চেহারা বদলের মজার ট্রেন্ড না ফাঁদ ! স্বেচ্ছায় ব্যক্তিতথ্যের আগল খুলে অজান্তেই ডাকছেন বিপদ

চেহারা বদলের মজার ট্রেন্ড না ফাঁদ ! স্বেচ্ছায় ব্যক্তিতথ্যের আগল খুলে অজান্তেই ডাকছেন বিপদ
অঞ্জন চক্রবর্তী, কলকাতা : ফেসবুক-জুড়ে (Facebook) আদলবদলের এক ভিড় ! মুখের আদল বজায় রেখে বদলে যাচ্ছে অবয়ব। বিভিন্ন ভঙ্গিমা ও চেহারায় মজার এক মুখবদল। চেহারা বদলের নেহাত এক হালকা মেজাজের খেলা। কিন্তু আদতে কি বিষয়টা শুধুই মজার ? ফেসবুকে জনপ্রিয় হওয়া খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকে আরও এক হাতছানি। কয়েকটা ক্লিকের পর যে নতুন অবতার দেখার জন্য মজার অংশীদার হচ্ছেন, তাতে নিমেষেই কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আপনার ব্যক্তিতথ্য ! যার পরিণতি হতে পারে ভয়ঙ্কর।

ঠিক কী কী বিপদ ডেকে আনছেন ? মজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফাঁদে পড়ে ডিপফেকের (DeepFake) পরবর্তী শিকার হতে পারেন আপনি। মজার খেলায় যুক্ত হয়ে মুখের আদলের খোঁজ দিয়ে ওয়েব-দুনিয়ায় নিজেকে কার্যত অনাবৃত করে ফেলছেন। তাতে খোওয়া যেতে পারে সম্মান থেকে অর্থ। আর সবথেকে বড় চিন্তা হল, এক্ষেত্রে সাইবার বিশেষজ্ঞ বা পুলিশের খুব বেশি কিছু করার কিন্তু জায়গা নেই। কারণটাও আপনিই। স্বেচ্ছাতেই তো সব তথ্য বিলিয়েছেন। মজার আড়ালে ঠিক কতটা ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেটা বুঝতেই এবিপি লাইভ বাংলা কথা বলেছিল বিশিষ্ট সাইবার বিশেষজ্ঞদের (Cyber Specialist) সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে মারাত্মক সব তথ্য।

৪৫ সেকেন্ডে নুড ছবি !

রশ্মিকা মান্দানা, ক্যাটরিনা কাইফ থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi), সাম্প্রতিককালে একের পর এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শিকার হয়েছেন ডিপফেকের। যেক্ষেত্রে অন্য কোনও ব্যক্তির দেহে মুখে আদল বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সেলিব্রিটিদের মুখ। সরকারের পক্ষে যা নিয়ে ইতিমধ্যে নড়েচড়ে বসেছে সব পক্ষ। AI-র সাহায্যে যে ডিপফেক বা মর্ফড ছবি বা ভিডিও তৈরি করা হয় সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় কোনও ব্যক্তির ছবি। আর ফেসবুকে ট্রেন্ডিং গেমে অংশ নিয়ে আপনার ছবির ভাণ্ডার বলা ভাল ব্যক্তিতথ্যের ভাণ্ডার ব্যবহারের ছাড়পত্রই দিয়ে ফেলছেন আপনি। যার ফল হতে পারে কিন্তু মারাত্মক।

সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিৎ মুখোপাধ্য়ায় জানাচ্ছেন, ডিপফেকের রমরমার মাঝে এআই-এর যে ফ্রি ট্রায়াল ভার্সান ডিপফেকে ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে একজনের নুড ছবি তৈরি করা সম্ভব। আর গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই ক্ষেত্রে ছেলেদের নয়, মেয়েদের মর্ফড নুড ছবি ব্যবহারের টুল বেরিয়েছে। তাই স্বেচ্ছায় কোনও গেমে অংশ নিলে সেখানে জমা হওয়া ছবি কোথায়, কীভাবে কাজে লাগানো হতে পারে, সে নিয়ে সবরকম আশঙ্কাই থাকছে।

ডার্ক ওয়েবে ব্যক্তিতথ্য বিক্রি

ডিপফেকের রমরমা ছাড়াও বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া ব্যক্তিতথ্য চুরি করে নিয়ে সেগুলো ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আগেও উঠেছে। তথ্য দিয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, পুজোর আগে সোশাল মিডিয়ায় সেলফি চ্যালেঞ্জ খুব ট্রেন্ডিং হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেখানে জমা হওয়া ১০ লক্ষ ৩৪ হাজার ছবি বিক্রি হয়েছিল ডার্ক ওয়েবে। অর্থাৎ আপনার ক্ষণিকের মজা পাওয়ার ভাবনার সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিতথ্য হাতিয়ে নিয়ে আপনাকেই বানিয়ে ফেলা হয়েছিল পণ্য !

