কলকাতা: ভারতের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে চায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (BNP)। ২ দশক ধরে আওয়ামি লিগের শাসনকালে যে সম্পর্কের সুতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এবিপি লাইভকে এমনটাই জানালেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-এর সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির। এর সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁকে পালাতে বাধ্য করা একটি দেশের সেই সদিচ্ছাকে নয়া দিল্লি দেখতে চাইছে না বলে ‘উদ্বেগ’ রয়েছে তাঁদের।
ঢাকার বাসভবন থেকে বরিষ্ঠ এই বিএনপি নেতা জানাচ্ছেন, তাঁর দল ক্ষমতায় থাকার সময় সর্বদা ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তবে এখন ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। তিনি জানাচ্ছেন, ভারতের ক্ষেত্রে সবসময় একটি ‘ভয়’ কাজ করেছে, যেহেতু ইসলামি মৌলবাদী দল জামাত-এ-ইসলামির সঙ্গে বিএনপির জোট ছিল, যেটা এখন আর নেই। আলমগির বলছেন, ‘বিএনপি সবসময় ভারতের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক চায়। কিন্তু আমি জানি না কেন কিছু কারণে, হয়তো দূরত্ব … সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল (বাংলাদেশে) এবং একটি পরিবারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই কারণেই এই দেশের বেশিরভাগ মানুষের ভারত সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে।’ এই প্রবীণ বিএনপি নেতাকে গত বছরের অক্টোবরে নির্বাচনের ঠিক আগে আটক করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। তাঁর দাবি, ‘আমরা সবসময় ভারতের সঙ্গে একটি ভাল সম্পর্ক চেয়েছি এবং অতীতে আমাদের তা ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করার এই ধরনের ভারতীয় কূটনীতি এদেশের মানুষ পছন্দ করে না।’ এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচনের কথা তুলে আলমগির জানাচ্ছেন,
২০১৯ ও ২০২৪ সালের ২টি নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের মানুষজন ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এর সঙ্গেই তাঁর বার্তা, ‘বাংলাদেশের মানুষের সেদেশের নির্বাচন এবং সেথানে ক্ষমতায় থাকা দলের প্রতি ভারতের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তাই ভারতের সেই ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উচিত। ভারতকে এমন কাজ করতে হবে যাতে বোঝা যায় তারা মানুষের রাজনৈতিক ইচ্ছাকে সম্মান দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়।’ তিনি আরও জানান যে বাংলাদেশের মানুষ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাঁরা চায়, ‘নির্বাচনের সময় একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকুক যাতে মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়।’
‘হাসিনা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ’
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলন এবং তারপরে সেটা গণবিক্ষোভে পরিণত হওয়ার পরে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। প্রথমে ছাত্র আন্দোলনটি সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়দের জন্য নির্দিষ্ট কোটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারিতার কারণে এটি একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। বিক্ষোভের উপর সরকারের দমন-পীড়নের কারণে সেই ক্ষোভ আরও বেড়েছিল।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর গৃহীত প্রথম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্য়তম ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার মুক্তি, যিনি গৃহবন্দী ছিলেন। আলমগির বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছিল। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে আমরা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করতাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগ যখন ২০১২ সালে ক্ষমতায় এল তখন তারা দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে দিল। আর সেটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ম বাতিল করার জন্য হাসিনার একতরফা সিদ্ধান্ত। সকল সমস্যা তখন থেকেই শুরু হয়েছিল এবং সেই সময় থেকেই স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়া শুরু হয়েছিল।’ তাঁর সংযোজন, ‘এটি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বিচলিত করেছিল। তখন থেকেই অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আমরা তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই শুরু করেছিলাম।
২০১৬ সালে, বিএনপি একটি ‘ভিশন ২০৩০’ নথি নিয়ে এসেছিল যা ক্ষমতায় ফিরলে বিএনপি দেশের জন্য কী করবে তার একটা রোডম্যাপ। ‘আমরা জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করব। আমরা একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা চেয়েছিলাম এবং একই সঙ্গে আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হোক। আমরা বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও সংস্কার চেয়েছি। মূলত, এমন সংবিধান হওয়া উচিত যা জনগণের প্রয়োজন।’
