সত্য বনাম উত্তর সত্য! ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে বিতর্ক যে কারণে

সত্য বনাম উত্তর সত্য! ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে বিতর্ক যে কারণে

তিরুঅনন্তপুরম: মাঝে ঠিক এক বছরের ব্যবধান। আবারও সত্য বনাম উত্তর সত্যের লড়াই। নেপথ্যে আবারও সিনেমা। এক বছর আগে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক দানা বেধেছিল। এ বার বিতর্ক ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিকে ঘিরে (The Kerala Story)। অসত্য এবং বিকৃত তথ্যে ভর করে, বিশেষ উদ্যেশ্য চরিতার্থ করতে ছবিটি বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ। শান্তি এবং সম্প্রীতি রক্ষার্থে ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঘিরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে গোটা দেশে (The Kerala Story Controversy)।

ছবিটিকে নিষিদ্ধ করায় দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে মমতাকে। তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রচ্ছন্ন সমর্থক কিনা, এমন প্রশ্নও উস্কে দেওয়া হচ্ছে। তার মোকাবিলায় সত্য এবং উত্তর সত্যের ফারাক ব্যাখ্যার চেষ্টা চলছে তৃণমূল-সহ অবিজেপি শিবিরের তরফে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরাল হয়েই চলেছে। রাজনৈতিক আকচাআকচি ছাড়িয়ে আদালতে পৌঁছে গিয়েছে বিষয়টি। তবে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’কে ঘিরে বিতর্কের কারণ যথেষ্টই রয়েছে বলে মত  যুক্তিবাদী শিবিরের।

রাজনৈতিক আকচাআকচিতেই থেমে নেই, আদালতে পৌঁছেছে বিতর্ক

পরিচালক সুদীপ্ত সেনের প্রথম বাণিজ্যিক ছবি ‘দ্য  কেরালা স্টোরি’। ছবিটির একঝলক সামনে আসার পর থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। ছবির প্রেক্ষাপট পশ্চিম এশিয়ার কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন ISIS-কে ঘিরে। কেরল থেকে একদল মেয়ে কী ভাবে তাদের ফাঁকে পড়েন, ধর্মান্তরিত হয়ে আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে পৌঁছে যান এবং সর্বোপরি কী তাঁদের পরিণতি হয়, এই গল্পই বুনেছেন পরিচালক। কিন্তু সমস্যা বেধেছে ছবিতে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে।

আত্নজীবনীমূলক ছবির ক্ষেত্রেও বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকে একেবারে গোড়ায়, যেখানে সংশ্লিষ্ট ছবিকে সত্য ঘটনা নির্ভর বা সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এমন ছবিতে পরিচালক নিজের ভাবনা, কল্পনা এবং আবেগ মেশালে ছাড়পত্র পেয়ে যান। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিকেও সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি বলেই দেখিয়েছিলেন পরিচালক। কিন্তু ছবির ট্যাগলাইন দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যাতে বলা হয়, ‘আনকভারিং দ্য ট্রুথ দ্যাট ওয়াজ কেপ্ট হিডেন’। অর্থাৎ ধামাচাপা দেওয়া সত্য উদ্ঘাটন করার বার্তা দিয়েছেন পরিচালক।

এখানেই যাবতীয় গলদ। কারণ সত্য উদ্ঘাটনের কথা বলে ছবিটিকে চালানো হলেও, বাস্তবে ফারাক কয়েক যোজন। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন অভিনেত্রী আদাহ্ শর্মা। হিন্দু মলয়ালি নার্সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি, যিনি ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম গ্রহণ করেন, বাড়ি ছেড়ে গিয়ে ISIS-এ যোগ দেন এবং শেষ মেশ ঠাঁই হয় আফগানিস্তানের জেলে। ছবিতে দেখানো হয়েছে, কেরল থেকে ISIS-এর ফাঁদে পড়া ৩২ হাজার মেয়েদের হিন্দু এবং খ্রিস্টান মেয়ের মধ্যে সেই মেয়ে অন্যতম। আজও যাঁদের খোঁজ নেই।

গোড়াতেই এই ৩২ হাজার পরিসংখ্যানটি নিয়ে বিতর্ক বাধে। পরিচালক দাবি করেন, ২০১০ সালে কেরল সরকারের তরফে ওই পরিসংখ্যান মেলে। যদিও সরকার বা সংবাদমাধ্যমের কাছে তেমন কোনও রেকর্ড নেই। বরং ২০১০ সালের ২৪ জুলাই অধুনা বেআইনি ঘোষিত পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিতে গিয়ে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ভিএস অচ্যুতানন্দ দাবি করেন, আগামী ২০ বছরে কেরলকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত করাই লক্ষ্য় PFI-এর। তার জন্য টাকার বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করার পন্থা অবলম্বন করছে তারা। ২০১১ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চণ্ডী বিধানসভায় জানান, প্রত্যেক বছর ২৮০০ থেকে ৩২০০ মেয়েকে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে।  তবে দু’জনের কেউই ISIS-এর কোনও উল্লেখ করেননি।

