অ্যানিমেশন ছবি ‘রামায়ণ’-এর সঙ্গে মোদির সাম্প্রতিক জাপান সফরের গভীর যোগ! জানুন

অ্যানিমেশন ছবি ‘রামায়ণ’-এর সঙ্গে মোদির সাম্প্রতিক জাপান সফরের গভীর যোগ! জানুন

#নয়াদিল্লি: মনে পড়ে, ১৯৯৩-এর সেই অ্যানিমেশন ফিল্ম রামায়ণের (Anime film on Ramayana) কথা? তার সঙ্গেই না কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) সাম্প্রতিক জাপান সফরের গভীর যোগ রয়েছে! ‘মন কি বাত’ (Mann ki Baat)-এ সেই যোগের কথাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন খোদ মোদি।

সম্প্রতি কোয়াড বৈঠকে যোগ দিতে জাপানে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণ করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এই জাপান সফরের কথা বলতে গিয়েই ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে তিনি উল্লেখ করেছেন ১৯৯৩ সালের অ্যানিমেশন ফিল্ম – ‘রামায়ণ দ্য লেজেন্ড অফ প্রিন্স রাম’-এর। প্রায় তিরিশ বছর আগে এই অ্যানিমেশন ছবি তৈরি হয়েছিল মূলত হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের উপর ভিত্তি করে। আর এই ছবির সহ-প্রযোজনার দায়িত্বে ছিল জাপান এবং ভারত। ছবির পরিচালক এবং প্রযোজক ছিলেন ইয়ুগো সাকো (Yugo Sako)। সরাসরি মহাকাব্যের গল্পের উপর আধারিত এই ছবিতে মিশেছিল কল্পনাও, ছিল হিন্দু দেব-দেবীদের ঐশ্বরিক বর্ণনাও। কিন্তু সেই রামায়ণের সঙ্গে মোদির জাপান সফরের যোগটা ঠিক কীভাবে?

৮৯-তম ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মোদি উল্লেখ করেছেন আতসুশি মাতসুও (Atsushi Matsuo) এবং কেনজি ইয়োশি (Kenji Yoshi)-র সঙ্গে বৈঠকের কথা। এঁরা দু’জনেই জাপানের টেম প্রোডাকশন কোম্পানি (Tem Production Company)-র সঙ্গে যুক্ত। ব্যাপারটা আরও ভেঙে বুঝিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসলে এই সংস্থার সঙ্গেই যোগ রয়েছে জাপানি অ্যানিমেশন ছবি রামায়ণের। যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৩ সালে। আর এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাপানের বিখ্যাত চিত্র পরিচালক ইয়ুগো সাকো। যিনি প্রায় চল্লিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে প্রথম রামায়ণের কথা জানতে পেরেছিলেন।” নিপ্পন রামায়ণ ফিল্ম কোম্পানি লিমিটেড নামে আর একটি প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে মিলে ওই জাপানি অ্যানিমেশন ছবিটি তৈরির সময় আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছিল টেম সংস্থা।

আর এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সঙ্গে দারুণ একটা খবরও ভক্তদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ৩০ বছর পর পুনরায় ৪কে রেজোলিউশনে এই ছবিটি তৈরি হচ্ছে। আর খুব শীঘ্রই এই প্রজেক্টের কাজ শেষ হবে।

এই ছবির মাধ্যমে আসলে হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের প্রশস্ত নৈতিক ধারণাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। আর এই ছবিকে অ্যানিমেশনের রূপ দেওয়ায় তা নতুন প্রজন্মের কাছে আরও আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে। রামায়ণের গল্প কীভাবে জাপানি অ্যানিমেশন ফিল্মের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল, সেই বিষয়েই আলোকপাত করেছে নিউজ ১৮ (News18)।

জাপানি পরিচালকের নতুন আগ্রহ থেকেই জন্ম নিল রামায়ণ:

