কলকাতা: বাংলা বলায় অবাঙালি টান। বড় হওয়া দিল্লিতে। তাও শিকড়ের সঙ্গে যে সুতো আজও ছেঁড়েনি, তার প্রমাণ পরতে পরতে। রাজনৈতিক ছবি বানানো, ইরফানের সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে অকপট আড্ডা দিলেন বলিউডের পরিচালক সুজিত সরকার। শুনলেন নিউজ ১৮ বাংলার তিস্তা রায় বর্মণ।
সদ্যই ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ মেলবোর্নে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারক হিসেবে দেখা যাবে বাঙালি পরিচালককে। ২০২২ সালে এই চলচ্চিত্র উৎসবেই ‘সর্দার উধাম’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন সুজিত।
প্রশ্ন: দিল্লিতে বড় হয়েছেন। তাও তো বাঙালি। বাংলায় ছবি বানান না কেন?
সুজিত: বাংলার জন্য আমি এখনও প্রস্তুত কি? আমার মনে হয় না। বাঙালি হলেও যেহেতু আমি দিল্লিতে বড় হয়েছি, তাই ভাষায় দখলটা অত ভাল নয় আমার। তাই ছবি বানানো নিয়ে এখনই ভাবতে পারছি না।
প্রশ্ন: বাংলা ছবির প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত আছেন, কিন্তু পরিচালনা…
সুজিত: প্রযোজনার সঙ্গে এই জন্যই যুক্ত হয়েছি, কারণ আমি বাংলায় পোক্ত হতে চাই। প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছি। বাংলাকে বোঝার চেষ্টা করছি আরও ভাল করে। বাইরে বড় হওয়ার কারণে বাংলার সঙ্গে যোগাযোগটা কম ছিল। কিন্তু গত ১০ বছর আবার বাংলার কাছাকাছি এসেছি। বানাব, বাংলা ছবি নিশ্চয়ই বানাব।
প্রশ্ন: আর বাংলা ছবি দেখা?
সুজিত: শেষ দু’বছরে আমি দু’টিই বাংলা ছবি দেখেছি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নগরকীর্তন। অনীক দত্তের অপরাজিত। বেশ ভাল লেগেছিল। দু’জনকেই জানিয়েছিলাম আমি।
প্রশ্ন: এখন তো বাংলা ছবির মান নিয়ে নানা ধরনের তর্কবিতর্ক চলে…
সুজিত: হ্যাঁ অনুরাগ কাশ্যপের মন্তব্যের পর আমার কাছ থেকে অনেকেই জানতে চেয়েছিল বাঙালি পরিচালক হয়ে আমি কী ভাবি না ভাবি। মনে আছে। আমি আসলে শেষ যাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম, তিনি ঋতুদা (ঋতুপর্ণ ঘোষ)। অন্যতম সেরা পরিচালকদের একজন। এখন ঋতুদা নেই। তাঁকে মিস করি। গোটা বিশ্বে পৌঁছতে পেরেছিলেন তিনি। নির্মাতা হিসেবে যে দাপট তাঁর ছিল, তা বিরল।
প্রশ্ন: অনুরাগ কাশ্যপের কথা বললেনই যখন, তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে কি সহমত?
সুজিত: আমি সত্যি বলতে, ছবি খুব কম দেখি। শুধু বাংলা নয়, বলিউড সিনেমাও। তাই আমার বলা মানায় না। অনুরাগ এরকম ভাবে কিছু মন্তব্য করে দেয় ঠিকই, কিন্তু কোথাও না কোথাও তো এটা সত্যি। আগে বাংলা ছবি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দি ছবি বানাতেন লোকে। আমার এটা বলা উচিত নয়, কারণ আমি নিজে একজন বাঙালি। বাংলা ছবির উপর গর্ব হওয়া উচিত আমার… (খানিক ভেবে) আমি আরও ছবি দেখতে চাই। ভাল ভাল কাজ দেখব। আমার মনে আছে ‘ফড়িং’-এর কথা। কী দুর্দান্ত একটা ছবি। সবাইকে বলছি, ‘ফড়িং দেখো, সবাই দেখো’, চেষ্টা করেছিলাম ছবিটাকে আর একটু ছড়িয়ে দিতে। তো এরকম কিছু সিনেমা আরও দেখতে চাই।
প্রশ্ন: আপনার পরবর্তী ছবি নিয়ে জানতে চাই। অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে কাজ করছেন। ‘পিকু’র পর ফের বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে…
সুজিত: (হেসে) এটা নিয়ে কথা বলার সময় আসেনি। সঠিক সময়ে সব বলব। আলাদা করে এই ছবি নিয়েই কথা বলব।
প্রশ্ন: ‘মাদ্রাস কাফে’ হোক বা ‘সর্দার উধাম’, এরকম রাজনৈতিক ছবি নিশ্চয়ই আরও বানাবেন।
সুজিত: অবশ্যই। তবে রাজনৈতিক বলতে, আমি সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাই না আমার ছবিতে। আমি গল্প বলব। যে যেভাবে দেখবে, সেটা তাঁর নিজস্ব মতামত।
প্রশ্ন: সরাসরি রাজনৈতিক ছবি বানালে সেন্সর বোর্ডে পাশ করানোর ভয় থাকে?
