‘ইউজ অ্যান্ড ফাইল’ পদ্ধতিতে অভিনব বিমা পণ্য আসবে, তবে সাবধান হতে হবে দ্বিগুণ

‘ইউজ অ্যান্ড ফাইল’ পদ্ধতিতে অভিনব বিমা পণ্য আসবে, তবে সাবধান হতে হবে দ্বিগুণ

ভারতীয় বিমা শিল্পের ক্ষেত্রে এবার এক বড়সড় পরিবর্তন- নতুন পরিকাঠামো আনা হচ্ছে। এর ফলে খুব শীঘ্রই, স্বাস্থ্য এবং সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলি ভারতের বিমা নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর পূর্বানুমতি ছাড়াই তাদের পণ্যগুলি বাজারে আনতে সক্ষম হবে৷ আপাতদৃষ্টিতে লাভ সংস্থার বলে মনে করা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে নতুন এই নিয়মের ফলে সংস্থাগুলো যখন খুশি আর বিমার প্রিমিয়াম বাড়াতে পারবে না! বিষয়টি ভালো করে বুঝে নেওয়া যাক এক এক করে!

কোন কোন খাতে নতুন নিয়ম লাগু হবে?

নতুন পরিকাঠামোয় আগুন, মোটর, সামুদ্রিকের মতো সাধারণ বিমা এবং স্বাস্থ্য বিমা উভয় বিভাগেই প্রযোজ্য হবে। দেশ জুড়ে বিমার ব্যবহার আরও বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ বলে মনে করছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি। এই প্রসঙ্গে বিমা নিয়ন্ত্রক এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বর্তমান ব্যবস্থা থেকে সরে এসে এমন একটা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন যেখানে পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই বিমা পণ্যগুলি চালু করা যাবে। এর ফলে বিমা খাতে ব্যবসা করা আরও সহজ হবে’।

ইতিমধ্যেই ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (IRDAI) সমস্ত স্বাস্থ্য বিমা পণ্য এবং প্রায় সমস্ত সাধারণ বিমা পণ্যগুলির জন্য ইউজ অ্যান্ড ফাইল পদ্ধতি চালু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘গোটা দেশকে বিমার আওতায় আনার পথে এটা প্রথম পদক্ষেপ’। এই সিদ্ধান্ত কতটা সফল হবে সেটা সময়ই বলবে। তবে বিমা ক্ষেত্রে যে নতুন যুগের শুরু হল সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ রইল না।

নিয়ম সহজ হওয়ায় পণ্যে কতটা অভিনবত্ব আসতে পারে?

আইআরডিএআই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা আশা করে যে বিমা শিল্প এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে পলিসিধারীদের পছন্দ অনুযায়ী আরও বেশি কাস্টমাইজড এবং উদ্ভাবনী পণ্য বাজারে নিয়ে আসবে। প্রত্যাশিতভাবে বিমা কোম্পানিগুলি এই সংস্কারকে স্বাগত জানিয়েছে। রিলায়েন্স জেনারেল ইনস্যুরেন্সের এমডি এবং সিইও রাকেশ জৈন বলছেন, ‘এই পদক্ষেপ গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী নিত্যনতুন পণ্য উদ্ভাবন করতে আরও উৎসাহিত করবে। পাশাপাশি দেশ জুড়ে বিমার প্রচলনও বাড়বে’।
পৃথক বিমা পণ্য এবং খুচরো বিমা ক্ষেত্রে এটা নয়া পদক্ষেপ হলেও গ্রুপ বিমা পণ্যগুলির ক্ষেত্রে বিমাকারীরা ইতিমধ্যেই ইউজ অ্যান্ড ফাইল সিস্টেম অনুসরণ করছে। এখন এটা অ্যাড-অন কভার, পাইলট এবং কম্বি পণ্য সহ খুচরো পণ্যগুলোতেও প্রযোজ্য হবে। স্টার হেলথ অ্যান্ড অ্যালাইড ইনসুরেন্সের ডা. এস প্রকাশ বলছেন, ‘নতুন ফাইলিং এবং নীতি পরিবর্তন বা সংশোধন উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিমাকারীদের এখন লঞ্চের সাত দিনের মধ্যে পণ্য ফাইল করতে হবে। নতুন নির্দেশিকায় বিমা ইন্ডাস্ট্রিকে আরও দ্রুত পণ্য চালু করতে সাহায্য করবে’।

কীভাবে এই নতুন নিয়ম সময়ের সাশ্রয় ঘটাতে চলেছে বিমা শিল্পে?

