জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: মণিপুরে আগুন জ্বলছে। বহুদিন থেকেই জ্বলছে। দেশ জুড়ে তা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা, রাজনৈতিক টানাপোড়েনের শেষ নেই। অ-রাজনৈতিক প্রতিবাদ? হ্যাঁ, মণিপুর নিয়ে তা-ও ঘটল সম্প্রতি কবি জয় গোস্বামীর একটি কবিতা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হতে দেখা গেল। ‘মণিপুর ২০২৩’ শীর্ষক এই কবিতাটি শুরুই হচ্ছে — ‘ভালো চাই, তোর ভালো চাই/ সুখে শান্তিতে থাক মা!’র মতো একটি লাইন দিয়ে। কবিতায় একটি চিত্রকল্প রয়েছে। এক বৃদ্ধ, পিতৃস্থানীয় এক মানুষ তাঁর পিঠে ‘মণিপুর’ নামের অগ্নিগর্ভ এক বোঝা। সেটি বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। সহসা সেই ঝোলা থেকে নগ্ন নারী বেরিয়ে এসে বলে– ‘গা ঢাকব বলে একটু কাপড় চাইছি/
ঘর থেকে এনে দাও’! কিন্তু বৃদ্ধটি কী তুলে দেবেন তাঁদের হাতে? ভয়ংকর অসহায় মানুষটি তখন গভীর দুঃখের সঙ্গে বলে ওঠেন– ‘এই বৃদ্ধ শরীরে যে চামড়া অবশিষ্ট/ সেটুকু ছাড়িয়ে তোদের দিচ্ছি/তা দিয়েই দেহ ঢাক মা!’
(সম্পূর্ণ কবিতাটিও রইল:
ম ণি পু র, ২ ০ ২ ৩
জয় গোস্বামী
ভালো চাই, তোর ভালো চাই
সুখে শান্তিতে থাক মা !
মুখে বলা খুব সোজা
কবিতায় এই কথা
লিখেওছি আমি, লিখে দেওয়া যে কী সস্তা !
পিঠে বয়ে চলি মণিপুর নামে
অগ্নিগর্ভ বোঝা
পথের মধ্যে খুলে পড়ে যায় বস্তা
পোশাক-হারানো মেয়েরা বেরিয়ে বলে,
তুমি আমাদের বাবা
গা ঢাকব বলে একটু কাপড় চাইছি
ঘর থেকে এনে দাও
কোথায়-বা ঘর? ভারতবর্ষ নাম
এই দেশে লজ্জাও
চোখ ঢাকছে না, বৃদ্ধ শরীরে যে চামড়া অবশিষ্ট
সেটুকু ছাড়িয়ে তোদের দিচ্ছি
তা দিয়েই দেহ ঢাক মা !)
কবিতা কয়েকটি অক্ষর, কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি লাইনের সমাহার মাত্র। আপাত-নিরীহ, কিন্তু অমোঘ তার শক্তি। কবি জয় মণিপুরকে কেন্দ্র করে কবিতার সেই শক্তিকেই যেন নতুন করে জাগিয়েছেন। ‘মণিপুর ২০২৩’ শীর্ষক এই কবিতাটির চরণ-চিহ্নগুলি ধরে কবিতার শরীর-পরিসরের ভিতর থেকে ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এক গভীর প্রতিবাদ! কালি-কলমের যে-প্রতিবাদ সভ্যতার জন্য সব সময় জরুরি, যে-প্রতিবাদ যে কোনও দেশের সংস্কৃতির শুদ্ধির জন্য সদা-প্রয়োজনীয়, যে-প্রতিবাদ সেই দেশটির বহমান রাজনীতির পক্ষে যেন অন্তঃশীল শাসনের কঠিন সুষমা। এমন কঠিন সুষমা রচনা করতে পারেন একজন কবিই।
এবং এমন সুষমা এই কবি আগেও রচনা করেছেন। বরাবরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস এবং অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ানোর স্নায়ু দেখিয়ে এসেছেন জয়। সেই কতকাল আগে ঘটেছিল গুজরাত দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পরে তাঁর কবিতায় উঠে এসেছিল ধিক্কার-ঢেউ। সেই সময়ে তাঁর লেখা একটি কবিতা বেরিয়েছিল একটি সংবাদপত্রে। সাড়া পড়ে গিয়েছিল।
তারপর (২০০৬-২০০৭) সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি বাঁচাও আন্দোলন নিয়ে জেগে উঠেছিল গোটা বাংলা। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ধিক্কার জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন জয়। এই কবিতাগুলি নিয়ে (১৫টি কবিতা) প্রকাশিত হয়েছিল ‘শাসকের প্রতি’ বই। সেখানে ছিল ‘শাসকের প্রতি’ শীর্ষক একটি কবিতাও। কবিতাটি শুরুই হয়েছিল এই ভাবে– ‘আপনি যা বলবেন/আমি ঠিক তাই কোরবো/তাই খাবো/তাই পরবো’। তবে ভয়ংকর শ্লেষের মধ্যে দিয়ে কবি তাঁর চরিত্রটিকে দিয়ে শেষে বলিয়েছেন– শাসকের চোখ-রাঙানিতে তিনি গলায় দড়ি দিয়ে সারারাত ঝুলেও থাকতে পারেন, কিন্তু ‘পরদিন যখন বলবেন/ এবার নেমে এসো/ তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে/ একা একা নামতো পারবো না’!
গত বছরও প্রকাশিত হয়েছিল জয় গোস্বামীর এই কবিতা-প্রতিবাদ। ১২ জুলাই ২০২২ প্রকাশিত হয় ‘কঙ্কাল’। তবে পরে ‘ঘাতক’ শীর্ষক কৃশকায় কবিতাগ্রন্থে ঠাঁই পায় এই ততোধিক শীর্ণকায় সংকলন। মাত্র ৩২ পৃষ্ঠার ১৮ কবিতার শীর্ণকায় সংহত সংকলন ‘ঘাতক’। আকারে শীর্ণ, কিন্তু আড়ালে তার কবির সোজা শিরদাঁড়ার রূঢ়তা। রাজনৈতিক নষ্টামির প্রতিবাদে জেগে-ওঠা কবি-কলম, শাসকের ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে রেগে-ওঠা কবিকণ্ঠ। শাসকের-ঘাতকের মুখোশ যেন এক টানে এখানে খুলে দেন কবি।
আবারও সেই প্রতিবাদী কবি তাঁর কবিতা-প্রতিবাদ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চোখ রেখেছেন অন্যায়ের চোখে, অবিচারের চোখে, নৈরাজ্যের চোখে।
(Feed Source: zeenews.com)