#কলকাতা: পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কিন্তু সেই সেতুর সঙ্গে কী ভাবে যেন একটা জড়িয়ে গিয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও। হয়ত অনেক দূরত্বে তাঁর এই সংযোগ গড়ে উঠেছে, কিন্তু তবু, যেন পদ্মা সেতু তৈরির একটা সুপ্ত আগুন জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। বাংলাদেশের এই অমোঘ সাফল্যের দিনে সেই কথাই মনে করছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম।
পদ্মা সেতুর প্রধান কারিগর ও পথপ্রদর্শকদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরী। প্রয়াত এই অধ্যাপক ছিলেন পদ্মা সেতুর প্রধান পরামর্শক। কিন্তু কোথাও যেন তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। ঘটনা শুনতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে। শোনা যায়, ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বার শিলং বেড়াতে আসেন। সে কথা শুনে, তৎকালীন শ্রীহট্ট, যাকে বর্তমানে আমরা সিলেট নামে চিনি, সেখানে নিয়ে আসার আয়োজন শুরু করেন বেশ কিছু মানুষরা। শিলং তখন অসমের রাজধানী ও সিলেট একটি জেলাশহর।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিবাদে স্যার উপাধি ত্যাগ করা তখন মাত্র চার মাস হয়েছে। কবিকে ঘিরে উন্মাদনা রয়েছে চরমে। সেই সময়ে ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ নারায়ণ সিংহ মজুমদার, শ্রিহট্ট মহিলা সমিতির-সহ একাধিক সংগঠন কবিকে সিলেটে উপস্থিত হওয়ার আবেদন জানিয়েছে তারবার্তা বা টেলিগ্রাম পাঠায়। কবিও রাজি হয়ে যান। কিন্তু তখনও সিলেট ও শিলং সড়ক তৈরি হয়নি। ফলে আসতে হত ঘুরপথে। চেরাপুঞ্জি,ও থারিয়াঘাট হয়ে, খাসিয়া পাহাড়ের নিচে নেমে যেতে হত সিলেট। এর কিছুটা পথ গাড়িতে ও বাকি পথ যেতে হত মানুষের পিঠে চড়ে। অনেক পাহাড়ি অঞ্চলেই এই পদ্ধতি ছিল। যাকে কেতাবী ভাষায় বলা হয়ে যাতে থাপা। মাথায় ফেট্টির মতো বাঁধন দিয়ে একটা বেতের চেয়ার বা ঝুড়ির মতো বসার জায়গায় যাত্রীকে বসিয়ে সেই দুর্গম রাস্তা পার করতেন বাহক।
এই নিদারুণ কষ্টের যাত্রা পথে এক জন মানুষকে ততোধিক কষ্টের মুখে ফেলে, তাঁর কাঁধে চেপে পাহাড় পার হতে সম্মত হননি রবীন্দ্রনাথ। কবি মন মানুষের কাঁধে চড়ে রাস্তা পার হতে সায় দেয়নি। তিনি নাকি বলেছিলেন, বরং দরকার হলে দশ মাইল হেঁটে যাব তবু মানুষের কাঁধে চড়ব না। তাই বিপুল রাস্তা ঘুরে গৌহাটি-লামডিং-বদরপুর-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌঁছন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবির এই পদক্ষেপ নাড়িয়ে দেয় প্রশাসনকে। যে কষ্টের কথা রবীন্দ্রনাথের এই অস্বীকারে ছিল, তা ভাবিয়ে তোলে। ফলে তার পরেই সিলেট-শিলং সরাসরি সড়ক পথ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
সেই সময়ের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী সিলেটের বুরঙ্গা গ্রামের বসন্তকুমার দাস এই নিয়ে উদ্যোগ নেন। কিন্তু পাথুরে উমগট নদীর রাস্তা ও জযন্তিয়া পাহাড়কে যুক্ত করা কার্যত অসম্ভব কাজ ছিল। সেই সময় আবিদ রেজা চৌধুরীর ডাক পড়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য। তিনি তখন শিলংয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়র হিসাবে কাজ করছেন। ১৯৩০ সালে, আবিদ রেজার নকশা ও নির্দেশনায় তৈরি হয় এই বিশেষ সেতু। এর প্রয়োজন ছিল হয়ত দীর্ঘদিনের, কিন্তু কবির পদক্ষেপেই শেষ পর্যন্ত অসম্ভব সম্ভব হল।
এ তো গেল আগের গল্প, এর সঙ্গে পদ্মা সেতুর যোগ কী! আছে, এই আবিদ রেজা চৌধুরী, যাঁর নকশা ও নির্দেশনায় শিলং ও সিলেটের দুর্গম রাস্তায় সেতু তৈরি হয়েছিল, যাঁকে সেতু নির্মাণের পথে চালিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই আবিদের সন্তানের নাম জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি হলেন পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রধান পরামর্শক। তাঁর ইন্ধনেই খরস্রোতা পদ্মার উপর দীর্ঘ পথের সেতু বানানো সম্ভব হল বাংলাদেশে। এই পিতা-পুত্র ও আড়ালে থাকা রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিই তা হলে তৈরি করল একের পর এক ইতিহাস!
ঋণ
১. সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষের স্মৃতি ও সাহিত্য. চৌধুরী মুফাদ আহমদ
২. মনিপুরি নৃত্য বিকাশে রবীন্দ্রনাথ, ডা. আতিউর রহমান