ইংল্যান্ড ‘জয়’ করলেন কিন্তু দেশে ফিরলেন না ‘রাজা’

ইংল্যান্ড ‘জয়’ করলেন কিন্তু দেশে ফিরলেন না ‘রাজা’

কলকাতা: রাজত্ব ছিল না, কিন্তু রাজা ছিলেন তিনি। Asiatic Journal-এ ড. কার্পেন্টার তাঁর দৈহিক বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘ব্যক্তি রাজা রামমোহন রায় অত্যন্ত সজ্জন। প্রায় ৬ ফুটের মতো লম্বা, হাত-পায়ের গড়ন শক্তিশালী। বয়সের কারণে বা ওজন বৃদ্ধির কারণে বপুবৃদ্ধি হলেও তাঁর মুখশ্রী ছিল সুন্দর…।’ শালপ্রাংশু চেহারাই শুধু ছিল না, মনের জোর ছিল তার চেয়েও বড়। আঠারোশ শতকের ভারতে কার্যত বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই ‘রাজা’।

তাঁকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন, তৎকালীন মুঘল শাসক সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। যদিও সেই সময় সাম্রাজ্যের কিছুমাত্র আর অবশিষ্ট ছিল না। তাঁকে রাজা উপাধি দিয়ে লন্ডন পাঠিয়েছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে যেন তাঁকে আরও বেশি পেনশন দেওয়া হয় সঙ্গে ছিল এই বার্তাও। তবে শুধু এটাই নয়, নিজের বার্তাও ছিল তাঁর। মূলত তিনটি কারণে তাঁর ইংল্যান্ড যাত্রা। এক-সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের বার্তা ইংল্যান্ডের রাজার কাছে পৌঁছনো। দুই- ইংল্যান্ডের হাউস অফ কমনসে সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য বলা। তিন- হাউস অফ কমনসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার পুনর্নবীকরণের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা। জীবনের শেষ দুই বছর ইউরোপে, মূলত ইংল্যান্ডে ছিলেন তিনি। তার মধ্যেই লন্ডনের অভিজাত মহলে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়।

চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ‘গ্লোরি, গ্লোরি, গ্লোরি…’
১৮৩০ সালের নভেম্বর। অ্যালবিয়ন নামের একটি জাহাজে চড়লেন রামমোহন। সঙ্গী চাকর, রাঁধুনি, দত্তকপুত্র রাজারাম এবং গাভী। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় একটি ঘটনা ঘটেছিল। তাঁর জাহাজ যখন তৎকালীন কেপ টাউন বা উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে, রামমোহন একটি দুর্ঘটনায় পড়েন। তাতে তাঁর পা ভেঙে যায়। অসুস্থ থাকাকালীন তিনি দেখতে পান তাঁর জাহাজের কাছেই রয়েছে দুটি জাহাজ। যেদুটির মাথায় উড়ছে ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীন ফ্রান্সের পতাকা। ব্যথা ভুলে নাকি লাফিয়ে উঠেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। হাত মুঠো করে ওই দুটি জাহাজের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেছিলেন ‘গ্লোরি, গ্লোরি, গ্লোরি টু ফ্রান্স’। ফরাসি বিপ্লবের ঘটনা নিয়ে নাকি

