পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা, খালিস্তান আন্দোলন, সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ, বাবার দেখানো পথেই ট্রুডো!

পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা, খালিস্তান আন্দোলন, সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ, বাবার দেখানো পথেই ট্রুডো!
নয়াদিল্লি: অভিযোগের পাল্টা অভিযোগ, হুঁশিয়ারির পাল্টা হুঁশিয়ারি, খালিস্তানপন্থী শিখ নেতার মৃত্যুতে ভারত-কানাডার মধ্যে সংঘাত জারি। দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ভারতের দিকে হিংসাত্মক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো (Justin Trudeau)। সমস্ত তথ্য-প্রমাণ হাতে তুলে দেওয়া সত্ত্বেও ভারত পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। যদিও ট্রুডোর এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে খারিজ করে দিয়েছে দিল্লি। কিন্তু এই প্রথম নয়, ভারত এবং কানাডার মধ্যে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। ট্রুডোর আগে, তাঁর বাবা পিয়ের এলিয়ট ট্রুডোও (Pierre Elliott Trudeau) দিল্লির সঙ্গে সংঘাতে জড়ান। (India-Canada Relations)

খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জরের মৃত্যুতে ভারতের ভূমিকা ছিল বলে দাবি করেছেন ট্রুডো। ভারতীয় এজেন্টরা সে দেশে হিংসাত্মক কাজকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন, তাতে কানাডার নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমিকতা নষ্ট হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। এমনকি দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও বিষয়টি তিনি তোলেন বলে দাবি করেন ট্রুডো। দিল্লি যদিও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে খালিস্তানপন্থী, ভারতবিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।

এই প্রেক্ষাপটেই ট্রুডোর বাবা, কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী পিয়েরের সঙ্গে দিল্লির টানাপোড়েনের স্মৃতি ফিরে আসছে। ১৯৭১ সালে দিল্লি সফরে আসেন পিয়ের। উটের পিঠে চড়ে ঘোরা থেকে, গরুর সেবা, গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসা থেকে তাজমহল দর্শন, কিছুই বাদ রাখেননি তিনিও। কিন্তু তাঁর সময়ই মূলত ভারত এবং কানাডার মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয়। যদিও সেই সময় খালিস্তানপন্থীদের নিয়ে সংঘাত বাধেনি। বরং ভারতের প্রথম পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা ঘিরে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।

পরমাণু শক্তি উৎপাদনে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ইউরেনিয়াম দিয়ে সাহায্য় করত দ্য কানাডা ডয়টেরিয়াম ইউরেনিয়াম (CANDU) রিয়্যাক্টর। আমেরিকা এবং কানাডা যৌথ ভাবেই ভারতকে সাহায্য করতো সেই সময়। তার ফলেই ১৯৬০ সালে মুম্বইয়ে হোমি জাহাঙ্গির ভাবার নেতৃত্বে কানাডিয়ান-ইন্ডিয়ান রিয়্যাক্টর, US অর্থাৎ CIRUS নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর গড়ে তোলা সম্ভব হয়। কিন্তু পরমাণু বোমা নয়, অন্য কাজে ওই রিয়্যাক্টর ব্যবহারের শর্ত ছিল বলে দাবি করে কানাডা। তার অন্যথা হলে পরমাণু সহযোগিতা থেকে পিছিয়ে আসবে কানাডা, হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন পিয়ের।

এর পর ১৯৭৪ সালে পোখরানে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করে ভারত। CIRUS রিয়্যাক্টর থেকে সংগৃহীত প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করেই ওই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা হয় বলে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি রিসার্চ পেপারে দাবি করা হয়।  ভারতের দাবি ছিল, শান্তিপূর্ণ অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র। তাতে কানাডার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির লঙ্ঘন হয়নি। কিন্তু তার পরেই পরমাণু শক্তি নিয়ে সবরকম সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় কানাডা। ভারতে কর্মরত কানাডীয় আধিকারিকদেরও দেশে ফিরতে আহ্বান জানানো হয়।

