ড. ঈশ্বর গিলাডা: গত ৩০ মাস ধরে বিশ্ব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে কোভিড -১৯-এর ধাক্কায়। কোভিডের গ্রাসে বহু ক্ষতি হয়েছে ভারতেরও। কিন্তু, বিশ্বের অন্য় শক্তিশালী দেশগুলির তুলনায় অনেক ভালভাবে এই মহামারির মোকাবিলা করেছি আমরা। ভারতের এই লড়াই আন্তর্জাতিকস্তরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশংসিত হয়েছে, স্বীকৃতি পেয়েছে। তার জন্য় আমাদের গর্ব অনুভব করা উচিত। শুধু তাই নয়, কোভিডের সঙ্গে লড়াই করার জন্য ভারত একাধিক দেশকে সাহায্য করেছে। এখনও ভ্যাকসিন মৈত্রীর মাধ্যমে সেই সাহায্য করছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরপূর্তিতে এবং বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন, ভারত একের পর এক বাধা টপকেছে। একের পর এক সমস্যাকে সুযোগে পরিণত করেছে। গ্রহীতা থেকে দাতা হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছে। বিশ্বমঞ্চে ভারতের ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার অনেক আগে থেকেই ভারতের জেনেরিক ওষুধ এবং টিকা তৈরির ক্ষমতা বিশ্বের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার পরিকাঠামোর অন্যতম ভরসার জায়গা ছিল।
বিশ্বে মোট এইচআইভি (HIV) আক্রান্তের ৯২% এরও বেশি অংশ জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ গ্রহণ করছিলেন যা ভারতীয় ওষুধপ্রস্ততকারক সংস্থা তৈরি করেছিল। এছাড়াও আরও একাধিক লাইফসেভিং ওষুধ ও টিকার ক্ষেত্রেও এই কথাটি প্রযোজ্য। প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশ্বে যা টিকা নেওয়া হয় তার আশি শতাংশই ভারতে তৈরি এবং ভারত থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট (এসআইআই)-এর কথা। এটি বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারক হিসাবে স্বীকৃত। সম্প্রতি জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, মিসলসের (Measles) টিকায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সেরাম ইন্সটিটিউটের প্রধান সাইরাস পুনাওয়ালাকে ‘ডিন’ পদক প্রদান করেছে।
ভারত অন্য দেশগুলিকে বিভিন্ন রোগের সঙ্গে লড়ার জন্য সাহায্য করেছে। অন্য দেশগুলিও যাতে এইচআইভি, যক্ষ্মা এবং অন্য সংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধের জোগান পেতে পারে তার জন্য সাহায্য করেছিল। শুধু বিদেশের জন্যই নয়, ভারতীয় নাগরিকদের জন্যও একই কাজ করা হয়েছে। ভারতে এইচআইভি (পিএলএইচআইভি) সংক্রমিত প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ আজীবন এই ওষুধগুলির বিনামূল্যে সরবরাহ পাচ্ছেন। পাশাপাশি, সারা বিশ্বে এইচআইভি আক্রান্ত প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ভারতে তৈরি এই ওষুধগুলি গ্রহণ করে সুস্থ রয়েছেন।
কোভিড মহামারির জন্য বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, মানবিক সঙ্কটও দেখা গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতেও ভারতের ওষুধপ্রস্তুতকারক সংস্থা এবং টিকা নির্মাতারা লড়াই করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল। এই কাজের জন্য ধনী দেশগুলির সমালোচনাও শুনতে হয়েছে। শক্তিশালী বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক লবির তরফে কপি-ক্যাট বা টুকে কাজ করার মতো কথাও শুনতে হয়েছে। যখন ধনী দেশগুলি দিনের পর দিন নিজেদের জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে কোভিড টিকা জমাচ্ছিল, তখন ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আকারের টিকাকরণ প্রকল্প শুরু করে। তার সঙ্গেই বিশ্বের নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির পাশে টিকা নিয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। ভারত ১০১টি দেশে এবং UN-সংগঠন বা মঞ্চগুলিকে সব মিলিয়ে মোট ২৩.৯ কোটি টিকা পাঠিয়েছে। পাশাপাশি নিজের দেশের লোককেও টিকা দিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় সংস্থাগুলিও বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে ন্যায্য মূল্যে টিকা পাঠিয়েছে। হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে, বাংলায় যার অর্থ ‘একমাত্র একজন দুঃখী ব্যক্তিই আর একজনের দুঃখ-যন্ত্রণা বুঝতে পারবে। আর কেউ পারবে না।’ ভারতীয় টিকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। যখন ধনী দেশগুলি বিপুল পরিমাণ টিকা মজুত করে বসেছিল। পরে প্রবলভাবে সমালোচিত হয় তারা। এমনকী বহু পরিমাণ টিকা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার কারণে ফেলে দিতে হয়। যখন দেশের নাগরিকের তৃতীয় বা চতুর্থ ডোজ হয়ে গিয়েছে, তখন এভাবে টিকা জমিয়ে রেখে পরে ফেলে দেওয়া কি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না? যাঁরা প্রথম ডোজটিও পাননি তাঁদের কি দেওয়া যেত না টিকা? কানাডার জনসংখ্যা ৩.৬ কোটি, কিন্তু গত মাসে খবর ছিল যে এই দেশটি ১.৩৬ কোটি কোভিড -১৯ টিকার ডোজ ধ্বংস করেছে। কিন্তু মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির কথা ভাবেনি। যেখানে টিকাকরণের হার আমেরিকা এবং কানাডার তুলনায় অনেক কম।
ধনী দেশগুলির টিকা জাতীয়তাবাদ:
কোভিড ১৯ মহামারির প্রথম দিন থেকেই বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন এই মহামারি থেকে বেরনোর একমাত্র পথ হচ্ছে সম্পূর্ণ টিকাকরণ। অর্থাৎ, বিশ্বের সবাই এই টিকার কবচে থাকলে তবেই এই মহামারিকে হারানো যাবে। টিকাকরণ সম্পূর্ণ হলেই গুরুতর কোভিড রোগ, হাসপাতালে ভর্তি, আইসিইউতে ভর্তি, ভেন্টিলেটরে থাকা এবং অকাল মৃত্যু রোধ করা যেতে পারে। ধনী দেশগুলি তাঁদের নাগরিকদের বহুবার টিকা দিয়েছে। তিন থেকে পাঁচ বার পর্যন্ত। যেখানে বেশ কয়েকটি নিম্ন আয়ের দেশে এখনও ৪০ শতাংশ নাগরিক টিকার পুরো ডোজ পায়নি। ধনী দেশগুলিতে নিম্ন আয়ের দেশগুলির তুলনায় দশগুণ দ্রুত কোভিড -১৯ এর টিকাকরণ হয়েছে। এই ভয়ঙ্কর বৈষম্য থেকে স্পষ্ট টিকার বণ্টন কতটা অসম হয়েছে। সংখ্যায় দেখে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ৭ বিলিয়নেরও বেশি লোক রয়েছে বিশ্বে। ১২ বিলিয়ন টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সারা বিশ্বে প্রতি ১০০ জনের জন্য প্রায় ১৫২টি শট। ২০২২ সালের মে মাস, প্রথম কোভিড-১৯ টিকাকরণের পর থেকে প্রায় ১৮ মাস। সেই সময়েও ৬৮টি দেশ এখনও তাদের ৪০ শতাংশ নাগরিককে টিকার সম্পূর্ণ কবচে আনতে পারেনি। নিম্ন আয়ের দেশগুলির মাত্র ১৬% মানুষ অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন। বিশ্বব্যাপী, গড়ে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ স্বাস্থ্যকর্মী এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে এই হার অনেক কম ছিল।
নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলির লোকেরা কেবলমাত্র কম ভ্যাকসিন ডোজ পেয়েছে এমনই নয়। যা টিকা পেয়েছে সেটাও খুব দেরিতে পেয়েছে। অনেকসময় এমনও হয়েছে যে টিকাগুলি মেয়াদ ফুরনোর সময়ে এসে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (বিএমজে)-এর একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ, নাইজেরিয়া WHO-এর Covax সুবিধা (UN-WHO উদ্যোগ যা বিশ্বব্যাপী টিকার সুষ্ঠু এবং সুষম বণ্টনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে) থেকে ২.৬ মিলিয়ন ডোজ কোভিড-১৯ টিকা নিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এই টিকাগুলি – যার বেশিরভাগ ইউরোপ থেকে এসেছিল- তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখের কাছাকাছি ছিল। নাইজেরিয়া সময়মত ১.৫৩ মিলিয়ন ডোজ দিতে পারে। বাকিগুলি ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বিএমজে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, কেনিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা থেকে পাওয়া টিকাগুলি ধ্বংস করেছে। কারণ সেগুলি মেয়াদ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে এসে পৌঁছেছে।
আমরা ২০২১ সালে এটি স্পষ্টভাবে দেখেছি যে দেশগুলি (উদাহরণ ইজরায়েল) তাদের নাগরিকদের টিকার সম্পূর্ণ ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে ছিল, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি এবং আইসিইউ ভর্তি অনেক কম। তা সত্ত্বেও সমহারে টিকাকরণ বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলস্বরূপ, যখন করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দাপট শুরু হয়। তখন প্রাথমিকভাবে যাঁদের টিকাকরণ হয়নি, তাঁদের জন্য মহামারি হয়ে গিয়েছিল সেটি। মানুষের এই দুর্ভোগ, যন্ত্রণা এবং অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? ঠিক এই পরিস্থিতিতেই একবার ভাবুন যদি ভারত না থাকত।