আগে সময় মতো পণ্যের অনুমোদন পাওয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। প্রায় প্রত্যেক বিমাকারীকেই এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই নতুন কাঠামো তাঁদের কাছে যথেষ্ট স্বস্তি নিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সংস্থা অনসুরিটি-র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও যোগেশ আগরওয়াল বলছেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি একটা পণ্যের অনুমোদন পেতে কমপক্ষে এক বছর সময় লেগে যেত। কিন্তু নতুন বিজ্ঞপ্তির পর বিমাকারীরা তাঁদের পণ্যগুলি দ্রুত চালু করতে সক্ষম হবে’।

পণ্য বাজারে আনার নিয়ম সহজ হওয়ায় গ্রাহকদের জন্য অভিনব সব পণ্য বাজারে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘ইতিমধ্যেই এর ভালো দিকগুলো দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। পে অ্যাজ ইউ ইউজ-এর মতো অভিনব মোটর পলিসি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। স্বাস্থ্যকর জীবন ধারা বজায় রাখতে উৎসাহ দেয় এমন স্বাস্থ্য পণ্য মনোহরি অফার সহ বাজার আসবে’। মনে করছেন ইনস্যুরেন্স সমাধান ফার্মের চিফ অপারেটিং অফিসার শিল্পা অরোরা। এরা পলিসি হোল্ডারদের অভিযোগের সমাধান করতে সাহায্য করে।

বিমা কোম্পানিগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, কেন এই কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

বিমা কোম্পানিগুলিকে পণ্য লঞ্চ করার আরও স্বাধীনতা দেওয়ার সময়, বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা পলিসি হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখার চেষ্টা করেছে। যে পণ্যগুলি ফাইল করা, পরিবর্তিত বা সংশোধিত করা হবে তার জন্য বিমাকারীদের তাদের বোর্ড-অনুমোদিত নীতি স্থাপন করতে হবে।

এই নীতিতে বিমার প্রচলন বাড়ানো, মানুষের স্বাস্থ্য বিমার চাহিদা বৃদ্ধি, সহজ পণ্য সরবরাহের মতো বিষয়গুলিতে জোর দিতে হবে। আইআরডিএআই-এর সার্কুলার অনুযায়ী, বিমাকারীর পণ্য ব্যবস্থাপনা কমিটি নতুন পণ্যে স্বাক্ষর করার সময় বা পণ্যের পরিবর্তন করার সময় বোর্ডের নীতির সম্মতি নিশ্চিত করবে… বিমাকারীরা নিশ্চিত করবে যে পণ্যের মূল্য কার্যকর, স্ব-টেকসই এবং সাশ্রয়ী হবে’।

যদি বিমাকারীরা সার্কুলারটি অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে, তাহলে তারা নির্বিচারে প্রিমিয়াম বাড়াতে পারবে না। যে কোনও বৃদ্ধি সেই নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য কোম্পানির ব্যয়কৃত দাবি অনুপাতের উপর ভিত্তি করে (প্রিমিয়াম অর্জিত বনাম বছরে প্রদত্ত দাবি) হতে হবে। ‘বিমাকারীরা তাদের ওয়েবসাইটে মূল্য সংশোধনের দিকে পরিচালিত করে এমন পণ্যের অন্তর্নিহিত দাবির অভিজ্ঞতা (ব্যয়কৃত দাবির অনুপাত) সহ মূল্য সংশোধনের যৌক্তিকতা প্রকাশ করবে’, বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
এই নিয়মগুলি মেনে চলতে ব্যর্থ হলে বিমা কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও করা হবে বলে জানিয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিছু সময়ের জন্য বিমাকারীকে দেওয়া সুবিধাগুলি ফিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি তাদের পণ্য প্রত্যাহার করতেও বলা হতে পারে। বলা হয়েছে, ‘আইআরডিএআই দ্বারা জারি করা আরও নির্দেশিকা থাকবে, যেখানে নীতি নির্ধারন, পণ্য পরিচালনা কমিটি, অ্যাকচুয়ারিয়াল টিম এবং বোর্ডের ভূমিকা ও দায়িত্বের বিশদ বিবরণ দেওয়া থাকবে’।

পলিসি হোল্ডারদের আরও সতর্ক থাকতে হবে, না হলে কোন দিক দিয়ে ঠকে যেতে পারেন তাঁরা?