সুজিত: কোন সরকার কোন ছবি আটকাচ্ছে, কোন ছবি পাশ করাচ্ছে, এটা নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। আমার কাজ ছবি বানানো। আমি বানাব। তারপর আটকে দিলে আদালত আছে। আমি যদি এই সময়ে ‘সর্দার উধাম’ বানাতে পারি, তাহলে সব সময়েই সব ছবি বানানো যায়। সমস্যা তখনই আসে, যখন পরিচালক সরাসরি কোনও বার্তা দিতে চান।
প্রশ্ন: সরাসরি বার্তা না দিলেও পরিচালকের উদ্দেশ্যটা কি প্রকাশ পায় না?
সুজিত: সেটা ছবি দেখার উপর নির্ভর করে। আমি ওরকম ছবি দেখব কি দেখব না, সেটা আমার উপর। এই পরিচালককে দেখে মনে হয়, হ্যাঁ ইনি নিরপেক্ষ, তাঁর ছবি আমি দেখব। হলিউডের উইলিয়াম অলিভার স্টোনের ছবি দেখে আমার মনে হয়েছে, উনি যেভাবে ব্যালেন্স করেছিলেন, সেটা খুব সঠিক। তারপর যে যেভাবে নেবে, তার ব্যাপার।
প্রশ্ন: আপনি নিজে কি নিরপেক্ষ থাকতে পছন্দ করেন ছবি বানানোর ক্ষেত্রে নাকি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে চান?
সুজিত: অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে চাই। বার্তা দেব কেন? একটা উদাহরণ দিই, আমার ‘মাদ্রাস কাফে’ ছবিতে তামিলনাড়ু, শ্রীলঙ্কা, একাধিক অঞ্চলের রাজনীতির কথা বলা হয়েছে। এমন তো কিছু নেই, যেটা আমি বলছি না আমার ছবিতে। সবটা প্রোজেক্ট করা হয়েছে। এরপর দর্শকের ব্যাপার।
প্রশ্ন: ‘সর্দার উধাম’-এও তো তাই…
সুজিত: একদমই। আমাকে ইতিহাসটা বলতে হত। সবটা। অনেকে আমাকে বলেছে, ‘সর্দার উধামের কথা জানতাম না আমরা, আপনার ছবি দেখে জেনেছি।’ কেউ আবার বলেছে যেভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগের দৃশ্যের সত্যটা তুলে ধরেছি, তাতে নাকি অসুবিধা হয়েছে অনেকের। দেখতে পারেনি অনেকে। আমি বলি, ‘তুমি এই সত্যটা দেখতে পারছ না। আর টিকিট কেটে আনন্দ করে একটা সিনেমার মধ্যে অকারণ রক্তারক্তি দেখতে পাচ্ছ।’
‘সর্দার উধাম’-এর দৃশ্য
প্রশ্ন: আপনি কি কোনও ভাবে ‘অ্যানিমাল’-এর কথা বলতে চাইলেন?
সুজিত: না না, আমি দেখিইনি। আমি সত্যিই তেমন সিনেমা দেখি না। খুব বেছে বেছে দেখি। ‘অ্যানিমাল’-এর ট্রেলার দেখেছিলাম…
প্রশ্ন: (হেসে) গোটা সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করেনি আর?