প্রায় চল্লিশ বছর আগে অর্থাৎ সেই ১৯৮৪ সালে হিন্দু কিংবদন্তী রামায়ণের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে জাপানি পরিচালক এবং প্রযোজক ইয়ুগো সাকোর। আর সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাঁর আগ্রহটা। নরেন্দ্র মোদি বলেন, “জাপানি পরিচালকের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল রামায়ণ। আর তার পরেই তিনি এটা নিয়ে গভীর ভাবে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনি আরও গবেষণার খাতিরে জাপানি ভাষায় রামায়ণের প্রায় ১০টি সংস্করণ আত্মস্থ করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়। আর এই গল্পটাকেই তিনি অ্যানিমেশন মোড়কে ধরতে চেয়েছিলেন। আর এর জন্য তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতের অ্যানিমেটররা। ওই ছবিটি বানানোর সময় আমাদের দেশের অ্যানিমেটররা মূলত ভারতীয় রীতি-নিয়ম এবং ঐতিহ্যের বিষয়ে বুঝতে সাহায্য করেছিলেন জাপানি পরিচালককে।”

প্রাথমিক ভাবে ইয়ুগো সাকো ভারতে এসেছিলেন ‘দ্য রামায়ণ রেলিকস’ নামে একটি তথ্যচিত্রের কাজে। বিলিফনেট (Beliefnet)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, অযোধ্যার কাছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের উপর ওই তথ্যচিত্র বানানো হচ্ছিল। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুবরাজ রামের জয়ের কাহিনি সেই সময় মুগ্ধ করেছিল ওই জাপানি পরিচালককে। ওই মহাকাব্য নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে তিনি ধীরে ধীরে অনুভব করেন যে, এটা কোনও প্রচলিত ধারণা নয়, বরং তার থেকে অনেকটাই বেশি। এর মধ্যে পাওয়া যাবে মানবজীবনের দর্শন ও জীবনবোধও। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে ইতিহাসও।

এখানেই থেমে থাকেননি ইয়ুগো। জাপানি ভাষায় তিনি বাল্মীকির রামায়ণের ১০টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণও পড়ে ফেলেছিলেন। এত দিন তথ্যচিত্র পরিচালনার কাজ করলেও রামায়ণ পড়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, অ্যানিমেশনই হচ্ছে একমাত্র উপায়। আসলে অ্যানিমেশনের মাধ্যমেই রামায়ণের রাজকীয়তা এবং জাঁকজমক সঠিক ভাবে বর্ণনা করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে ওই রিপোর্টটিতে পেশ করা হয়েছে পরিচালকের বক্তব্যও। ইয়ুগো বলেছিলেন, “কারণ রাম হলেন ভগবান। আমার অনুভব, তাঁকে বর্ণনা করার সবথেকে ভালো উপায় হল অ্যানিমেশন। আসলে এক্ষেত্রে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, কোনও অভিনেতাকে দিয়ে রামের চরিত্রটি না-করিয়ে বরং অ্যানিমেশনের মাধ্যমেই রামের চরিত্রটি তৈরি করা ভালো।”

এই অ্যানিমেশন ছবি তৈরির ভাবনা মাথায় আসার পর কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন বর্ণনা নিয়েও গবেষণা করেন। শুধু তা-ই নয়, পোশাক-আশাক এবং স্থাপত্যগত দিক নিয়েও পড়াশোনা করেছিলেন। এছাড়া একাধিক ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিকের সঙ্গেও কথাবার্তা বলেছিলেন ইয়ুগো। আসলে এই মহাকাব্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার লক্ষ্যে এক জন বিদেশি হিসেবে একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিল ওই জাপানি পরিচালককে।

এর পরে ভারতীয় অ্যানিমেটরদের ভূমিকা প্রসঙ্গে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মোদি বলেন, ভারতীয় অ্যানিমেটররাও ওই পরিচালককে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। ছবিতে ভারতীয় সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ, ঐতিহ্য – এসব দিক তুলে ধরা হয়েছিল, আর এই বিষয়গুলিতেই জাপানি পরিচালককে সাহায্য করেছিলেন আমাদের দেশের অ্যানিমেটররা। ভারতীয় পোশাক শাড়ি, ধুতি কীভাবে পরতে হয়, অথবা কীভাবে ভারতীয়রা চুল আঁচড়ান- এই সব খুঁটিনাটিও ইয়ুগোকে বুঝিয়েছিলেন ভারতের অ্যানিমেটররা। এছাড়াও বড়দের কিংবা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি ছোটদের ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভারতীয়দের আশীর্বাদ নেওয়া, অভিনন্দন জানানোর ধরন এবং ভোরে ওঠার রীতির মতো বিষয়গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়েছিল জাপানি পরিচালককে।

