যৌথ পরিবারের স্বাদ পাওয়া যায় তরুণ মজুমদারের ছবিতে
নব্বইয়ের দশক। যখন ধীরে ধীরে সাদা কালো থেকে আসতে শুরু করেছে রঙীন টিভি। যৌথ পরিবার মিলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে টিভিতে তখন ম্যাটিনি শো। তখন সন্ধ্যাবেলা বাংলা মেগা সিরিয়ালের চেয়েও নজর কাড়ত এই ম্যাটিনি শোগুলি। যাঁদের সিনেমা এই এই তালিকায় থাকত, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই অন্যতম বাঙালি পরিচালক তরুণ মজুমদার। সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল জমানার মধ্যে থেকেও বাংলা সিনেমার চিরতরুণ ছিলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর চিত্রনাট্য পরিবারকে এক করে রাখার অনুপ্রেরণা জোগায়।
সিনেমা তৈরির প্রতি ঝোঁক
১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ায় জন্ম তরুণ মজুমদারের। প্রায় ষাট বছরের দীর্ঘ কেরিয়ার তাঁর। ১৯৫৯ সালে ছবির জগতে পা রাখা। কাজ করেছেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কেমিস্ট্রির ছাত্র হলেও সিনেমা তৈরির প্রতি ঝোঁক ছিল বরাবরই।
১৯৫৯ থেকে ২০১৮ একাধিক হিট ছবি
তরুণ মজুমদারের প্রথম ছবি উত্তম-সুচিত্রার ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৫৯)। ১৯৬০ সালে বানালেন ‘স্মৃতি টুকু থাক’। ১৯৬২ সালে ‘কাঁচের স্বর্গ’ বানিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম এই পরিচালক। এই ছবির জন্যই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। চারটি জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন পরিচালক। এরপর ‘শ্রীমান পৃথ্বিরাজ’ (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), দাদার কীর্তি (১৯৮০), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৫), পরশমণি (১৯৮৮) একের পর এক হিট ছবি দিয়েছেন দর্শকদের। নয়ের দশকে এসে পরিচালক তৈরি করলেন ‘আপন আমার আপন’ এবং ২০০৩ সালে ‘আলো’। ‘চাঁদের বাড়ি’ তরুণ মজুমদার পরিচালিত শেষ ছবি। যেটি ২০১৮ সালে মুক্তি পায়।
চেনা গণ্ডির বাইরে বের হননি
তরুণ মজুমদারের কেরিয়ারের গ্রাফটা প্রায় একই। চেনা গণ্ডির বাইরে তিনি কোনওদিন বের হননি। বাঙালির খুব চেনা রঙ, গন্ধ, পরিবেশ, মানুষদের নিয়ে দিব্যি পাঁচ যুগ টিয়ে দিলেন। বাংলার সিনে-দর্শক কখনই তাঁকে বর্জন করতে পারেননি। ২০১৪ সালে পরিচালক প্রথম ধারাবাহিক তৈরি করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশননন্দিনী’। যদিও তা খুব বেশিদিন চলেনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর অন্তরে। সেইসময় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘হিট’ পরিচালক আক্ষরিক অর্থে তিনিই।
তরুণ মজুমদারের সিনেমায় দেখা অজানা–অচেনা গ্রাম
বারবার ঘরে ফেরার টান অনুভব হচ্ছে মজ্জায়। শাপলা শালুক ভরা টলটলে পুকুর। নারকেল গাছের সারি, বাঁশবন। মাঝে মাঝে রোদ ঢুকছে, মাঝে মাঝে ছায়া। খোড়া চালের বসতবাড়ির মাঝে মাঝে টিনের চাল। মাচায় লাউ ডাটা ঝুলছে। তাঁর ছবি দেখেই প্রথম জানা বাংলার বুকে ছড়ানো কত রঙের গ্রাম। পলাশবুনি, কীর্ণাহার, মন্দিরা, বাতাসপুর, খণ্ডগ্রাম, বাতিকর, খয়রাশোল। অযথা খ্যাতি বা প্রচারের আলোয় ছোটেননি কোনোদিন। বড় বড় ফিল্মি পার্টি চিরকাল এড়িয়ে গেছেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঢুকে সেই ঘরের মানুষদের কথাই বলবেন তিনি। পরিচালক পেরেছিলেন।