বেশ কয়েক দশক পর আপনাকে কেমন লাগবে থেকে কোন নায়ক-নায়িকার মুখের সঙ্গে আপনার মুখের আদল মেলে, এই সমস্ত মজার খেলার পিছনে আসলে রয়েছে ফাঁদ। সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিতের কথায়, কেউ ভাবছেন তিনি মজার খেলায় যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু যেই আপনার ছবি দেখে সেই আদল তৈরির ছাড়পত্র আপনি দিচ্ছেন, তখনই সব ছবি সহ তথ্য জমা পড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করে হয়ে থাকে নির্দিষ্ট কিছু হ্যাশট্যাগ। ওয়েব দুনিয়ায় হ্যাশট্যাগের ফিল্টারের মাধ্যমে আসলে খেলায় যোগ দেওয়া আপনার ছবি জমা পড়ে যাচ্ছে বৃহত্তর এক জায়গায়। যেখান থেকে সফটওয়ারের মাধ্যমে ডিপফেকের জন্য সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে আপনার মুখের আদল। মর্ফড ছবি, ভিডিও ব্যবহার করা হতে পারে বিভিন্ন জায়গায়। আপনার অজান্তেই হয়তো পর্নোগ্রাফিতেও !

কেন জনপ্রিয় ট্রেন্ডিংয়ের ছক ?

সাইবার নিরাপত্তার প্রশ্ন যখনই ওঠে, তখনই সঙ্গে ওঠে আরও একটি প্রশ্ন। বলা ভাল জিগ্গাসা। ব্যক্তিতথ্য হাতিয়ে নিতে কেন এই মজার খেলাগুলো আড়াল হতে পারে, এই আশঙ্কা কেন ? কারণটা স্পষ্ট। নিরাপত্তার ফাঁক গলে স্বেচ্ছায় ভুল করানো। সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের প্রোফাইল লক করে রাখেন নিরাপত্তার স্বার্থে। প্রোফাইল লকের পাশাপাশি ব্য়ক্তিতথ্যের স্বার্থে অনেকেই লক রাখেন ছবি-তথ্যও। আর সেই বেড়াজালে আটকে যায় সহজে ব্যক্তিতথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ছক। প্রোফাইল থেকে ছবি যদি লক থাকতে পারে এই আন্দাজ করেই পাল্টা মজার খেলার ছকে ফাঁদ তৈরি করা। যেখানে দেখে মনে হতেই পারে নেহাত কেমন লাগতে পারে একবার দেখিই না-এর হাতছানি। আর সেই হাতছানিকেই আড়াল করে খেলায় অংশ নিতে আপনার প্রোফাইল ও তথ্য ভাণ্ডার খুলে দিলেই তা থেকে সহজেই হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব যাবতীয় তথ্য।

ফেসবুকে জনপ্রিয় হওয়া খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকে আরও এক হাতছানি। আপনাকে কেমন লাগবে দেখুন, এই হাতছানির সঙ্গে বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কতজন বন্ধুবান্ধব বা সোশালে ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ডস’ সেই খেলার অংশ হয়েছেন, সেটার জানানও দেওয়া থাকে সেই অ্যাপে খেলার বাটনের পাশেই। সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো আসলে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে আরও বেশি লোককে মজার খেলার ফাঁদে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টা।

হাতিয়ার শুধুমাত্র সচেতনতা 

সচেতনতা। একমাত্র বাঁচার রাস্তা। সাইবার বিশেষজ্ঞ সাম্যজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ব্যক্তিতথ্য হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, ডিপফেকের কবলে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কাগুলো একেবারে অজানা নয় কিন্তু মানুষের। কিন্তু তাও খানিক অজান্তে ও খানিক মজায় অংশ নেওয়ার হাতছানিতে অনেকে অংশ নিয়ে ফেলছেন এই সমস্ত খেলার ফাঁদে। একবার কোনও খেলায় অংশ নিয়ে আপনার অবতার দেখতে গিয়ে ব্যক্তিতথ্য উন্মুক্ত করে ফেললে কিন্তু সাইবার বিশেষজ্ঞ বা পুলিশ, কারোরই তেমন কিছু করার নেই বলেই আশঙ্কা তাঁর।

মজার খেলার হাতছানি কখন, কীভাবে আপনার জীবনে আতঙ্কের ফাঁদ হয়ে উঠতে পারে, তা বলা মুশকিল। হয়তো অংশগ্রহণ করার পরও মনে করছেন, কোনওভাবে তো ক্ষতিগ্রস্থ হলাম না। তাহলে সমস্যা কী ? ভুল ভাবছেন। একবার অংশ নিয়ে কিন্তু আপনি অনাবৃত করে ফেলেছেন নিজেকে। আপনার ব্যক্তিতথ্য কখন পণ্য হয়ে উঠবে বা আরও ভয়ঙ্কর কিছুর সামনে পড়ে যাবেন, তার নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারে না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া থেকে মর্ফড ছবি বা ভিডিওতে সম্মানহানি ও তার জেরে মানসিক হেনস্থা, কোন খাঁড়া নেমে আসবে, তা কিন্তু বলা মুশকিল।

তাই বাঁচার হাতিয়ার একটাই। সচেতনতা। নিজে সতর্ক থাকুন। কাছের মানুষদের সতর্ক করুন। মুহূর্তের মজার বড় কোনও খেসারত যাতে না দিতে হয়, সে বিষয়ে আগাম সতর্কতাই একমাত্র বাঁচার উপায়।

(Feed Source: abplive.com)