সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বেশিদিন নয়, মাস চারেক আগের ঘটনা। ভারতের মাটিতে চলছে ওয়ান ডে বিশ্বকাপ (ODI World Cup)। হইচই পড়ে গিয়েছিল একটি ঘটনায়। পাকিস্তান ক্রিকেটারেরা নাকি কলকাতায় বিশ্বকাপের ম্য়াচ খেলতে এসে বিরিয়ানি অর্ডার করেছিলেন। পাক শিবির থেকে ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়েছিল। জানানো হয়েছিল তীব্র প্রতিবাদ। তবে জল্পনা থামেনি।
বিরিয়ানি দূর অস্ত, সামান্য একটা রোলের কথা শুনলেও যেন আঁতকে ওঠেন আকাশ দীপ (Akash Deep)। মশালাদার খাবার, ফাস্ট ফুড খেলে বড় মঞ্চে সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন কীভাবে? সংকল্পে অটুট তরুণ তাই হাসিমুখে কোচকে বলে দিতে পারেন, স্যর, রোল নয়, চিকেন স্টু খাব।
আকাশ দীপ। শুক্রবারের আগে পর্যন্ত কলকাতা ময়দানের বাইরে অনেকেই যাঁর নাম পর্যন্ত শোনেননি। রাঁচিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে (India vs England Test Series) টেস্ট অভিষেক হয়েছে শুক্রবার। আর ভারতীয় দলের ৩১৩ নম্বর টেস্ট ক্যাপ হাতে পেয়েই শিরোনামে উঠে এসেছেন ডানহাতি পেসার। যাঁর গতি ও স্যুইংয়ের হদিশ পাননি ইংরেজ ব্যাটাররা। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নিয়েছেন আকাশ। এমনকী, যশপ্রীত বুমরার অভাবও অনেকটাই ঢেকে দিয়েছিলেন।
ছাত্রের সাফল্য দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠছে সৌতম মিত্রের (Soutam Mitra)। কলকাতায় এসে প্রথম যাঁকে কোচ হিসাবে পেয়েছিলেন আকাশ। যাঁর হাত ধরেই টেনিস বল ক্রিকেটের তারকার ডিউস বলে সাধনা শুরু। এবিপি আনন্দে আকাশের উড়ান-কাহিনি শোনালেন সৌতম। বলছিলেন, ‘সালটা সম্ভবত ২০১৭। ভিডিওকন অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছিল আকাশ। খুব জোরে বল করত। তবে একটু এলোমেলো বোলিং করত। প্রথমে দেখেই ওকে ভাল লেগে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম, সঠিক পরিচর্যা হলে এ ছেলে অনেক দূর যাবে।’
সেই মরশুমেই ইউনাইটেড ক্লাবে সই করানো হয় আকাশকে। সৌতম বলছিলেন, ‘আমার তো ওকে দেখে ভাল লেগেছিলই, রানা (বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার দত্তাত্রেয় মুখোপাধ্যায়), সাগরেরাও (সাগরময় সেন শর্মা) বেশ প্রভাবিত হয়েছিল। ওরাও আকশকে খুব সাহায্য করেছে। আমি ওদের যখনই ডেকেছি, এসে বোলিং দেখিয়ে দিয়েছে। সাগর তখন বাংলার নির্বাচক। আমাকে বলেছিল, নির্বাচক হিসাবে কী করে দেখাই ওকে? আমি বলি, আগে তুই ক্রিকেটার, তারপর তো নির্বাচক। সাগর রাজি হয়ে যায়। আমাদের ক্লাবের প্র্যাক্টিস কখনও হতো ভিডিওকন মাঠে, কখনও ডালহৌসি মাঠে। সেখানেই তালিম চলেছে আকাশের।’
ডানহাতি পেসারের বাংলায় আসা কাকার সূত্রে। সৌতম বলছেন, ‘ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আকাশ দুর্গাপুরে কাকার কাছে থাকত। ওখান থেকেই এসে ভিডিওকনে ভর্তি হয়। বাগুইআটি কেষ্টপুরে মেসে থাকত। আমাদের ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর আরজি কর হাসপাতালের কাছে ক্লাবের ক্রিকেট সেক্রেটারির ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠে। সেখানেই ক্লাবের ক্রিকেটারদের থাকার বন্দোবস্ত হয়। মাঝে কয়েকদিন আমার বাড়িতেও থেকেছে।’
বাংলা রঞ্জি দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, দলের জন্য নিজের জীবনও বাজি রাখতে পারেন আকাশ। আদর্শ টিমম্যান। কোচের মুখেও শোনা গেল এরকমই গল্প। সৌতম বললেন, ‘সেবার ইউনাইটেড ক্লাবের প্রায় অবনমন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রাজস্থান মাঠে ম্যাচ ছিল। ওর কুঁচকিতে টান লেগেছিল। কিন্তু অবনমন বাঁচাতে ওকে লাগবেই। আমি বরফ আনিয়ে কুঁচকিতে লাগিয়ে মাঠে নামালাম। ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছিল আকাশ।’ যোগ করলেন, ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে সেবার লিগের প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। এদিকে আকাশের বাড়িতে ভীষণ জরুরি কাজ ছিল। বলেছিল, স্যর ম্যাচের তৃতীয় দিন থাকতে পারব না। তিনদিনের ম্যাচের প্রথম দিন বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু শুধু ওই ম্যাচ খেলার জন্য আকাশ এসেছিল। দ্বিতীয় দিন খেলার পরই ওকে বাইকে চাপিয়ে হাওড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করলাম। ওর খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার তারিফ করতেই হবে।’
