সোমা দে
দুগ্গাপুজোতে দেশে ফিরবো, এই মন্ত্র নিত্য জপ করতে থাকি বছরের শুরু থেকেই। নতুন বছর শুরু হতেই ক্যালেন্ডারে দুগ্গাপুজো কবে তা দেখে নিয়ে, ছুটির স্লট বুক করে, তারপর শান্তি। ছোটবেলার মত দুর্গাপুজোর সময় জামাকাপড় কেনা, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া, কটা ঠাকুর দেখা হবে তা গুণে মনে করে রাখা, দশমীর পরে বাড়ির বানানো মিষ্টি, পরিজনের বাড়িতে যাওয়া-আসা, প্রণামের ম্যারাথন ইত্যাদি এখন প্রায় কিছুই নেই।
এখন দুর্গাপুজো অন্যরকম। ঘরে বসে ঢাকের আওয়াজ, মাইকে এনাউন্সমেন্ট, পাড়ার প্যান্ডেলে একটু বসা, জোরদার ভুরিভোজ করা, আর প্রতি মুহূর্তের আবেশকে চেরিশ করা। তাছাড়া দেশের বাইরে থাকতে গিয়ে মাছের প্রতি টান বেড়েছে। তাই দেশে ফিরলে মাছের ওপর নজর বেশি থাকে। মাছ বলতেই, ইলিশ কি ঐসময় পাওয়া যাবে, একটু হিসেবে করে নেওয়া হয়ে যায়। পমফ্রেট অনেকদিন চাখা হয়নি। পাতুরির চাতুরীতেও মন মজে থাকে। আর তাছাড়া এগরোল, পিঁয়াজি, বেগুনী, এসব মনে করলে জার্সি আইল্যান্ড-এর মেঘলা ঝিম হয়ে থাকা দুপুরে হঠাৎ বাংলা রক কানে বাজে।
সেবার সাল ২০১৬, দুগ্গাপুজো আসতে তখনও এক মাস বাকি। দেশে ফেরার ফ্লাইট বুকড। বন্ধু বান্ধবের ফোন-চ্যাট আসতে শুরু করেছে। প্ল্যান হচ্ছে দেখা করার। স্কুলের গ্রুপ, কলেজের গ্রুপ আলাদা আলাদা প্ল্যান। প্ল্যান শুরু হয় “কবে আসছিস” দিয়ে। সে অবধি ঠিক ছিল। মিট করার দিনক্ষণ আলোচনা হতেই একটা খটকা! কোথাও একটা গোলমাল! তারিখগুলো ভালো করে দেখলাম বারবার এবং বুঝলাম গোলমাল হয়েছে, এবং তা গুরুতর।হায়! ছুটির স্লট বুকিংয়ে ভুল হয়েছে। আমার ছুটি, দুর্গাপূজার ষষ্ঠী অবধি। মাথা ঘুরছে বনবন। চোখে সর্ষের অনন্ত ক্ষেত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাকে বলে আর কি! শেষে মাথা যখন একটু স্থির, অবস্থা বিচার করলাম। নাহ! ছুটির স্লট বদলানো সম্ভব নয়!
অগত্যা পুজোর সময় দেশে থাকার উপায় নেই। তবু মনকে বোঝানো গেল, পুজোর আগে তো দেশে যাওয়া হবে। প্যান্ডেলের ভূমিষ্ঠ হওয়া টুকুই নাহয় দেখা হবে। পরবর্তী আনন্দ আয়োজন নাহয় ফেসবুকে দেখে নেব। দেখা সাক্ষাৎ-এর দিনক্ষণ সেইমতো ধার্য্য করা গেল। পৌঁছলাম দেশে। আকাশপথে নামতে নামতে সোনালী শহরটা প্রত্যেকবারের মতো এবারেও অচেনাই ঠেকছে। মেকওভার হয়ে যাওয়া শহরটা ঠিক তার মধ্যে থাকা মানুষগুলোর মতোই। উৎসবের আনন্দে সেও নেচে উঠেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি যাওয়ার পথ যেন ঝিলিমিলি Champagne! যদিও এই আলো এখনও আরও খানিক জ্বলবে। আরও কিছু রাস্তায় কাজ শুরু বাকি।
বাড়ি ফিরে মন টনটন করে উঠলো। সবাই যখন পুজো আসবে বলে তাড়াতাড়ি কাজ সারছে, আমি চাইছি আরেকটু দেরি হোক পুজো আসতে। সবার মুখে একই কথা, “সেকি! পুজোয় থাকবি না!” সেবার ঘুমোলাম কম, বই পড়লাম কম, রাস্তায় ঘুরলাম বেশি, প্যান্ডেল দেখলাম আরও বেশি বেশি। তবু, সময় কাটলো তুবড়ির মত। তারপর যখন ফেরার সময়, রাস্তার আলো ভরে গিয়েছে কানায় কানায়। মানুষ, হাওয়া, গাছ, মাঠ, আকাশ, বাতাস, গন্ধ সব সেজে উঠেছে। এয়ারপোর্টের দিকে এগোতে এগোতে সব ধীরে ধীরে শান্ত, নিষ্প্রভ। গলায় কান্না অজান্তেই অবাধ্য হয়ে জমা হয়। চোখকে শাসনে রাখতে হয়। ফ্লাইটে বসে মনে হলো,
“দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা,
দেখো যাওয়ার পথের পাশে, ছোটে হাওয়া পাগলপারা,
এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা আমায় ছাড়া”
পুজোর কয়েকদিন জার্সি আইল্যান্ড-এ সূর্যের আলো ঝলমল করেছিল বটে। তবে আমি আর ফেসবুক খুলিনি। আর পরের বার থেকে পুজোর ডেট বারংবার খতিয়ে দেখা চেকলিস্টে যোগ হয়েছিল।
(Feed Source: zeenews.com)