স্যুটবুটের জায়গায় পাগড়ি, আচমকা মোদির মন্ত্রিসভায় রদবদল, নেপথ্যে যে কারণ…

স্যুটবুটের জায়গায় পাগড়ি, আচমকা মোদির মন্ত্রিসভায় রদবদল, নেপথ্যে যে কারণ…

নয়াদিল্লি: সামনেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগেই রদবদল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। আইনমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হল কিরেণ রিজিজুকে (Kiren Rijiju)। তাঁকে সরিয়ে  আইন মন্ত্রকের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী করা হয়েছে অর্জুন রাম মেঘওয়ালকে (Arjun Ram Meghwal)। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারে ‘ট্রাবলশ্যুটার’ হিসেবেই এতদিন পরিচিত ছিলেন রিজিজু। মোদি সরকারের অন্যতম হাইপ্রোফাইল মন্ত্রীও বলা হতো তাঁকে। আপাতত তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের। তবে এতদিন সংসদীয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আসীন মেঘওয়ালকে আচমকা তুলে আনার নেপথ্যে বিজেপি-র নির্বাচনী কৌশলই দেখছে রাজনৈতিক মহল (Modi Cabinet Reshuffle)।

দেশের সাম্প্রতিকতম ইতিহাসে এই প্রথম পূর্ণ সময়ের মন্ত্রী নন, এমন কাউকে আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের স্বাধীন দায়িত্ব দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, রিজিজুর অধীনে এতদিন যিনি আইনমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সেই এসপি সিংহ বাঘেলকে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের জুনিয়র মন্ত্রী করা হয়েছে। এই রদবদল নিয়ে যদিও কোনও বৈরিতা প্রকাশ করেননি রিজিজু। বরং আইনমন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, সুপ্রিম কোর্ট এবং সব রাজ্যের হাইকোর্টের বিচারপতি, বিচারবিভাগের সঙ্গে যুক্ত আধিকারদেরও ধন্যবাদ জানান সহযোগিতার জন্য।

তবে রিজিজুর তুলনায় অখ্যাত হলেও, সংসদভবনে বিশেষ পরিচিতি রয়েছে মেঘওয়ালের। লোকসভায় বিজেপি-র চিফ হুইপ ছিলেন একসময়। রাজস্থানি পাগড়ি মাথায় বেঁধে, কুর্তা-পাজামার উপর হাফ জ্যাকেট চাপিয়ে, সাইকেল চালিয়ে সংসদে পৌঁছনের নজির রয়েছে তাঁর। সেই সাইকেলে ঝোলানো ব্যানারে গেরুয়া ব্য়াকগ্রাউন্ডে নিজের রাজস্থানি পরিচয় লেখা ছিল, তিনি বিকানেরের সাংসদ বলে, যা মাটির কাছাকাছি বলে আলাদা পরিচিতি দিয়েছিল তাঁকে। সামনেই রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তার আগে, মেঘওয়ালকে তুলে এনে বিজেপি আসলে তফসিলি ভোটকে কাছে টানার কৌশল নিয়েছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের।

