জার্মানির মাটিতে ঢাকে পড়বে কাঠি, তুঙ্গে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
বছর তিনেক আগের কথা। বিকেলের আড্ডায় যখন বারবার উঠে আসছে দেশের কথা, দুর্গাপুজোর স্মৃতি, ঠিক তখনই তিন প্রবাসী বাঙালি পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় এই জার্মানির মাটিতেই নিজেদের উদ্যোগে একটা পুজো শুরু করার। ইউরোপের পশ্চিমে, জার্মানির বাভারিয়ায় এরল্যাঙ্গেনের বাঙালি দল, ‘দুর্গা ভিলে’-র সেই শুরু। সেই তিন বাঙালি পরিবারের চেষ্টায় প্রথম ২০২১ সালে মা দুর্গার আরাধনা শুরু হয় এরল্যাঙ্গেনে। সেই প্রথম, বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে, মূর্তি তৈরির সব সরঞ্জাম সংগ্রহ করে নিজেদের হাতে বানানো হয় মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি। রথযাত্রার দিন ‘কাঠামো পুজো’ থেকে আরম্ভ করে মহালয়ায় ‘চক্ষুদান’, ষষ্ঠীর আবাহন থেকে সন্ধিপুজোর ১০৮ প্রদীপে মা সপরিবারে আসেন তাঁদের পুজোয়।
জার্মানির এই পুজো বনেদি বাড়ির চণ্ডী মণ্ডপের আদলে তৈরি হয়। সাবেকি ডাকের সাজে, একচালার দুর্গা প্রতিমা তৈরি হয় তাঁদের। এইবার তৈরি করা হয়েছে সাড়ে ৭ ফুট উচ্চতা আর সাড়ে ৬ ফুট প্রস্থের দুর্গা প্রতিমা। বিদেশের মাটিতে এই কাজ অবশ্যই সহজ ছিল না। বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতা, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা সামলে হাতে হাতে রেখে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সেখানের বাঙালিরা।
প্রায় ৬০ জনের ‘দুর্গা ভিলে’ দলের অধিকাংশ সদস্য আদতে এরল্যাঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতে আসা একদল ছাত্রছাত্রী। তাঁদের উৎসাহ, উদ্দীপনায়, পুজো প্যান্ডেলের বাইরের ফুচকা স্টলে, অষ্টমীর ঢাকের তালে আর অফুরন্ত আড্ডায়, খুনসুটিতে যেন ছোটখাটো একটা ম্যাডক্স স্কোয়ার নেমে আসে পুজো প্রাঙ্গনে।
প্রতিবারের মত এবারও মা এরল্যাঙ্গেনে আসছেন পঞ্জিকা মেনে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত তিথি মেনেই সব আচার-অনুষ্ঠান পালন হবে। রানাঘাট থেকে প্রতিবারের মত আসবেন পুরোহিত মশাই। গতবছর এই পুজোয় লোক সমাগম হয়েছিল দুই হাজারের কিছু বেশি আর পাত পেড়ে বিনামূল্যে ভোগের প্রসাদ খেয়েছিলেন প্রায় ১২০০ মানুষ। এই পুজোয় সকলের জন্য অবারিত দ্বার। গত বছর অষ্টমীর অঞ্জলিতে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে স্থানীয় জার্মান মানুষদের সংখ্যা। পুজোর সময় মা যেন সব বিভেদ, ব্যবধান ঘুচিয়ে সব সংস্কৃতিকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন।
পুজো আর নতুন পত্রিকার গন্ধ একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিবার তাই পুজোর সময় প্রকাশ করা হয় শারদীয়া পত্রিকা, ‘শারদীয়া’। গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনি, আঁকা ছবি, ক্যামেরার কাজে রঙিন হয়ে ওঠে পুজো সংখ্যা। পুজোর দিনগুলোয় ছোটদের জন্য থাকে ‘বসে আঁকো’ আর বড়দের জন্য থাকে ‘শঙ্খ বাজানো’, ‘প্রদীপ জ্বালানো’ এবং ‘শাড়ি পরার’ প্রতিযোগিতা। বিজয়ার পর আসে বিজয়া সম্মেলনী। ভরতনাট্যমের ঘুঙুরে, পাঞ্জাবী ভাংড়ায়, রবীন্দ্রনৃত্যে, গানে, আবৃত্তিতে, পুজোর নাটকে জমে ওঠে উৎসবের রাত।
এই সংগঠনের পক্ষ থেকে দীপঙ্কর সরকার বলেন, ‘আমাদের দুর্গাভিলে একটা ছোট সংগঠন। এখানে যত বাঙালি পরিবার আছে, যত বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তৈরি সংগঠন। এখানে পুজো শুরু করি এই ভাবনা থেকেই যে কীভাবে পুরো কলকাতাকে এখানে তুলে আনা যায়, সেই আমেজটা কী করে পাওয়া যায়। আমাদের পুজো একদম নিয়ম মেনে হয়। ষষ্ঠীর দিন অকালবোধন দিয়ে শুরু হয়, আর দশমীর দিন সিঁদুর খেলা দিয়ে শেষ হয়। আমাদের পুজোয় কারও থেকে কোনও টাকাপয়সা কিচ্ছু নেওয়া হয় না। কলকাতায় যেমন আমরা বিনা পয়সায় সমস্ত মণ্ডপ ঘুরতে পারি, সেই আমেজই এখানে বজায় রাখার চেষ্টা করি। এই এরল্যাঙ্গেনে চার হাজারেরও বেশি ভারতীয় থাকেন, আমরা চাই যে তাঁদের জন্য পুজোটা সবসময় স্পেশ্যাল হোক।’
(Feed Source: abplive.com)