বাংলাদেশঃ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবি

বাংলাদেশঃ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম ও তার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পীর শিল্পকর্মের চৌর্যবৃত্তি রোধের দাবি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।

বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে জাগরণ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তারা।

এ সময় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সরকারের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকর্ম যেন কেউ ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানের নামে কপিরাইট করতে না পারে সেই দাবি করলেও যেন সরকার নিজে কপিরাইট করে সংরক্ষণ করে সেই দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার নিজের আওতায় রেখে প্রয়োজনে লেখক ও গবেষকদের ব্যবহার করতে দিক।

তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালে আয়োজিত এক নাগরিক সংবর্ধনায় ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন। এর আগে সামাজিক কারণে কেউই কথা বলতে রাজি হননি।

সে দিন ৫ লাখ নির্যাতিত নারীর প্রতিনিধি হয়ে প্রিয়ভাষিণীই প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে চারুশিল্পী ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, দেশের ভাস্কর্য শিল্পের ইতিহাসে নভেরা আহমেদ, শামীম শিকদার এবং ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এই ৩ জন নারী ভাস্কর তাদের আপন মহিমায় চির ভাস্বর। এর মধ্যে আমার মা ভাস্কর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবন সংগ্রাম ও কর্মযজ্ঞ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য এক আলোকবর্তিকা।

তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সম্প্রতি নিউইয়র্ক প্রবাসী আখতার আহমেদ রাশা নিউইয়র্ক, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ভাস্কর প্রিয়ভাষিণীর বিভিন্ন ভাস্কর্য নকল করে মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি, আরও কেউ কেউ প্রিয়ভাষিণীর শিল্পকর্ম সামান্য পরিবর্তন বা বিকৃত করে নিজেদের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন।

একজন অগ্রজ শিল্পীর শিল্পকর্ম, মাধ্যম ও দর্শন বা জীবনবোধ দ্বারা যে কোনো ব্যক্তি বা শিল্পী অনুপ্রাণিত হতেন পারেন। কিন্তু অনুসরণ আর অনুকরণের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা অনুধাবন করা জরুরি।

অনুকরণ, নকল বা কপি করা কাজ কখনো মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শিত হতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি নন্দনতত্ত্বের নৈতিকতার পরিপন্থি। ক্রমাগত নকল করে প্রকৃত শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরিবর্তে তার সমগ্র জীবনের সাধনাকে অসম্মান করা হয়। আমি নিজে শিল্পচর্চার সাথে যুক্ত থেকে অনুসরণকে উৎসাহ দিলেও অনুকরণকে স্বাগত জানাতে পারি না।

তিনি আরও বলেন, সঙ্গত কারণে এ অশিল্পীসুলভ আচরণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। যেহেতু মৌখিকভাবে বহুবার অনুরোধের পরও আখতার আহমেদ রাশার এ চৌর্যবৃত্তিকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি, তাই আইনিপ্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি।

২০১০ সালে আমার মা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও শিল্পকর্মের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর পরিবার ও সমাজের সকল নিগ্রহ, অবজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বেঁচে থাকার অমোঘ বাসনায় পথ চলতে তিনি কুড়িয়ে নিয়েছিলেন মরা ডালপালা, গাছের শেকড়-বাকল।

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, পরিত্যক্ত সামগ্রীর মাঝে সমাজের কাছে অবহেলিত নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। বেঁচে থাকার অবলম্বন, অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাস থেকে সৃষ্টি করলেন নান্দনিক সব ভাস্কর্য। কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান অনবদ্য সেই সব সৃষ্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ও শিল্পী হিসেবে প্রিয়ভাষিণীকে পরিচিত করতে উদ্যোগী হন।

মূলত কুড়িয়ে পাওয়া ও পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়ি, শুকনো ডাল, বাঁশ, পানিতে ভেসে আসা কাঠের খণ্ড ও গাছে জন্য নেয়া ছত্রাক ইত্যাদি ছিল ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য তৈরির উপকরণ ও মাধ্যম।

তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে শিল্পানুরাগীদের কাছে সমাদৃত এ ভাস্কর্যগুলো কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয়, এ শিল্পকর্মের সাথে জড়িয়ে আছে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত একজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা নারীর আগুনপাখি ফিনিক্স হয়ে ওঠার গল্প।

সরকারি ও বেসরকারি সকল জাদুঘর, সংগ্রহশালা থেকে সর্বোপরি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের ভাস্কর্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসা। এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ, সময়ের মহামূল্যবান নিদর্শন।

এসব সম্পদকে কেন্দ্র করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অসাধুতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক ও মহীয়সী মায়ের সন্তান হিসেবে আমি মনে করি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর রেখে যাওয়া অমূল্য ভাস্কর্যসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন- অভিনয়শিল্পী শম্পা রেজা, লেখক অ্যাকটিভিস্ট শারমিন শামস্, অ্যাকটিভিস্ট শাশ্বতী বিপ্লব ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহাদাত রাসেলসহ অনেকে।

(Feed Source: sunnews24x7.com)