স্থানীয় ম্যাচে গড়াপেটার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ কোহলির সতীর্থের, রিপোর্ট চেয়ে পাঠাল সিএবি

স্থানীয় ম্যাচে গড়াপেটার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ কোহলির সতীর্থের, রিপোর্ট চেয়ে পাঠাল সিএবি

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বুধবার রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রথম বিস্ফোরণটা ঘটান যিনি, এক সময় তিনি বিরাট কোহলিদের (Virat Kohli) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের উইকেটকিপার ছিলেন। বাংলার হয়ে দীর্ঘদিন ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। কলকাতা নাইট রাইডার্স (KKR) থেকে শুরু করে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের মতো দলের হয়ে আইপিএলে (IPL) খেলেছেন। তিনি, শ্রীবৎস গোস্বামী, ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। যা দেখলে চমকে উঠতে হয়।

কী রয়েছে সেই ভিডিওতে? একটি ম্যাচের ফুটেজ তুলে ধরেন শ্রীবৎস। সিএবি-র স্থানীয় ক্রিকেটের সুপার ডিভিশন লিগে টাউন ক্লাব বনাম মহমেডানের ম্যাচের ভিডিও। সেখানে দেখা যাচ্ছে, টাউন ক্লাবের বোলারদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসছেন মহমেডানের ব্যাটাররা। আউট হওয়ার ধরন দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হতে পারে! কোনও ক্ষেত্রে বোলার ডেলিভারি করার পর ব্যাটার ইচ্ছাকৃতভাবে বল না খেলে ব্যাট তুলে বোল্ড হচ্ছেন। তো পরের বলেই বল ব্য়াটে লাগানোর কোনও চেষ্টা না করে ব্যাটার স্টেপ আউট করে স্টাম্পড হচ্ছেন!

সেই ভিডিও পোস্ট করে শ্রীবৎস লেখেন, ‘কলকাতা ক্লাব ক্রিকেটে সুপার ডিভিশনের ম্যাচ। দুটি বড় দল এই কাজ করছে। কোনও ধারণা আছে কারও কী হচ্ছে? আমার দেখে লজ্জা লাগছে যে, এই খেলাটা আমিও হৃদয় দিয়ে খেলেছি। আমি ক্রিকেট ভালবাসি ও বাংলার হয়ে খেলা উপভোগ করেছি। কিন্তু এটা দেখে মন ভেঙে যাচ্ছে। ক্লাব স্তরের খেলা বাংলা ক্রিকেটের কাঠামো, এটাকে ধ্বংস করবেন না। এটাকেই গড়াপেটা বলে।’

পরে এবিপি আনন্দকে শ্রীবৎস বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে এখনই এ ব্যাপারে সরব হওয়া উচিত। আমরা যেটুকু যা পরিচিতি পেয়েছে, বাংলার এই ক্লাব ক্রিকেট খেলেই তার শুরুটা হয়েছিল। স্থানীয় ক্রিকেটকে পরিচ্ছন্ন করে তোলা দরকার এখনই।’

ময়দানে গড়াপেটার অভিযোগ ওঠে ভুরি ভুরি। বিশেষ করে দ্বিতীয় ডিভিশনে টাকার বিনিময়ে ক্রিকেটার খেলানো থেকে শুরু করে বয়স ভাঁড়ানো, ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার মতো অভিযোগ প্রত্যেক মরশুমেই ওঠে। কয়েকদিন চর্চা হয়। তারপর থিতিয়েও যায়। কিন্তু ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জেতা কোনও ক্রিকেটার এভাবে ভিডিও পোস্ট করে গড়াপেটার অভিযোগ করছেন, সাম্প্রতিককালে এরকম ঘটনা ঘটেনি। যা শোরগোল ফেলে দিয়েছে স্থানীয় ক্রিকেটে। নড়েচড়ে বসেছে সিএবি-ও।

ঘটনাটি টোয়েন্টি টু ইয়ার্ডস মাঠে (ময়দানে যা ভিডিওকন মাঠ নামে পরিচিত)। যেখানে সুপার ডিভিশন লিগের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল টাউন ক্লাব ও মহমেডান। অভিযোগ, টাউন ক্লাবকে ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছে মহমেডান। ম্যাচটি ড্র হয়। প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়ার সুবাদে ৭ পয়েন্ট পায় টাউন ক্লাব। ৩ পয়েন্ট মহমেডানের। টাউন ক্লাবের সর্বময় কর্তা আবার সিএবি-র যুগ্মসচিব দেবব্রত দাস। অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যাচটি ছেড়ে দেয় মহমেডান। এমনকী, তারা নিশ্চিত করে যাতে, ড্র ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭ পয়েন্টই পায় টাউন।