তিনি সাফ জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারেন তবে তাঁকে তাঁর কাজের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। আলমগির বলছেন, ‘দিল্লিতে বসে হাসিনা তাঁর দলের সদস্যদের এবং অন্যদের বার্তা দিচ্ছেন যে তিনি ফিরে আসবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেবেন। আমি মনে করি তিনি একটি নতুন ফ্যাসিবাদী ধারণা নিয়ে ফিরবেন। বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের ফ্যাসিবাদ প্রত্যাখ্যান করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন যদি তিনি গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরে আসেন, তাহলে তিনি আসতে পারেন। কিন্তু তাহলেও তিনি যে জাতিকে ধ্বংস করেছেন, অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন, লুঠ করেছেন এবং নির্মম হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছেন তার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন। তার জবাবদিহি করতে হবে। তিনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।’
‘একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উঠে এসেছে’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়া চালানোর বিষয়ে বিএনপির এই প্রবীণ নেতা বলেন, নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূস যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, তাঁর নেতৃত্বে দেশকে আগে স্থিতিশীল করতে হবে।
আলমগীরের মতে, বিগত দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনও হাসিনার সরকার ‘দখল’ করে নিয়েছিল, ওটাও ‘দলীয়’ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘আমরা জানতান যে তাঁর অধীনে অনুষ্ঠিত কোনও নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না, তাই বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হাসিনা এটাও নিশ্চিত করেছেন যে, নির্বাচনের ঠিক আগে তিনি আমাদের দলের সদস্যদের আটক করবেন। তাহলে এ ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কর যাবে কীভাবে? … গত নির্বাচনে খোদ আওয়ামী লীগ আমাদের ২৭ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল।’
আলমগিরের মতে, ‘গণ অভ্যুত্থানের ফলে একটি বিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন করতে সক্ষম হবে এবং সব রাজনৈতিক দল তাদের সেই সময় দেবে> এটি তিন মাস হতে পারে বা এটি এক বছর হতে পারে। কিন্তু এটা ঘটবে। কারণ মানুষ চায় নির্বাচন হোক এবং তাই হবে।’ তিনি আরও জানান, বিএনপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কিন্তু সেটি তাঁর স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করবে। তাঁর লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান, যিনি বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, তিনিও প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আলমগিরের মতে, ‘বেগম খালেদা জিয়া দেশের একজন ক্যারিশম্যাটিক নেত্রী। তিনি তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বড় ব্যবধানে নির্বাচিত হন। তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে সম্পূর্ণ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তাঁকে মিথ্যে মামলায় হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।’ খালেদা জিয়া এখন মুক্ত হলেও অসুস্থ। সুস্থ হলে তিনি দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবেন বলে জানান আলমগির। আর সেটা না হলে সেক্ষেত্রে তারেক রহমান আছেন।
খালেদা জিয়া সর্বশেষ বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ২০১২ সালে ভারত সফর করেন। ভারতে তার শেষ সরকারি সফর ছিল ২০০৬ সালে যখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
‘জামাতের সঙ্গে জোট নয়’
জামাতের মতো মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে বিএনপির প্রবীণ নেতা আলমগির জানান, জামাতের সঙ্গে তাঁদের আর কোনও জোট নেই। তবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রশ্নে তারা ঐক্যবদ্ধ রয়েছে বলেও জানান তিনি। আলমগির বলছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, ভারতে সবসময় একটা ভয় থাকে যে বিএনপি ও জামাত সবসময় একসঙ্গে থাকে। কিন্তু তা নয়। সত্যি বলতে, বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক দল এবং জামাত তাদের নিজস্ব আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি ভিন্ন রাজনৈতিক দল। আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। শুধুমাত্র ২০০১ সালে আমরা একটি জোট গঠন করেছি।’ তিনি আরও জানান, এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির কোনও জোট নেই। তবে, ‘হাসিনার দলকে পরাজিত করে ক্ষমতা থেকে তাড়ানোর প্রশ্নে বিএনপি ও জামাত ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং আছে। আমরা সবাই এখন চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।’
(Feed Source: abplive.com)