পরবর্তী কালে, আমেরিকার বিদেশ দফতরের গোপন নথি প্রকাশ্যে আনা হয় ২০০৫ সালে। তাতে দেখা যায়, ভারতের আমেরিকা এবং কানাডা যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তাতে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষায় রিয়্যাক্টরটি ব্যবহার করা যাবে না বলে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল না। শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উল্লেখ ছিল। সেই ঘটনায় ভারত এবং কানাডার মধ্যেকার সংঘাত পরিস্থিতি থিতিয়ে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। ২০১০ সালের জি-২০ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কানাডায় গেলে, ফের দুই দেশের মধ্যে পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

খালিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তাও পিয়ের সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক তিক্ত করে তোলে। কানাডায় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর তা আরও চরম আকার ধারণ করে। ১৯ শতক থেকেই কানাডায় শিখদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়।  সাতের  দশকে কানাডা অভিবাসী আইনে পরিবর্তন ঘটালে কানাডায় শিখ জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে দ্রুত। বর্তমানে কানাডায় ৭.৭ লক্ষ শিখ রয়েছে, কানাডার মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ। আটের দশকে পঞ্জাব থেকে পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় নিতে শুরু করে কুখ্যাত সন্ত্রাসীরাও, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তলবিন্দর সিংহ পরমার।

খালিস্তানি সংগঠন বব্বর খালসার সদস্য ছিলেন তলবিন্দর। বিদেশে তিনি ভারতীয় দূতাবাস থেকে ভারতীয়দের উপর হামলার হুমকি দেন একাধিক বার। তলবিন্দরকে দেশে ফেরাতে একাধিক বার অনুরোধ জানায় ভারত। কিন্তু কানে তোলেননি পিয়ের। ভারতীয় গোয়েন্দারা সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও হেলদোল দেখাননি তাঁরা। কিন্তু এর পরই ২৯৮৫ সালের ২৩ জুন টরন্টো-মুখী এয়ার ইন্ডিয়া বিমান ১৮২ (কণিষ্ক)-তে মাঝ আকাশে বিস্ফোরণ ঘটায় খালিস্তানি জঙ্গিরা। তাতে ৩২৯ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন কানাডীয় নাগরিক। কানাডার ইতিহাসে এত বড় হামলা আগে বা পরে কখনও হয়নি। তলবিন্দরই ওই হামলার মূল চক্রী ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন পিয়ের। ১৯৯২ সালে পঞ্জাব পুলিশের হাতে মৃত্যু হয় তলবিন্দরের।  এর পরেও, ২০২৩ সালের গোড়াতেই কানাডায় তলবিন্দরকে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় উপচে পড়ে।

ওই বিমান হামলার ঘটনায় তলবিন্দর-সব প্রায় সকলেই মুক্তি পেয়ে যা। দোষী সাব্যস্ত হন মাত্র একজন। ইন্দ্রজিৎ সিংহ রেয়াতের ১৫ বছর সাজা হয়। সন্ত্রাস দমনে কানাডার এই ভূমিকা সমালোচিত হয় আন্তর্জাতিক মহলেও। অথচ ওই সময়ই কোয়েবেকে ফরাসি বিচ্ছিন্নতাকামীদের ধরপাকড় করতে শুরু করে কানাডার তদানীন্তন পিয়ের সরকার। খালিস্তানপন্থী এবং ভারতবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত সংগঠন এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ক্ষেত্রে কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো তাঁর বাবাকেই অনুসরণ করে চলেছেন বলে তাই অভিযোগ কূটনীতিকদের একাংশের। কানাডায় শিখদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তিই এর মূল কারণ বলে দাবি তাঁদের। নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে বাবার মতোই ট্রুডো খালিস্তানপন্থীদেপর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগ বলে অভিযোগ ওঠে।

(Feed Source: abplive.com)