তটাই উদ্বেল ছিলেন তিনি।

পা রাখলেন ইংল্যান্ডে:
১৮৩১ সালের ৮ এপ্রিল ইংল্যান্ডের লিভারপুলে পৌঁছন তিনি। সেখান থেকে দ্রুত পৌঁছল লন্ডনে। শুরু থেকেই তাঁকে ঘিরে কী পরিমাণ উৎসাহ ছিল সেইসময়ে লন্ডনের অভিজাত মহলে তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে মেরি কার্পেন্টারের (Mary Carpentar)-এর লেখা ‘The Last Days in England of the Rajah Rammohun Roy’-এর পাতায় পাতায়। ধর্ম বিষয়ে রাজা রামমোহনের অগাধ পাণ্ডিত্য, তাঁর চোখে ধর্মীয় বিশ্লেষণ, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে তাঁর লেখা আগেই গভীর প্রভাব ফেলেছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের অভিজাত মহলের একটি বড় অংশের মধ্যে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বই Raja Rammohun Roy-এ লিখছেন, রাজা রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে এসেছেন এই খবর শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ William Roscoe. তখন তিনি ভীষণ অসুস্থ। তাঁর ছেলে রামমোহনকে অনুরোধ করেন দেখা করার জন্য। গিয়েছিলেন তিনি। দুই জনের কথাও হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। সেইসময় সামনেই উপস্থিত ছিলেন William Roscoe-এর ছেলে। সেই অভিজ্ঞতার কথা পরে লিপিবদ্ধও করেছিলেন তিনি। সেই সাক্ষাৎ-এর কয়েকদিন পরেই মারা যান William Roscoe.

মাঝে প্যারিস ভ্রমণ:
ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় জাহাজের ঘটনা আগেই বলা হয়েছে। গোড়া থেকেই ফরাসি বিপ্লবের প্রতি, সেখানে ওঠে স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের বার্তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ছিল রামমোহনের। রাজা রামমোহনও কিন্তু ফরাসি বিদ্বজন মহলে অপরিচিত ছিলেন না। রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বই থেকে জানা যায়, ১৮১৮ সালেই রামমোহনের লেখার বেশ কিছু অংশ ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন সেই সময় একটি ইংরেজি পত্রিকারর এডিটর। ইংল্যান্ড সফরের মাঝেই ১৮৩২ সালে প্যারিস গিয়েছিলেন তিনি, তারপরে আবার ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে।

প্রবল ব্যস্ততা এবং অসুস্থতা:
লন্ডন সফরে প্রথম থেকেই ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ইংরেজ অভিজাতদের সঙ্গে দেখা করা অন্যতম কাজ ছিল তাঁর। তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজার ভাই, ডিউক অফ কাম্বারল্যান্ড রামমোহনকে হাউস অফ লর্ডসে উপস্থিত করান। লন্ডনে থাকাকালীন দাসপ্রথা রদের অন্যতম নায়ক Lord Brougham-এর সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল রাজা রামমোহন রায়ের। ১৮৩১-এর ৬ জুলাই, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরেরা রামমোহনের সম্মানে ডিনার পার্টিও দিয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বই থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ডের রাজার তরফেও আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রামমোহন। লন্ডল ব্রিজ চালু হওয়ার উপলক্ষে রাজার তরফে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন এই রাজা। নানা বিষয়ে পড়াশোনা, আলোচনা- বক্তৃতা এই নিয়েই ওই সময়টা ভীষণ ব্যস্ততাতেই কেটেছে রাজা রামমোহনের।

সেই ব্যস্ততা এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম বড়সড় প্রভাব ফেলেছিল রামমোহনের স্বাস্থ্যে। একদিকে স্বাস্থ্য অন্যদিকে আর্থিক টানাটানি -দুইয়ের সম্মিলিত কারণে বন্ধুদের পরামর্শে লন্ডন ছেড়ে ব্রিস্টল চলে যান তিনি। সেটা ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বরের একেবারে প্রথম দিক। সেখানে গিয়ে তিনি উঠেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর পরিচিত Miss Castle-এর বাড়িতে। বন্ধুদের সান্নিধ্যে সময়টা শুরুতে ভাল কাটলেও সেই বছরেই ১৯ সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। প্রবল জ্বর এবং মাথাব্যথায় কাহিল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই অসুস্থতার সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁকে শুশ্রূষা করেছিলেন ডেভিড হেয়ারের এক বোন। একাধিক চিকিৎসকও তাঁকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল করে দেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টলের ওই বাড়িতে চিরঘুমে যান প্রবাদপ্রতিম ওই সমাজ সংস্কারক।

