়াংশই মহিলা। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ মহিলা কর্মী নিয়োগের লক্ষ্য স্থির করেছে সংস্থা।

আর্বান কোম্পানিতে কর্মরত এমনই এক পার্টনার মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, বছরতিনেক আগে গিগ কাজের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। এই কাজের থেকে যে আয় হয়, তাই দিয়েই মা-বাবা, সন্তানদের দেখভাল করেন এই ‘সিঙ্গেল মাদার’। এর আগে চানাচুর, ধূপকাঠি বিক্রি করতেন। সেভাবে সংসার চালানো বেশ দুষ্কর ছিল। সন্তানদের স্কুলে পড়াতে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজও নেন। তবে বর্তমানে কিছুটা হলেও আয় নিয়ে আশাবাদী তিনি।

২০২২ সালে নীতি আয়োগের প্রকাশিত ‘India’s Booming Gig and Platform Economy’ শীর্ষক এক রিপোর্টে গিগ ইকোনমির পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২০-২১ সালে প্রায় ৭৭ লক্ষ কর্মী এই গিগ ইকোনমির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে অকৃষি ক্ষেত্রেই প্রায় ২.৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০৩০ সালে এই অস্থায়ী ক্ষেত্রে প্রায় ২.৩৫ কোটি কর্মী যুক্ত হতে পারেন।

শুধু ভারতই নয়। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকেও আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে মোট কর্মী সংখ্যার ৪০ শতাংশই গিগ কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। বাংলাদেশেও গিগ অর্থনীতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে গিগ কাজের দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে। এই বিপুল সংখ্যক কর্মীদের নায্য অধিকার, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট আইনেরও প্রয়োজন আছে।

বর্তমানে বিভিন্ন গিগ প্ল্যাটফর্মগুলি স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, Zomato ডেলিভারি পার্টনার ও তাঁদের পরিবারকে ১ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা কভারেজ দেওয়া হয়। ১০ লক্ষ টাকার জীবন বিমা মেলে। এক বিবৃতিতে সংস্থা জানিয়েছে, ‘২০২১-২২ অর্থবর্ষে মোট ৯,২১০ জন পার্টনারকে ১৫.৯৪ কোটি টাকার সহায়তা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ৯.৮ কোটি টাকা সম্পূর্ণরূপে অসুস্থতাজনিত চিকিত্সা খরচ হিসাবে দেওয়া হয়েছে।’

শুধু তাই নয়, কর্মরত অবস্থায় আহত হয়ে কাজ করতে না পারলে কর্মীদের দিনে ৫২৫ টাকা করে সাময়িক খরচ প্রদান করা হয়। ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এভাবে সহায়তা পান কর্মীরা।

আরবান কোম্পানি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সমস্ত সক্রিয় পার্টনারদের ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিমা কভারেজ প্রদান করা হয়। জীবন এবং দুর্ঘটনাজনিত বিমার অঙ্ক ৬ লক্ষ টাকা। এর পাশাপাশি নিজের এবং পরিবারের জন্য (যেক্ষেত্রে প্রযোজ্য) বছরে ১২ বার পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিত্সক দেখানোর সুযোগ পান তাঁরা।

অর্থাত্, অস্থায়ী কাজ হলেও সময়ের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে কর্মীদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এই সকল ক্ষেত্রে কর্মীদের অধিকার, নায্য পারিশ্রমিক ও সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা আও বেশি তাত্পর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামিদিনে এই খাতের বিবর্তন নিয়েও পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে।

(Feed Source: hindustantimes.com)