পরিচালক কৌশিক, অচ্যুতানন্দ এবং চণ্ডীর সেই মন্তব্যকেই কি তাহলে সাম্প্রতিক অতীত বলে চালানোর চেষ্টা করছেন, প্রশ্ন ওঠে অবধারিত ভাবেই। জবাবে পরিচালক জানান, সময় এলেই প্রমাণ পেশ করবেন তিনি। কিন্তু সেই প্রমাণ আজও পেশ করেননি তিনি। এক সময় দাবি করেন, ওই সংখ্যা ধরে পরবর্তী ১০ বছরের হিসেব কষেই ৩২ হাজারে পৌঁছেছেন বলে জানান। বরং ছবির একঝলক সামনে আসার পর বিতর্ক বাধলে, কেরল থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ISIS-এ যোগ দেওয়া মেয়ের সংখ্যা ৩২ হাজারের বদলে একধাক্কায় তিনে নামিয়ে আনেন তিনি, তা নিজের দাবির সপক্ষে প্রমাণ দিতে না পেরেই। তাহলে ৩২ হাজার হিন্দু এবং খ্রিস্টান মেয়ে কেরল থেকে গায়েব বলে কোন যুক্তিতে দাবি করলেন পরিচালক, উঠছে প্রশ্ন।

ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কেরলে ধর্মান্তরণের ভয়াবহতা বলেই সেটিকে চালানো হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল থেকে সংগঠন, প্রত্যেকের তরফে বাড়তি উৎসাহও দেখা যাচ্ছে ছবিটিকে ঘিরে। জায়গায় জায়গায় ছবিটির স্ক্রিনিং হয়েছে। বিজেপি-র নেতা-মন্ত্রী, এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখেও ছবিটির প্রশংসা শোনা গিয়েছে।  ঘটনাচক্রে, ছবির পরিচালক কৌশিক গত বছর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়ার (IFFI)-এর অংশ ছিলেন, যার চেয়ারপার্সন ছিলেন ইজরায়েলি পরিচালক নাদভ ল্যাপিড। প্রকাশ্যে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটির গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি, প্রশ্ন তোলেন ছবিতে দেখানো ঘটনাবলীর সত্যতা নিয়ে।

সেই সময় কৌশিকই প্রথম নাদভের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র ‘ইন দ্য নেম অফ লাভ’ নিয়েও বিস্তর বিতর্ক হয়, যার বিষয় বস্তু ছিল ‘লভ জিহাদ’। সেই তথ্যচিত্রেরও বিষয় ছিল একই। কেরল থেকে ১৭ হাজার এবং ম্যাঙ্গালুরু থেকে ১৫ হাজার হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে, ISIS এবং আলকায়দায় যোগ দিতে সিরিয়া-আফগানিস্তানে হারিয়ে গিয়েছেন বলে দেখানো হয় তাতে। বিজেপি-র অভিভাবক সংস্থা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘের ছত্রছায়ায় থাকা, দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিবেকানন্দ বিচার মঞ্চ ওই তথ্যচিত্রটি দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে দেখানোর ব্যবস্থা করে।  তাকে ঘিরে ঝামেলা বাধলে শিল্পীসত্ত্বা এবং বাক স্বাধীনতাকে ‘ধর্ষণ করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন কৌশিক।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই তথ্যের বিকৃতি! উঠছে অভিযোগ

এই গোটা ঘটনাক্রমকে হালকা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন ছবির প্রযোজক বিপুল শাহ। বিপুলের বিরুদ্ধে এর আগে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তুলেছিলেন ‘সেক্রেড গেমস’ অভিনেত্রী এলনাজ নরৌজি। অভিনেতা অক্ষয় কুমারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বিপুল। বাংলায় ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র উপর নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু আইন দেখালেও, আসলে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো ‘দ্য কেরালা’ স্টোরিও একটি প্রোপাগান্ডা ছবি বলে মত উদারপন্থী মানুষ এবং অবিজেপি শিবিরের নেতা-নেত্রীদের। তাঁদের মতে, হিন্দি বলয়ে ‘লভ জিহাদ’, ‘ধর্মান্তরণ’ নিয়ে গেরুয়া শিবিরের অবস্থান সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে কেরলকেও সেই নিয়ে খামোকা বদনাম করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ, যে কেরল বিগত কয়েক দশকে শিক্ষাদীক্ষা, সহিষ্ণুতা, সবদিক থেকেই নজির গড়েছে।

আর এখানেই সত্য এবং উত্তর সত্যের তত্ত্ব তুলে ধরছেন বিরোধীরা। উত্তর সত্যকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘পোস্ট ট্রুথ’। যার অর্থ, মূল সত্যকে খারিজ করে ব্যক্তিগত মতামত এবং আবেগতাড়িত ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া। সেই উত্তর সত্যকে সামনে রেথে জনমত গড়ে তোলার কাজ ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা গিয়েছে। ২০২৪-এর আসন্ন লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২৬-এর কেরল বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ক্ষেত্রে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’কে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। তাদের দাবি, অসত্য এবং বিকৃত তথ্য নির্ভর এই ছবির মাধ্যমে ‘লভ জিহাদ’ ধর্মান্তরণের ধারণা উস্কে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাতে সমাজের বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের উপর আঁচ পড়তে পারে।

(Feed Source: abplive.com)