শেষের সেই সময়:
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়. শেষ সময়ে তাঁর চিকিৎসা করছিলেন Dr Estlin, তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছিল শেষ সময়ের মুহূর্তটা। রাজা রামমোহনের সঙ্গে তাঁর দেখা, আলোচনা, চিকিৎসা সবের বিবরণ দিয়ে একটি ডায়েরি ছিল তাঁর। সেখানেই ২৭ সেপ্টেম্বরের তারিখ দিয়ে Dr Estlin লিখছেন, ‘সেটা পূর্ণিমার রাত ছিল। একদিকে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। আমি, মিস হেয়ার এবং মিস কিডেল সেদিকে দেখছিলাম, কী শান্ত পরিবেশ। আর ঘরের মধ্যে মৃত্যুশয্যায় রয়েছে এক অসাধারণ ব্যক্তি। আমি কোনওদিন ওই সময়টা ভুলব না।’ শেষ নিঃশ্বাসের সময় রাজা রামমোহনের ঠোঁট ফাঁক করে নাকি একটিই শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল- ‘ওম’

মেরি কার্পেন্টারের (Mary Carpentar)-এর লেখা ‘The Last Days in England of the Rajah Rammohun Roy-এ দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী, ব্রিস্টলের Stapleton Grove-এর রাজা রামমোহন রায়কে সমাধিস্ত করা হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন তাঁর দত্তক পুত্র রাজারাম, রামমোহনের দুই চাকর রামহরি দাস এবং রামরতন মুখার্জি এবং রাজার একাধিক অনুরাগী ও বন্ধু। মেরি কার্পেন্টারের লেখায় জানা যায়, রাজা রামমোহনকে কীভাবে সমাধিস্ত করা হবে তা নিয়ে নানা চিন্তা ছিল তাঁর বন্ধুদের। খ্রিস্টানদের সঙ্গে তাঁকে সমাধিস্ত করা যাবে না। এমন কিছুই করা যাবে না যাতে ভারতে তাঁর সম্মান নষ্ট হয় কিংবা তাঁর পুত্রকে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যায় পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত Miss Castle  Stapleton Grove-এই একটি জায়গায় সমাধিস্ত করার প্রস্তাব দেন, যা সাদরে গৃহীত হয়।

রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পরে ইংল্যান্ডে যান তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁর উদ্যোগে  Stapleton Grove-থেকে কফিন বের করা হয়, ব্রিস্টলের কাছেই Arno’s Valley-তে দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। সেটা ১৮৪৩ সালের ২৯ মে। পরে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও বানান দ্বারকানাথ ঠাকুর। তারও অনেক অনেক পরে ১৯৯৭ সালে সেখানে রাজা রামমোহন রায়ের একটি মূর্তি গড়ে তোলা হয়।

যে দেশের জন্য এত লড়াই, যে সমাজের কুপ্রথা বন্ধ করার জন্য এত চেষ্টা। সেই দেশ থেকেই বহুদূরে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন এই রাজা। সেখানেই সমাধিস্ত হয়েছিলেন। সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই কীভাবে করতে হয় তা নিজের জীবন দিয়ে শিখিয়েছিলেন এই ‘রাজা’। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জ্বলন্ত মশাল ছিলেন তিনি। আঠারশো শতকে তিনি যা লড়াই করেছিলেন, তাঁর সিকিভাগ লড়াইও কি হয় এখন? যদি হয়ে থাকে তাহলে একমাত্র সেটাই হবে এই প্রবাদপ্রতিম বঙ্গসন্তানকে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে দেওয়া উপযুক্ত অর্ঘ্য।

তথ্যসূত্র:
১. ‘Raja Rammohun Roy’ by Saumyendranath Tagore
২. ‘The Last Days in England of the Rajah Rammohun Roy’ by Mary Carpentar
৩. চতুরঙ্গ, বর্ষ ৫৭, সংখ্যা ২

(Feed Source: abplive.com)