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মারাত্মক সংযমী বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা পেসার। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় খাবারদাবারেও লাগাম পরাতে দুবার ভাবেন না। সৌতম শোনালেন সেরকম একটি গল্পও। বললেন, ‘মনে আছে, স্থানীয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ম্যাচ ছিল আমাদের। সেই ম্যাচের পর সকলের জন্য পার্ক স্ট্রিট থেকে রোল আনিয়েছিলাম। খেল না আকাশ। বলল, না স্যর তেল আছে।’ যোগ করলেন, ‘প্রথম থেকে দেখছি স্বাস্থ্য সচেতন ছেলে। মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলে। চিকেন স্টু ওর প্রিয় খাবার। গত মরশুমে রঞ্জি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে এসে বলল, স্যর আপনার ফ্ল্যাটে যাব। আমি বললাম, আয়। এসে চিকেন স্টু খেল। বাড়ি গিয়েও ফোনে চিকেন স্টু-র রেসিপি জিজ্ঞেস করেছে আমার স্ত্রীকে।’
ইউনাইটেড ক্লাব যেমন তাঁকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মঞ্চ দিয়েছে, ফিরিয়ে দিয়েছেন আকাশও। একবার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে কথা প্রায় পাকা। বাংলার হয়ে এক সময় খেলা বাঁহাতি পেসার সৌরভ মণ্ডল যোগাযোগ করেছিলেন আকাশের সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু শেষে লাল-হলুদ শিবির থেকে আকাশকে কোনও অ্যাডভান্স দেওয়া হয়নি। তাই ইউনাইটেডেই সই করেন। কিন্তু আকাশকে পাবেন না ধরে নিয়ে ততদিনে অন্য ক্রিকেটার নিয়ে ফেলেছিল ইউনাইটেড। ফের আকাশকে নেওয়ার টাকা কোথায়! মুশকিল আসান হয়ে দাঁড়ান আকাশ নিজেই। কোচ সৌতম মিত্রকে বলেন, ‘স্যর যা দেবেন তাতেই খেলব।’
সৌতম বলছেন, ‘একবার মোহনবাগানের প্রস্তাবও পেল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, স্যর কত টাকার কথা বলব? শুনে বলি, টাকার কথা আমি কেন বলব? হেসে বলি, লোকে ভাববে আমার কাটমানি আছে। আসলে ও এরকমই। সহজ সরল। অনেককেই দেখেছি পরের পর্বে গেলে পাল্টে যায়। আকাশ এখনও একই আছে। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ওর। কোচ ক্রিকেটার তৈরি করতে পারে না। যদি প্লেয়ারের নিজের ইচ্ছে না থাকে। কঠোর পরিশ্রমী ছেলে আকাশ। তারই পুরস্কার পাচ্ছে।’
আকাশের সবচেয়ে বড় গুণ কী? ‘পরিশ্রম করার ক্ষমতা। শেখার ইচ্ছে। ওকে সব সময় ব্যাটারদের সামনের পায়ে খেলাতে বলতাম। বলতাম, সামনে খেলালে ব্যাটার বুঝতে পারবে না কতটা স্যুইং হবে। ও মেনে চলত। রোজ প্র্যাক্টিসের শেষে একটা স্টাম্প পুঁতে সেটা লক্ষ্য করে বল করত। প্র্যাক্টিসের শেষে বাকিরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছে, শুধু অফস্টাম্প লক্ষ্য করে প্রায় আধ ঘণ্টা বোলিং করত। সেই পরিশ্রমের পুরস্কার পাচ্ছে,’ বলছিলেন সৌতম। আরও বললেন, ‘ব্যাটিংও ভাল করে। ব্যাট হাতে ম্যাচও জিতিয়েছে। ওকে ব্যাটিং অর্ডারের ওপরেও পাঠিয়েছি। দেবাঙ্গ গাঁধী তখন বাংলার নির্বাচক। বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয় দাস দেবাঙ্গকে বলে আকাশকে ভিশনে নেওয়ার জন্য। আমিও বলি। সেখান থেকে ওর কেরিয়ার নতুন দিশা পায়।’
রাঁচি টেস্ট শুরু হওয়ার আগেই ছাত্রকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রেখেছিলেন সৌতম। বলছেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, রাঁচিতেই ওর অভিষেক হবে। রাঁচি টেস্টের আগের দিন ওকে সেটা লিখেওছিলাম হোয়াটসঅ্যাপে। সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে।’ যোগ করলেন, ‘লম্বা স্পেলে বল করতে পারে। কেন প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নেওয়ার পর ওকে সরিয়ে দেওয়া হল জানি না। ওকে ওই স্পেলে আরও কয়েকটা ওভার দেওয়া উচিত ছিল।’
কলকাতা ময়দান থেকে টিম ইন্ডিয়ার ড্রেসিংরুম, আকাশের উত্থানের সাক্ষী সৌতম। ছাত্রের আরও বড় সাফল্যের অপেক্ষায় রয়েছেন দ্রোণাচার্য।
(Feed Source: abplive.com)