সিএবি-র নিয়ম হচ্ছে, ড্র ম্যাচে প্রথম ইনিংসের লিড পেলে কোনও দল ৭ পয়েন্ট ও অপর দল ৩ পয়েন্ট পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে যদি অপর দল আড়াইশো রান করে দেয়, তাহলে তারা বাড়তি এক পয়েন্ট বোনাস হিসাবে পাবে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে লিড নেওয়া দল পাবে ৬ পয়েন্ট। আর প্রতিপক্ষ দল পাবে ৪ পয়েন্ট। একইভাবে যদি লিড নেওয়া দল বিপক্ষের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট তুলে নিতে পারে, তাহলে তারা বাড়তি এক পয়েন্ট বোনাস হিসাবে পায়। ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে টাউন ক্লাব তুলেছিল ৪৪৬ রান। মহমেডান প্রথম ইনিংসে তোলে ২৮১/৯। ফলো অন করে দ্বিতীয় ইনিংসে তোলে ৩৭০/৫। সেঞ্চুরি করেন জয়জিৎ বসু ও অভিজিৎ সিংহ। দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেন জয়জিৎ। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর খেলা যখন প্রায় শেষের দিকে, ব্যাটিং চালিয়ে যায় মহমেডান। পঞ্চম উইকেটও হারায়। তাতে বোনাস-সহ ৭ পয়েন্ট পায় টাউন ক্লাব। অভিযোগ, টাউনকে বাড়তি এক পয়েন্ট দিতে ইনিংস টেনে নিয়ে যায় মহমেডান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ম্যাচ চালাকালীন ছন্দে থাকা ব্যাটারদের রিটায়ার্ড হার্ট বলে বারবার তুলে নিয়েছে মহমেডান। এমনকী, যে ব্যাটারের ইচ্ছাকৃত বোল্ডের ভিডিও পোস্ট করেছেন শ্রীবৎস, তিনি নিজেও নাকি পরে আক্ষেপ করেছেন। এবং অসহনীয় পরিস্থিতিতে তিনদিনের ম্যাচের পরের দিকে মাঠেও আসেননি বিরক্ত সেই ক্রিকেটার। যিনি এক সময় বাংলার হয়েও খেলেছেন।

কিন্তু কেন এরকম ম্যাচ ছেড়ে দিল ময়দানের অন্যতম প্রধান ক্লাব মহমেডান? বিশেষ করে যুযুধান দুই দলই যেখানে পরের পর্বের ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে? কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরনোর মতো প্রকাশ্যে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। বলা হচ্ছে, সমস্যার মূলে মহমেডান ক্লাবের এক বাঁহাতি স্পিনার। নাম, হর্ষিত পটেল। তিনি গত মরশুমেও হরিয়ানার হয়ে খেলেছেন। নিয়ম হচ্ছে, ভিন রাজ্যের কোনও ক্রিকেটার বাংলার কোনও ক্লাবের হয়ে খেলতে চাইলে ৩১ অগাস্টের মধ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সংস্থা থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (NOC) এনে তা সিএবি-তে জমা দিতে হবে। হর্ষিতের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। তিনি নাকি চলতি মরশুমে ৩-৪টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। অভিযোগ, টাউন ক্লাবের কর্তা মহমেডানকে জানায় যে, যদি তাদের ম্যাচ ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে ওই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ দায়ের করা হবে না। সেই শর্তেই নাকি ওই ক্রিকেটার খেলেন।

তবে পরে টাউন ক্লাব ওই ক্রিকেটারকে অবৈধভাবে খেলানো হচ্ছে, সেই অভিযোগ দায়ের করেছে সিএবি-তে। যা দেখে অনেকে বলাবলি করছেন, ম্যাচ গড়াপেটার খবর প্রকাশ্যে চলে আসায় মুখ বাঁচাতে অভিযোগ করেছেন টাউন ক্লাবের কর্তা। কোনও কোনও মহল থেকে ওই প্রভাবশালী কর্তার পদত্যাগও দাবি করা হচ্ছে।

স্থানীয় ক্রিকেটের বিতর্কিত এই ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন প্রেমদীপ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ ও কাজল মুখোপাধ্যায়। পর্যবেক্ষক ছিলেন যশবন্ত বিশ্বাস। সিএবি থেকে তাঁদের কাছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সিএবি প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় এবিপি আনন্দকে বললেন, ‘গোটা ঘটনার কথা শুনেছি। যাঁরা মাঠে ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, সেই পর্যবেক্ষক ও আম্পায়ারদের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি। শনিবার, ২ মার্চ টুর্নামেন্ট কমিটির বৈঠক ডেকেছি। সেদিন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গোটা বিষয়টা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনও অন্যায় হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে সিএবি।’

রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান নীতীশ রঞ্জন দত্ত (অনু) বললেন, ‘টাউন ক্লাব থেকে মহমেডানের এক ক্রিকেটার ভিন রাজ্যের বলে ম্যাচের প্রথম দিনই অভিযোগ জমা পড়েছিল। আমরা সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখব। শনিবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ আর গড়াপেটার অভিযোগ? অনু দত্ত বলছেন, ‘আমরা সতর্ক করতে পারি। আম্পায়ার ও অবজার্ভারদের রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

ময়দানে কিন্তু সঠিক, নিরপেক্ষ তদন্ত ও কড়া পদক্ষেপের দাবি উঠতে শুরু হয়ে গিয়েছে।

(Feed Source: abplive.com)