শব্দ শুনেই ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের ছবি ফুটে ওঠে মানসচক্ষে, দৃষ্টিশক্তিহীন এক ‘আশ্চর্য প্রদীপ’

শব্দ শুনেই ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের ছবি ফুটে ওঠে মানসচক্ষে, দৃষ্টিশক্তিহীন এক ‘আশ্চর্য প্রদীপ’

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: এ যেন সেই মহাভারতের কাহিনি। হস্তিনাপুরের দৃষ্টিশক্তিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রের বিবরণী শুনতেন উপদেষ্টা সঞ্জয়ের কাছে। মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করতেন যুদ্ধের ছবি।

প্রদীপ দাসও (Pradip Das) মনের ক্যানভাসে যুদ্ধ দেখেন। তবে তা ঢাল-তরোয়ালের নয়, ফুটবল মাঠের দ্বৈরথ। তিনি জন্মান্ধ। অথচ ফুটবল ম্যাচের প্রত্যেক আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের বিবরণ দিয়ে দিতে পারেন আর পাঁচজন সাধারণ খেলপ্রেমীর মতো। ইস্টবেঙ্গল অন্ত প্রাণ। ৫৩ বছরের প্রদীপকে ১ অগাস্ট ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবসে সংবর্ধনাও দিয়েছে লাল-হলুদ শিবির। প্রদীপের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা।

জন্মের পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখেননি প্রদীপ। তবু হাওড়ার সালকিয়ার বাড়ি থেকে ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) ক্লাব প্রাঙ্গন হোক বা সল্ট লেকে যুবভারতী স্টেডিয়াম, ফুটবলের টানে, নিজের প্রিয় দল ইস্টবেঙ্গলের অমোঘ আকর্ষণে ছুটে যান। গত ৩০ বছর ধরে যে রোজনামচায় ছেদ পড়েনি!

শুনলে অবাক লাগবে যখন বছর তিপান্নর প্রদীপ বলেন, নিজের প্রিয় দলের ম্যাচ আর পাঁচজন সাধারণ ফুটবলপ্রেমীর মতোই দেখতে পান তিনি। গ্যালারিতে বসেই। আসলে প্রদীপ তো ফুটবল দেখেন না, শোনেন। আর শব্দের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলেন ছবি।

প্রদীপ বলেছেন, ‘শব্দই আমার দৃষ্টি। সমর্থকদের চিৎকার, অনুভূতি শুনে, গ্যালারির ঘ্রাণ নিয়েই বুঝতে পারি মাঠে কী হচ্ছে। আমার মস্তিষ্ক তা থেকেই বুঝে যায় আমার প্রিয় দল গোল করল না খেল। ইস্টবেঙ্গলের কোনও ফুটবলার গোলের সহজ সুযোগ নষ্ট করল নাকি অল্পের জন্য গোল খেতে খেতে বেঁচে গেল।’

সেই প্রদীপ দাসকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন শুভ্র মুখোপাধ্যায়। ১৪ মিনিটের তথ্যচিত্রে তুলে ধরেছেন প্রদীপের ফুটবল প্রেমের কাহিনি। কেন প্রদীপকে বেছে নিলেন তথ্যচিত্রের বিষয় হিসাবে? পরিচালক শুভ্র বলছেন, ‘প্রদীপ দাসের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ফুটবল নিয়ে, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নিয়ে ওঁর আবেগের কাহিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।’

তথ্যচিত্র মুক্তি পাচ্ছে কবে? পরিচালক বললেন, ‘এখনই আমরা ইউটিউবে এটা ছাড়ছি না। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে পাঠাব। এ ছাড়া বিদেশের বিভিন্ন ফুটবল ফেডারেশনের কাছেও পাঠাব। ইচ্ছে আছে বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তথ্যচিত্রটি পাঠানোর। পরবর্তী সময়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকেও দেব এই তথ্যচিত্র।’

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে শনিবার প্রদর্শিত হয়েছে তথ্যচিত্রটি। নাম, ‘ফুটবল ইন ডার্কনেস’ (Football in Darkness)। প্রদীপের ফুটবল প্রেম ক্যামেরায় ধরেছেন কেশব মান্না। সম্পাদনায় রয়েছেন অরুণিমা কুণ্ডু। শব্দ পরিকল্পনা করেছেন আবদুল রাজ্জাক।

সালকিয়ায় মা ও ভাইকে নিয়ে সংসার প্রদীপের। অভাব নিত্যসঙ্গী। তবু প্রদীপ সব অনটন ভুলে যান ফুটবলে। বলছেন, ‘আমার ছটা ইন্দ্রিয় আছে আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হল ফুটবল। আমি যখন ছোট ছিলাম, ফুটবল হাতে নিয়েই খেলাটাকে ভালবেসে ফেলি। আমার বাবা পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন। সেই থেকে ইস্টবেঙ্গলের ভক্ত।’ যোগ করলেন, ‘১৯৯৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে ফেডারেশন কাপে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে আমার প্রথম স্টেডিয়ামে যাওয়া। তারপর থেকে কলকাতায় ও সল্ট লেক স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গলের কোনও ম্যাচ মিস করিনি। আমার সঙ্গে লাঠি রয়েছে যা রাস্তাঘাটে হাঁটাচলায় সাহায্য করে। আমার কোচিং ক্যাম্পের কেউ হয়তো ম্যাচের ধারাবিবরণী দিয়ে দেয়।’

শুনলে চমকে উঠতে হয় যে, হতদরিদ্র প্রদীপ নিজের এলাকায় একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিও চালান। সৌম্যজিৎ স্পোর্টস অ্যাকাডেমি। এখন যে শিবিরে ৩৪ ফুটবলার রয়েছে। ধারাবিবরণী দেওয়ার জন্য রয়েছেন একজন। তাঁর ধারাবিবরণী শুনেই উঠতি ফুটবলারদের নির্দেশ দেন প্রদীপ। তাঁর স্বপ্ন, অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা কেউ বড় ক্লাবে খেলুক।

(Feed Source: abplive.com)