ছৌ মুখোশ-পটচিত্র-শোলার কদমে সাজছে আড্ডা’র পুজো, বিলেতের মাটিতে জায়গা বাংলার লোকশিল্পের

ছৌ মুখোশ-পটচিত্র-শোলার কদমে সাজছে আড্ডা’র পুজো, বিলেতের মাটিতে জায়গা বাংলার লোকশিল্পের

কলকাতা: ছিলেন পাঁচ জন। অবসর সময়ে ফুটবল খেলে সময় কাটত। আর খুব বেশি হলে টুকটাক আড্ডা। বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য ওইটুকু সুযোগই পাওয়া যেত যে। এমনভাবেই একদিন একটা ক্লাব তৈরির কথা মাথায় আসে তাঁদের। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাঙালির জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আড্ডা। সেই নামেই লন্ডনের কাছেই স্লাউ শহরে গড়ে ওঠে আড্ডা ক্লাব। সময়টা ২০১২।  তারপর থেকে যতদিন গিয়েছে বেড়েছে তার বহর।

পুজোর শুরু:
আড্ডা আর ফুটবল তো বটেই। বাঙালি চেনার আরও একটা বিষয় হচ্ছে পুজো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ক্লাবের একদম প্রথম দিক তখন। ২০১৫ সালে আয়োজিত হল কালীপুজো। তারপরে ২০১৯ সালে প্রথমবারের জন্য় আড্ডা-UK-এর তরফে দুর্গাপুজো করা হয়েছিল। এই বছর, আড্ডা ক্লাবের দশ বছরপূর্তি, আর সেটা এবারের দুর্গাপুজোয় যোগ করেছে আরও একটি মাত্রা।

একটু অন্যরকম:
সাধারণত বিদেশে যত পুজো হয় তা হলঘর অথবা কোনও বাড়ির ভিতরে আয়োজিত হয়। এইদিক থেকে আড্ডা ক্লাবের একটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হয়েছে।  সংগঠনের এক সদস্য প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, স্লাউ ক্রিকেট ক্লাবের মাঠের পাশে খোলা জায়গায় প্যান্ডেল বেঁধে পুজো হয়। যদিও তা কলকাতা বা জেলার কোনও পুজো প্য়ান্ডেলের মতো নয়, একটু অন্যরকম। বিশাল আকারের তাঁবু তৈরি হয়। তার মধ্যেই হয় যাবতীয় আয়োজন। যেহেতু এই সময় বেশ ঠান্ডা পড়ে তাই হিটিং সিস্টেম চালু রেখে গরম রাখা হয় তাঁবু।

গত বছরের প্রতিমা

জাঁকজমকের পুজো:
সংগঠনের সদস্য ৩২টি পরিবার। তাঁরাই সবাই মিলে আয়োজন করেন এই পুজোর। যাবতীয় পরিকল্পনা, প্রতিমার ব্যবস্থা করা, পুজোর উপকরণ থেকে আর বাকি সবকিছুর ব্যবস্থা সদস্যরাই করে থাকেন। যাবতীয় নিয়ম মেনেই হয় পুজো। দুর্গার আরাধনায় ১০৮টি পদ্মের ব্যবস্থাও করা হয়। জোগাড় হয় সব উপকরণ। এবার প্রতিমায় থাকছে সাবেকি ধাঁচ। প্রতিমা বানিয়েছেন হাওড়ার শিল্পী গৌরব পাল। প্রতিমাটির উচ্চতা ১২ ফুট, পুরোপুরি ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা। সেপ্টেম্বরেই এসে গিয়েছে ওই প্রতিমা। এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ আড্ডা গেট অফ জয়। বাংলার নানা কোণার হস্তশিল্প দিয়ে সাজানো থাকে এটি। এর আগের বছর কাঠের পুতুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল গেট অফ জয়। এবার থাকছে আরও চমক। সংগঠনের সক্রিয় সদস্য এষা চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এবার আড্ডা গেট অফ জয়ে থাকছে পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ, শান্তিনিকেতনের শোলার কদমফুল, পিংলা নয়াগ্রামের পটচিত্রের সম্ভার, থাকছে সরার নিদর্শন। পাশাপাশি দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি থেকে বাঁশের মুখোশ এনে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে গেট অফ জয়। গোটা পরিকল্পনায় শিল্পী মানস আচার্য্য। আয়োজকরা জানাচ্ছেন, বাংলার শিল্পকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরতেই তাঁদের এই প্রচেষ্টা। আড্ডা স্লাউ ক্লাবের পুজো নাকি আদতে সেখানকার ম্যাডক্স স্কোয়ার। পুজোর প্রতিটা দিন অসংখ্য উৎসুক জনতা সেখানে আসেন। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবাসী বাঙালিরা থাকেন। তেমনই অন্য প্রদেশের প্রবাসী ভারতীয়রাও থাকেন। পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে ভিড় জমান অ-ভারতীয়রাও।

এই বছরের আড্ডা গেট অফ জয়
এই বছরের আড্ডা গেট অফ জয়

বিলেতে বাংলার মেলা:
যে কোনও উৎসবে মেলার একটা ভূমিকা থাকে। মেলা ছাড়া কোনও উৎসব যেন ঠিকমতো জমে না। আড্ডা’র পুজোর অন্যতম আকর্ষণও মেলা। উৎসবের সেই আমেজ বিলেতের মাটিতেও যাতে পাওয়া যায় তার জন্য আড্ডা’র সংগঠকরা মেলার আয়োজন করেন। সেখানে শাড়ি-গয়না থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস, পাওয়া যায় সবই। তবে মূল আকর্ষণ হল নানা স্বাদের খাবার। সংগঠনের সক্রিয় সদস্য নীলোৎপল মন্ডল জানাচ্ছেন, আড্ডা বিখ্যাত খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের জন্যই। চারজন ফুড ভেন্ডার তাদের পসরা নিয়ে থাকবেন। কলকাতার স্ট্রিট ফুড, বিরিয়ানি থেকে চাইনিজ নানা পদ, দক্ষিণ ভারতের নানা স্বাদের পদ থেকে উত্তর ভারতের জিভে জল আনা পদ- থাকছে সবই। মিলবে বাংলাদেশের বাছাই খাবারও। শুধু তাই নয়, খাস বিলেতের মাটিতে ব্রেকফাস্টের জন্য থাকছে  কচুরি-আলুরদম-জিলিপির কম্বিনেশনও।

নজরকাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান:
এই বছর আড্ডার দশ বছর পূর্তি। তাই গোটা বছর ধরে মোট দশটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে। তারই মধ্যে একটি দুর্গা পুজোও। দুর্গোৎসব ঘিরে আয়োজন-উদযাপন একটু হলেও বেশি মাত্রা পেয়েই থাকে। আড্ডার তরফে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হচ্ছে। সম্প্রতি পুজোর আগেই অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন প্রখ্যাত গায়ক-পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। এবার বিজয়ার অনুষ্ঠানও হচ্ছে নজরকাড়া। সেখানে থাকবেন গায়ক-পরিচালক অঞ্জন দত্ত, সঙ্গীত পরিচালক নীল দত্ত এবং স্বনামধন্য গিটার বাদক অমিত দত্ত।

হাতেগোনা কয়েকদিন মাত্র বাকি। তারপরেই পুজো, বাংলা গান, বাংলার খাবার আর চুটিয়ে বাংলায় আড্ডা। গমগম করবে স্লাউ ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ।

আরও পড়ুন: জার্মানির বুকে বাংলার সেরা উৎসব, সৌজন্যে বার্লিন সর্বজনীন