ছোটপর্দা দিয়ে শুরু, নেতিবাচক চরিত্রে নজরকাড়া, ‘বহিরাগত’ হয়েও শাহরুখের বলিউড ‘কিং’ হয়ে ওঠার কাহিনি…

ছোটপর্দা দিয়ে শুরু, নেতিবাচক চরিত্রে নজরকাড়া, ‘বহিরাগত’ হয়েও শাহরুখের বলিউড ‘কিং’ হয়ে ওঠার কাহিনি…

নয়াদিল্লি: ‘বাদশাহ হো বাদশাহ্’…! ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan) ও ট্যুইঙ্কল খান্না (Twinkle Khan) অভিনীত ‘বাদশাহ্’ (Badshah) ছবিটি, যার জনপ্রিয় টাইটেল ট্র্যাক লিরিক্স যেন একেবারে কিং খানের জন্যই তৈরি হয়েছিল। তিনি বলিউডের সম্রাট, মহিলাদের হার্টথ্রব, তিনি ‘রোম্যান্টিক কিং’। কিন্তু এমন ‘লিভিং লেজেন্ড’ হওয়ার পথটা নেহাত মসৃণ ছিল না। শোনা যায়, বলিউডের শীর্ষে পৌঁছে রাজ্যপাট বিস্তারের অনেক আগে একবার মেরিন ড্রাইভের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বলেছিলেন, ‘একদিন আমি এই শহরে রাজত্ব করব।’ ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে, তিনি নিজেকে দেওয়া সেই কথা রেখেছেন, এমনটা বলাই যায়।

তাঁরই জনপ্রিয় সিনেমা ‘ওম শান্তি ওম’-এর জনপ্রিয় সংলাপ ধার করে বলতে হয়, ‘অগর কিসি চিজ কো দিল সে চাহো, তো পুরি কায়ানাত উসে তুমসে মিলানে কি কোশিশ মে লগ যাতি হ্যায়’। আর ঠিক এমনটাই হয়েছে। মনেপ্রাণে ‘বাদশাহ’ হতে চেয়েছিলেন, এখন তাঁকে ছাড়া বলিউড কেউ ভাবতেই পারেন না।

সুপারস্টার শাহরুখ খানের সাফল্যের কাহিনি

আজ, গোটা বিশ্বের মানুষ তাঁকে এক ডাকে চেনে। বিশ্বজুড়ে তাঁর অনুরাগীরা ২০২৩ সাল-জুড়ে তাঁকে উদযাপন করেছেন। দীর্ঘ ৪ বছরের বিরতির পর বড়পর্দায় ফেরেন তিনি ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ সালে, সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত ‘পাঠান’ ছবির হাত ধরে। প্রথম চারদিনেই যে ছবি বিশ্বজুড়ে ৪০০ কোটির ব্যবসা পার করে ফেলে, এবং তারপরে বাকিটা ইতিহাস। এমন ব্যবসা বলিউড তার আগে দেখেনি। একের পর এক রেকর্ড ভাঙে ‘পাঠান’। এরপর সেপ্টেম্বরে আসে ‘জওয়ান’। নিজের ছবির রেকর্ড নিজেই ভাঙেন। অ্যাটলি পরিচালিত এই ছবি আরও বিপুল ব্যবসা করে। এরপর বছর শেষে মুক্তি পায় রাজকুমার হিরানি পরিচালিত ‘ডাঙ্কি’। একই বছরে পরপর তিনটে ব্লকবাস্টার রেকর্ড ভাঙা হিট ছবি বলিউডে বোধ হয় কেউই দেননি। তিনি যে বলিউডের বাদশাহ হবেন, তা তো বলাই বাহুল্য।

যাঁরা বিনোদন দুনিয়ার খোঁজ রাখেন, তাঁরা ‘স্বজনপোষণ’ বা ‘নেপোটিজম’ শব্দটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। অর্থাৎ যাঁদের পরিবারের কেউ ইতিমধ্যেই ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন, তাঁদের পক্ষে নিজেদের প্রথম স্থান খুঁজে পাওয়া অনেকটা সহজ হয়, বা তাঁরাই অগ্রাধিকার পান বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয়, বলিউডের এই ‘কিং’ কিন্তু একেবারেই ‘আউটসাইডার’ বা যাকে বলে ‘বহিরাগত’। জানেন কি এই বহিরাগত কীভাবে তাঁর প্রথম প্রজেক্ট পেয়েছিলেন?

শাহরুখ খানের প্রথম প্রজেক্ট ছিল টিভি শো ‘ফৌজি’ যা দেখানো হত ‘দূরদর্শন’ চ্যানেলে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাজ কুমার কপূর, যিনি এই শো তৈরি করেছিলেন একবার জানিয়েছিলেন যে শাহরুখ কীভাবে কাস্টে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি কমান্ডো খুঁজছিলাম এবং ও (শাহরুখ খান) একদিন আমার অফিসে এসে হাজির হয়। আমি ওর দিকে একবার তাকাই এবং জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কম্যান্ডো হবে?’ ও বলে, ‘হ্যাঁ, স্যার। আমি চরিত্রটা খুব সুন্দর করব’।’ কিন্তু তিনি কেবল ভাল অভিনয় ছাড়া আরও কিছু খুঁজছিলেন। তিনি বলে চলেন, ‘আমি ওর মুখের দিকে তাকাই এবং প্রথম আমার নজরে পড়ে ওর নখ আর গালে কিছু একটা করেছে, খানিকটা গর্ত মতো করেছিল। আমি ভেবেছিলাম এই চরিত্রটার জন্যই সেটা ও করেছে।’ যে অভিনেতাদের নাম শর্টলিস্ট করা হয়, সেখানে শাহরুখের নাম ছিল, এবং তাঁদের আরও একটা কাজ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি ওই ছেলেদের দৌড় করাতে নিয়ে যাই, আট বা নয় জন ছেলে ছিল। আমি বেশ অবাক হই যে ও (শাহরুখ খান) টিকে গেল কিন্তু অর্ধেক ছেলে শুরু করলেও দৌড়ে ফেরৎ আসেনি।’