বিমাকারীরা এই পদক্ষেপে স্বাভাবিকভাবেই খুশি। এবং এর ফলে পলিসিধারীদের জন্য আরও ভালো পণ্য বাজারে আসার সম্ভাবনাও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। তবে যেহেতু আইআরডিএআই-এর পূর্বানুমতি ছাড়াই পণ্যগুলি লঞ্চ করা হবে তাই এখন থেকে গ্রাহক বা পলিসি হোল্ডারদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। শর্তাবলী মনোযোগ দিয়ে অবশ্যই পড়তে হবে।

বর্তমানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিটা বিমা পণ্য ঝাড়াই-বাছাই করে। তারপরেও পলিসি হোল্ডারদের অভিযোগের অন্ত নেই। যেহেতু বিমাকারীরা এখন আরও বেশি সুযোগ পাবে, তাই আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে এবং কোনও মধ্যস্থতাকারীর সুপারিশ অনুসরণ করার পরিবর্তে নিজেকে পণ্যটি বুঝতে হবে।

আইআরডিএআই-এর এই পদক্ষেপ সম্পর্কে বাজাজ আলিয়াঞ্জের জেনারেল ইনস্যুরেন্স এমডি এবং সিইও তপন সিংঘল বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা কোম্পানিগুলোকে কিছু প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া প্রদান করবে যাতে কম সময়ের মধ্যে বাজারে আরও উদ্ভাবনী পণ্য আনা সম্ভব হয়’। সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘ইউজ অ্যান্ড ফাইল পদ্ধতির মূল অর্থ হল বিমাকারীরা তাঁদের পণ্য বাজারে আনবে একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও সেই পণ্য সম্পর্কে জানাবে। এতে বিমার অনুমোদন পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে না’।

সিকিওর নাউ-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা কপিল মেহতা বলেছেন, আইআরডিএআই-এর এই সিদ্ধান্ত বিমাকারীদের বিভিন্ন পণ্য আরও দ্রুত চালু করতে উৎসাহিত করবে। এডেলউইস জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের নির্বাহী পরিচালক এবং সিইও সানাই ঘোষ বলেছেন, ‘এই ঘোষণাটি বিমাকারীদের ক্ষমতায়ণ করেছে কারণ পণ্য অনুমোদন এবং লঞ্চের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সহজ করা হয়েছে’। সঙ্গে তিনি যোগ করেছেন, ‘যদিও এই পদক্ষেপটি উদ্ভাবনী পণ্যগুলির দ্রুত প্রবর্তনের জন্য। বিমাকারীদের এখন পলিসিধারক সুরক্ষার পাশাপাশি শক্তিশালী পণ্য বিকাশ এবং মূল্য নিশ্চিত করতে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে’।

পরিবর্তিত নির্দেশিকা অনুসারে, আইআরডিএআই সাধারণ বিমাকারীদের খুচরো এবং বাণিজ্যিক উভয় বিভাগের জন্য ‘ইউজ অ্যান্ড ফাইল’ পদ্ধতির আওতায় সমস্ত পণ্য ফাইল করার অনুমতি দিয়েছে। আইআরডিএআই বলেছে, সাধারণ বিমা পণ্যের ডিজাইন এবং মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবং সাধারণ বিমা ব্যবসা পরিচালনায় দক্ষতার প্রচারের ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদার সঙ্গে দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য এটি করা হয়েছে।

অন্য একটি সার্কুলারে, নিয়ন্ত্রক বলেছে যে সমস্ত ক্যাটাগরির পণ্য এবং অ্যাড-অন বা রাইডার স্বাস্থ্য বিমা ব্যবসার অধীনে চালু বা পরিবর্তিত/সংশোধন করা হবে এবং সাধারণ এবং স্বাস্থ্য বিমা কোম্পানিগুলি দ্বারা অফার করা হবে ‘ইউজ অ্যান্ড ফাইল’। নিয়ন্ত্রক আরও বলেছে যে এই উদ্যোগের ফলে বিমা শিল্প সময় মতো উপযুক্ত পণ্য চালু করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

Published by:Arpita Roy Chowdhury

(Source: news18.com)