বিলিফনেট-এর ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই ছবির শিল্প নির্দেশনার নকশা সাজানো হয়েছিল ভারতের প্রখ্যাত অ্যানিমেশন শিল্পী রাম মোহনের (Ram Mohan) তত্ত্বাবধানে। ১৯৯০ সালে জাপানেই ইয়ুগো সাকো মূল অ্যানিমেশনের প্রোডাকশন শুরু করে দেন। আর এই বিপুল কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল প্রায় সাড়ে চারশো জন শিল্পীকে। ১৯৯৩ সালে এই প্রজেক্টে যোগ দিয়েছিলেন হলিউড ইন্ড্রাস্ট্রির বর্ষীয়ান পরিচালক কৃষ্ণ শাহ (Krishna Shah)। তাঁর মতে আবার, রামায়ণ (The Ramayana) এবং স্টার ওয়ারস্ (Star Wars) – এই দুই ছবিরই মিল রয়েছে। শাহ মনে করেন, এই দু’টো গল্পই নীতি-শিক্ষার উপর আধারিত। এমনকী এর মধ্যে দারুণ সাদৃশ্যও রয়েছে। বর্ষীয়ান এই পরিচালকের দাবি, “স্টার ওয়ারস্ ছবির লিউক স্কাইওয়াকার (Luke Skywalker) চরিত্রটির অনুপ্রেরণা এসেছে রামের থেকেই। আবার সেখানে ডার্থ ভেডার (Darth Vader) চরিত্রটির অনুপ্রেরণা এসেছে রাবণের থেকে। এছাড়া চিউবাকা (Chewbacca) যেন হনুমানেরই আর এক রূপ!”

নিজের জীবনের জন্যই ইয়ুগো সাকো এই মহাকাব্যের প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিলেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, শৈশব কাল থেকেই পরিচালক ইয়ুগো সাকোকে অনুপ্রেরণা জোগাত ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা। ১৯২৮ সালে মধ্য জাপানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সাকো। আর মাত্র তিন বছর বয়সেই মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়েছিলেন তিনি। জেন বৌদ্ধ মন্দিরের (Zen Buddhist temple) সন্ন্যাসীদের কাছেই বেড়ে উঠেছিলেন সাকো। ভবিষ্যতে পুরোহিত হওয়ারই কথা ছিল তাঁর, আর সেই প্রশিক্ষণই চলছিল। স্মৃতি হাতড়ে সাকো জানিয়েছিলেন, স্থানীয় তরুণদের ধর্ম সংক্রান্ত পাঠ দেওয়া হত। সেখানেই যোগ দিতেন সাকো। আর তিনি বুদ্ধের জীবনী বর্ণিত কার্ড সংগ্রহ করতে ভালবাসতেন। এই প্রসঙ্গে সাকোর বক্তব্য, “আর সেই সময়ই প্রথম বার আমি বুদ্ধ এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে পরিচিত হই।” তিনি কলেজে বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ের উপর পড়াশোনা করেছিলেন। এর পর তিনি হেইরিনজি জেন মন্দিরে (Heirinji Zen Temple) সন্ন্যাসী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেন যে, এই পেশা তাঁর জন্য নয়। এরপর তিনি সন্ন্যাস ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন এবং অবশেষে টোকিও সিনে ভিশন লিমিটেড (Tokyo Cine Vision Ltd) প্রতিষ্ঠা করেন। আর এখান থেকেই তৈরি হত নানা মিউজিক অ্যালবাম এবং টিভির তথ্যচিত্র।

এই মহাকাব্যের অ্যানিমেশনের স্টাইলটা ঠিক কী ছিল?

কিছু রিভিউ অনুসারে, রামায়ণের অ্যানিমেশন ছবিতে মাঙ্গা, দ্য জাপানীজ স্কুল অফ অ্যানিমেশনের (Manga, the Japanese school of animation) কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে তাতে ব্যবহৃত হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় হাতে আঁকা ছবিও। আর এখানেই সাহায্য করেছিলেন রাম মোহন। এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে খ্যাতনামা অ্যানিমেটর হায়াও মিয়াজাকি (স্টুডিও ঘিবলির সঙ্গে যুক্ত), কাতসুহিরো ওতোমো (আকিরা) এবং ইসাও তাকাহাটা (গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইজ)-র শৈলীরও।

Published by:Piya Banerjee

(Source: news18.com)