‘আমি ওকে প্ররোচিত করি আমাকে মারার জন্য এবং অবশেষে করেও সেটা। ওর আগ্রাসী মনোভাবের আভাস পাই। এই উপস্থিতি ক্যামেরা খুব ভালবাসে। আমার অভিমন্যু রাইয়ের জন্ম হয়, যদিও সত্যি কথা বলতে গেলে আমি ওকে ওই চরিত্রের জন্য ভাবিনি।’

শাহরুখের কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা, চেষ্টা তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। এরপর তিনি ‘সার্কাস’-এ অভিনয় করেন। ‘উমিদ’ ও ‘ওয়াগলে কি দুনিয়া’য় ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু ফের সব ওলটপালট হয়ে গেল যখন তিনি মাকে হারালেন। ডায়াবেটিস থেকে জটিলতা তৈরি হয় মাকে হারান এসআরকে। তবে নিজের নিষ্ঠা ও জেদ ধরে রেখে বলিউডে টিকে যান তিনি।

বলিউডে যাত্রা শুরু…

১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ ছবির হাত ধরে বলিউডে ডেবিউ করেন শাহরুখ খান। শুরু হয় রাজার রাজ্যপাট তৈরির কাজ। বাদশাহ্ নিজেই একবার বলেন, ‘আমি যখন দিল্লি থেকে আসি, আমার কোনও পরিবার ছিল না। আমার কেউ ছিল না এবং এটা আমি সকলকে বলি যে সকল চিত্রপরিচালকের মধ্যে, প্রথম সারির অভিনেত্রীদের মধ্যে, বা সকল প্রযোজকদের মধ্যে আমার বিস্তীর্ণ পরিবার আছে, এবং আমার সফরের সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু বন্ধু আমি বানিয়েছি।’

এরপর তিনি ‘রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান’ ও ‘চমৎকার’ ছবি করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি এমন কাজ করেন যা কেউই আশা করেননি। তিনি পরপর দুটি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন, ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’। এই দুটি চরিত্রের প্রস্তাবই যথাক্রমে আমির খান ও সলমন খান ফিরিয়ে দেন। এবং এই দুটি ছবি শাহরুখ খানের জীবন বদলে দেয়। এই দুই চরিত্র কেবল দর্শককে তাঁকে ‘নজর’ করতে বাধ্য করে তাই নয়, সেই সঙ্গে একাধিক পুরস্কার ও মনও জয় করেন তিনি। এছাড়া ‘অনজাম’ ও ‘কভি হাঁ কভি না’ তাঁর আরও দুটি বহু প্রশংসিত সিনেমা। এরপর ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘ইয়েস বস’, ‘পরদেশ’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’… অগুন্তি ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তৈরি করেন। তাঁর কাজ তাঁকে ‘কিং অফ বলিউড’ তকমা এনে দেয়।

সেই সময়ে যশ চোপড়া ও শাহরুখ খান ছিল ‘হিট জুটি’। ২০০০-এর সময়ে শাহরুখ খান অজস্র প্রজেক্টে কাজ করেছেন, সবকটি ব্লকবাস্টার ছিল না, তবে সেগুলি বেশ উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে – ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’, ‘বাদশাহ’ ও ‘অশোকা’ তার মধ্যে অন্যতম। ‘কাল হো না হো’, ‘চলতে চলতে’, ‘কভি খুশি কভি গম’, ‘দেবদাস’, ‘মহব্বতেঁ’র মতো হিট ছবি দেওয়ার পর তিনি প্রযোজনা সংস্থা খোলেন নিজের। ‘রেড চিলিজ এন্টারটেনমেন্ট লিমিটেড’। ‘বীর জারা’ ও ‘ম্যায় হুঁ না’ তাঁর সংস্থার ব্যানারে মুক্তি পাওয়া দুটি হিট ছবি।

এছাড়া তিনি একের পর এক চরিত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছেন। ‘স্বদেশ’, ‘চক দে ইন্ডিয়া’, ‘রব নে বনা দি জোড়ি’, নিজেকে বারবার ভেঙেছেন কিং। এরপরের দশকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’, ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’, ‘ডন ২’, ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘দিলওয়ালে’, ‘যব তক হ্যায় জান’ ছবির মতো হিট উপহার দেন তিনি। এরপর বেশ কয়েক বছর কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যান তিনি। ‘ফ্যান’, ‘জিরো’ বা ‘যব হ্যারি মেট সেজল’-এর মতো ছবিগুলি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং দর্শক প্রশ্ন করতে শুরু করেন, ‘তাহলে কি রাজ্যপাট শেষ হয়ে এল?’

এরপর কাজে বিরতি নেন শাহরুখ। কেবল কর্মজীবন নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাঁর। ২০২১ সালের অক্টোবরে মাদককাণ্ডে গ্রেফতার হন কিং পুত্র আরিয়ান খান। তবে শেষ পর্যন্ত ক্লিন চিটও পান তারকা পুত্র। শিরোনামে উঠে আসেন তাঁরা। এরপর ২০২৩ সালে বড়পর্দায় ‘কামব্যাক’ করেন শাহরুখ, ৫৭ বছর বয়সে প্রমাণ করেন, ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত…’।

(Feed Source: abplive.com)