সুজিত: (খানিক ভেবে) না, মানে আমার দেখার মতো ছবি নয় আর কি।
প্রশ্ন: আপনার ‘পিকু’ ছবিটা বাঙালিদের বড়ই প্রিয়। দীপিকা-ইরফানের মতো ছকভাঙা জুটির কথা মাথায় এল কীভাবে?
সুজিত: ইরফান আমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিল। আমায় জানায় সে কথা। ‘পিকু’ লেখার পর ইরফানকে বলি, ‘এই হল চরিত্র, খুব যে বেশি কিছু করার আছে, তা নয়। কেবল অভিনয় দিয়েই সবটা।’ ইরফান রাজি। এরপর দীপিকাকে নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না আমরা। কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইত দীপিকা। তা ছাড়া ইরফানের সঙ্গে অভিনয় শুনে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে দীপিকা। দীপিকাও রাজি। স্ক্রিপট রিডিং হয়। রিডিং শেষ হতে না হতেই দু’জনে রাজি। ইরফান খুব বেশি প্রেমের ছবি করেনি, আর দীপিকা অভিনেতাদের সঙ্গে কম কাজ করেছিল, তারকাদের সঙ্গেই বেশি করেছিল। দু’জনের জন্যই নতুন ছিল।
‘পিকু’ ছবির দৃশ্য
প্রশ্ন: অসম্ভব সুন্দর রসায়ন ইরফান-দীপিকার, আর দর্শকেরা তো ইরফান খানের প্রেমিক চোখ, প্রেমিক হাসিতেই মূর্ছা যায়… তাঁর সঙ্গে কাটানো কোন মুহূর্তগুলির কথা বেশি মনে পড়ে?
সুজিত: যখন অসুখের কথা জানতে পারে, তারপর থেকে আমার আর ইরফানের বন্ধুত্বটা অন্য মোড় নেয়। আমরা আর কাজের কথা বলতাম না। জীবন, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ নিয়েই কথা হত। ইরফানকে আমি রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, বিবেকানন্দের ১০-১৫টা বই দিয়েছিলাম পড়তে। রবীন্দ্রনাথ তো ও পড়তই আগে থেকে। ‘গোড়া’ ওর খুব প্রিয় একটি উপন্যাস। কিন্তু ওর অসুস্থ হওয়ার আগেও মনে আছে, মাঝেমধ্যে শুধু আড্ডা দিতে, চা খেতে আমার অফিসে চলে আসত। আসলে মুম্বইতে কেউ কারও সঙ্গে কফি খেতে চাইছে মানেই কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু ইরফানের বা আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকত না। শুধু গল্প করতে ভালবাসতাম আমরা। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, বাংলা সংস্কৃতি…
প্রশ্ন: জীবনের শেষবেলায় আপনি হাতটা ধরেছিলেন।
সুজিত: হ্যাঁ আমরা ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম। একসঙ্গে ধ্যান করতাম। যোগাসন করতাম দু’জনে মিলে বসে। আমরা সিনেমার কথা বেশি বলতাম না। আধ্যাত্মিক কথাই বেশি হত।
প্রশ্ন: আর অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
সুজিত: অমিতাভজির কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের সকলের। স্ক্রিপটের প্রতি ওঁর অগাধ শ্রদ্ধা। এক মুহূর্তও হাতছাড়া করেন না স্ক্রিপট।
প্রশ্ন: কলকাতার বাঙালির কাছে ‘পিকু’র অমিতাভ বচ্চন যেন সকলের চেনা, সবার পরিচিত।
সুজিত: হ্যাঁ, ওঁকে আমি বারবার উৎপল দত্তের কথা বলতাম। ওঁর রেফারেন্সে অভিনয় করতেন অমিতাভজি। আর তাঁর নিজের পছন্দের বাঙালি অভিনেতা হলেন রবি ঘোষ। সবসময়ে রবি ঘোষের গল্প বলেন। আর আমি খুব ভাগ্যবান, উনি আমার সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। তার ফলে আমার ছবি অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে পেরেছে। আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান।
প্রশ্ন: এবার আপনার ছবি তৈরি হোক পশ্চিমবঙ্গে।
সুজিত: (হেসে) নিশ্চয়ই। বাংলা ছবি বানাবই আমি। অবশ্যই চেষ্টা করব।
(Feed Source: news18.com)