স্বপ্ন দেখা থেকে স্বপ্ন ভাঙা! সমরেশ মজুমদার চিনিয়েছিলেন সত্তরের উত্তাল দশক

স্বপ্ন দেখা থেকে স্বপ্ন ভাঙা! সমরেশ মজুমদার চিনিয়েছিলেন সত্তরের উত্তাল দশক

কলকাতা: সত্তরের উত্তাল দশক৷ শিয়ালদা স্টেশন থেকে গুটি পায়ে বেরল যে ছেলেটা, তার নাম অনিমেষ মিত্র৷ ঠাকুরদা, বাবা, পিসিমার আদরে, শাসনে উত্তরবঙ্গের সবুজ পাহাড়ের মাঝে আশৈশব কাটিয়ে আসা অনিমেষ৷ সেই অনিমেষ মুখ থুবড়ে এসে পড়ল সত্তরের অগ্নিগর্ভ কলকাতায়৷ চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলল ট্রাম৷ পায়ের উরু এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল বুলেট৷ যে গুলির ক্ষত তাকে আজন্ম বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে৷ শরীরে, মনে৷

এই অনিমেষের সঙ্গে বেশ সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমাদের৷ আমরা যারা বাঙালি। আমরা যারা সত্তরের দশককে চিনতে চেয়েছি। জানতে চেয়েছি, ঠিক কেন, কী কারণে, নিজেদের বর্তমান, ভবিষ্যৎ এভাবে জলাঞ্জলি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই অনিমেষরা৷ ওদের চোখে কোন স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নই যখন ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেল, তখনই বা ঠিক অবস্থা হয়েছিল এই অনিমেষদের? কেমন করে কেটেছে এই অনিমেষদের বাকি জীবন৷

সেই জীবন্ত দলিলই যেন কালবেলা ট্রিওলজি৷ সত্তরের দশক নিজের চোখে না দেখলেও, এই অনিমেষকে চেনা লাগে নব্বইয়ের যে কোনও কিশোর কিংবা তরুণীর৷ এই অনিমেষকে আপামর বাঙালির কাছে একটা রক্তমাংসের মানুষ করে তুলেছিলেন তাঁর স্রষ্টা সমরেশ মজুমদার৷ যাঁর লেখনীতে বার বার ফুটে উঠেছে অনিমেষের স্বপ্ন, অনিমেষের দ্বন্দ্ব, অনিমেষের ঠিক-ভুলে ভরা জীবন৷ বাম ছাত্র রাজনীতি থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলন৷ সত্তরের সেই আগুনে ঝাঁপ। সমরেশের অনিমেষ চিনিয়েছে সত্তরের স্বপ্ন দেখা প্রজন্মকে। সমরেশের অনিমেষ যেন ওদেরই প্রতিনিধি৷

উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ৷ তিন প্রজন্মের গল্প হলেও, সুতোখানা একটাই৷ অনিমেষ৷ তাঁর জীবনের চড়াই উতরাই, প্রেম, সংসার, রাজনীতি ঘিরে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার একটা নিখুঁত ছবি৷

সমরেশ মজুমদারের নারী চরিত্ররাও কিন্তু অদ্ভুত৷ অদ্ভুত রকম দৃঢ়৷ সে কালবেলার মাধবীলতাই হোক, কিংবা গর্ভধারিণীর জয়িতা, অথবা সাতকাহনের দীপা৷ সত্তরের দশকের লড়াকু তরুণী প্রেমিকা থেকে স্ত্রী এবং কালপুরুষে, অর্ক-র মা৷ জীবনের প্রত্যেক ভূমিকায় মাধবীলতাই যেন আদর্শ নারী৷ আর এদিকে নিজের আদর্শের খাতিরে আক্ষরিক অর্থেই গর্ভাধারিণী হয়ে উঠেছিল যে মেয়ে, সেই জয়িতা, জয়িতাও যেন অন্য় এক মাটিতে গড়া চরিত্র৷

এমন খুব কম বাঙালি মেয়েই আছে যারা সাতকাহনের দীপাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়নি৷ বাল্য বিবাহের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কাটিয়েও যে দীপা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল৷ কোনও বাধা, কোনও বিপত্তিই যাকে ছুঁতে পারেনি৷ এই মাধবীলতা, জয়িতা, দীপা এরা প্রত্যেকেই যেন বড্ড বেশি জ্যান্ত৷ যেন এরা হতেই পারত আমাদের পাশের বাড়ির কেউ, আমাদের অত্যন্ত পরিচিত কেউ৷

কালবেলা সিরিজের প্রথম তিনটি উপন্যাস – উত্তরাধিকার, কালবেলা এবং কালপুরুষ প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে। কালবেলার জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার৷ এই সিরিজের সর্বশেষ বই মৌষলকাল প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। ২০০৯ সালে পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘কালবেলা’ উপন্যাসের উপরে একটি সিনেমাও তৈরি করেন। সেখানে অনিমেষের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে এবং মাধবীলতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পাওলি দাম।

দীর্ঘ রোগভোগের পরে সোমবার বিকেল পৌনে ৬টা নাগাদ ইহলোক ত্যাগ করেছেন অনিমেষ, মাধবীলতা, জয়িতাদের স্রষ্টা, সমরেশ মজুমদার৷ যাঁর লেখনীতে বারবার উঠে এসেছে নিপীড়িতদের কথা, সমাজের নিচুস্তরের মানুষের দাবিদাওয়ার কথা, সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্নের কথা, ফাঁপা রাজনীতির কথা৷ আজ, ৮ মে ২০২৩, বিকেল পৌনে ৬টায় চিরকালের জন্য থমকে গেল সেই কলম৷

(Feed Source: news18.com)