রাজস্থানে এই মুহূর্তে ঘোর সঙ্কটে কংগ্রেস। সেখানে অশোক গহলৌত এবং সচিন পায়লটের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, মেঘওয়ালকে সামনে রেখে মরুরাজ্যে বিজেপি এগোতে চাইছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ৬৯ বছর বয়সি মেঘওয়ালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। MBA-ও করেছেন।  রাজস্থান অ্যাটমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস-এর আধিকারিক থেকে IAS হিসেবে উন্নতিও হয়। স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ২০০৯ সালে বিকানের থেকে বিজেপি-র টিকিটে প্রার্থী হন মেঘওয়াল। কংগ্রেসের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক তাঁর। ২০০৮ সালে রাজ্য নির্বাচনের সময় মেঘওয়ালকে চুরু থেকে বদলি করে দেয় কংগ্রেস। তাদের অভিযোগ ছিল, আড়ালে বিজেপি-র সঙ্গে ষড় করেছেন তিনি। ২০০৮ সালে রাজস্থানের তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার মেঘওয়ালকে চার মাসে চার বার বদলি করে।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিকানেরের লোকসভা আসনটি অভিনেতা ধর্মেন্দ্রর দখলে ছিল। ২০০৯ সালে আসন পুনর্বিন্যাসের পর সেটিকে তফসিলি সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকে টিকিট পান মেঘওয়াল। তাতে ২০ হাজার ভোটে জয়ী হন মেঘওয়াল। ২০১০ সালে বিজেপি-র ন্য়াশনাল এগজিকিউটিভেও জায়গা পান। রাজস্থানে দলের সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। সমকামিতাকে অপরাধমুক্ত ঘোষণা করা হলে, ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে প্রাইভেট মেম্বার বিল আনেন মেঘওয়াল। ২০১৩ সালে তাঁকে সেরা সাংসদ হিসেবে পুরস্কৃত করে তৎকালীন UPA সরকার। তবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিকানেরে সনিয়া গাঁধীর জামাই রবার্ট বঢরার বিরুদ্ধে বেআইনি জমিচুক্তির অভিযোগে সরব হন তিনি। তার পর থেকেই সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-তে গুরুত্ব বাড়ে মেঘওয়ালের।

এ বার সরাসরি আইন মন্ত্রকের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হলেন মেঘওয়াল। তবে রিজিজুকে সরানোর নেপথ্য়ে তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ককেও দায়ী করছেন অনেকে। কারণ আইন মন্ত্রকের পদ থেকে রিজিজুকে এমন সময় সরানো হল, যেই সময় কেন্দ্রী. সরকারের সঙ্গে বার বার সুপ্রিম কোর্টের মতবিরোধ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ২০২১ সালের ৭ জুলাই রবিশঙ্কর প্রসাদের থেকে আইনমন্ত্রকের দায়িত্ব হাতে নেন রিজিজু। তার পর বার বার বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। প্রকাশ্যে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন তিনি। বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই অসন্তোষ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ। বিচারপতি নিয়োগ এবং বদলিতে ঢিলেমি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

তার পরও নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন রিজিজু। সাফ জানিয়ে দেন, সংবিধান এবং মানুষের রায় মেনেই দেশ চালানো উচিত। তাঁর বক্তব্য ছিল, “কখনও কখনও নানা বিষয়ে আলোচনা শোনা যায়। গণতন্ত্রে প্রত্যেকেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন যাঁরা, কিছু বলার আগে দু’বার ভাবা উচিত তাঁদের। বুঝতে হবে, তিনি যা বলছেন তা দেশের স্বার্থের অনুকূল নাকি পরিপন্থী।” কেউ কাউকে নির্দেশ দিতে পারে না, এমন মন্তব্যও করেন তিনি।

বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রিজিজু।  তাঁর দাবি ছিল, সংবিধানে কলেজিয়াম পদ্ধতির কোনও উল্লেখ নেই। আদালত বা বিচারপতিরা যে সব সিদ্ধান্ত নেয়, তার জন্যই সংবিধানে কলেজিয়ামের উল্লেখ নেই। বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত গোটা দেশের কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রিজিজু। বিচারপতি নিয়োগে সরকারের ভূমিকার উপরই জোর দেন তিনি। ২০১৪ সালে সংসদে পাস হওয়া ন্যাশনাল জুডিশিয়ারি অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের উল্লেখও করেন, যা খারিজ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের কেউ কেউ সমাজকর্মী হয়ে বিচারবিভাগকে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অতি সম্প্রতিই মন্তব্য করেন রিজিজু। তাতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও জমা পড়ে শীর্ষ আদালতে, যা খারিজ হয়ে যায়। তার পরই আইনমন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে সরানো হল রিজজুকে।

(Feed Source: abplive.com)