জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো : বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালির কি ইদানীং কোনও চোরা লড়াই চলছে? নাকি বাঙালি না বুঝেই বাংলা ভাষার সঙ্গে একটা দ্বৈরথে নেমে পড়েছে? নইলে এত সাধারণ সহজ ভুলভ্রান্তি বারে বারে হচ্ছে কেন? এরকমই কিছু প্রশ্ন জমেছে কবি শ্রীজাত-র মনে। সেই প্রশ্নের উত্তরে খুঁজতেই নতুন শো ‘বাংলা বনাম বাঙালি’ নিয়ে হাজির শ্রীজাত। কবির সঙ্গে রবিবারের আড্ডায় হাজির ছিলেন দুই লেখক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য এবং সংগীতশিল্পী, পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্রীজাতর আলোচনায় উঠে এল বাংলা ভাষার মধ্যে প্রতিনিয়ত হিন্দি ঢুকে পড়ার প্রসঙ্গ। উঠে এল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এতকিছু নিয়ে প্রতিবাদ হয়, তবে বাংলা ভাষার ভুল বলা, কিংবা ব্যবহার নিয়ে প্রতিবাদ হয়না। এবিষয়ে চন্দ্রিল বলেন, ‘ আসলে বাঙালি জাতির ক্রোধ খুব একটা হয়না। তবে যে মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া এল, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকদিন রেগে ওঠার যেন দায় তৈরি হয়ে গেছে বাঙালিদের। নইলে লাইক পাওয়া যাবে না। এখন এটাই চলছে। দেখাতে হবে, আমি প্রতিবাদী, আমি গালাগাল দিতে পারি। এই যে রাগের জোয়ার আসলে দেখনদারি। আসলে কিন্তু কুঁড়েমি। তবে একটু বিপ্লব তো দেখাতেই হয়, এমন একটা ভাব। তবে বাংলা নিয়ে কোরার কোনও রাগ নেই। বহু বাঙালিই বাংলা ভাষাটা ঠিক করে শেখেন না। বাংলা ভাষার প্রতি সেই ভালোবাসাটাই তাঁদের তৈরি হয়নি। ব্যাকারণ ক্লাসে হয়ত কাটাকুটি খেলতেন। রবীন্দ্রনাথের লোকহিত প্রবন্ধটি শক্ত বলে পড়েননি, এমন বহু বাঙালিই রয়েছেন। একটা অনীহা চিরকালই রয়েছে।’
প্রসঙ্গক্রমে শ্রীজাত বলেন, ‘আমাদের তো ছোট থেকে বাংলা ভাষাটা শেখাতে হয়নি। সুস্থ বাংলা বলার জন্য যে খুব বেশি প্রয়াস করতে হয়েছে তাও নয়।’ এবিষয়ে চন্দ্রিল বলেন, আসলে সেসময় এত বেশি করে হিন্দি ঢুকে পড়েনি। চারপাশে সকলে বাংলাই শুনতেন। হিন্দি জনপ্রিয় ছিল, তবে ঘরে ঘরে ঢোকেনি। হিন্দির মতো করে বাংলা বলতে হবে এটা কেউ ভাবতেও পারতেন না। ‘কান খুলে শুনে নাও’ এই উদ্ভট বাংলা তখন কেউ বলতেনও না। আজকাল হিন্দি ভাষার ছবি, সিরিয়াল অনেক বেশি সফল, অনেক দেশে ছড়িয়েছে, এটা তখনও সেভাবে হয়নি। আগে শুধু বিনোদনের জন্যই হিন্দি ছবি দেখেছি, আবার তা নিয়ে হাসাহাসিও করেছি, ভেবেছি, ওটা বিনোদন, তবে প্রকৃত ছবি করেন বাঙালিরা। তখন শাম্মি কাপুরের নাচা গানা দেখলেও মনে মনে ভাবতাম সত্যজিৎ-সত্যজিত-ই।
চন্দ্রিল বলেন, একটা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে দেখলাম বলছে ‘সস্তার শ্যাম্পু ভারী পরে গেল’। ভাষা বহতা নদীর মতো। তাবলে ভারী পরে গেল! এখন কেউ বললেন, চন্দ্রিল সারাক্ষণ খনা গলায় কথা বলেন, আমাকে ‘ঝেলতে হয়’। সেই ‘ঝেলতে হয়’ টা তাও বুঝলাম, কিন্তু সস্তার শ্যাম্পু ভারী পরে যেতে পারে না। সস্তার শ্যাম্পু কিনে ঠেকে গেলেন, এটা কিন্তু বলা হল না।
এবিষয়ে অনিন্দ্যর মত, অন্যভাষা কিন্তু বাংলাকে বরাবরই হারিয়ে দিয়েছে। আগেও পুজোর সময় সারাদিন ভালো বাংলা গন চললেও রাতে ‘মার গেয়ি মুঝে তেরি জুদাই’ গানে নাচ ঠিক হবেই। তাঁর কথায়, চিরকালই হিন্দি কিংবা ইংরাজি বাংলার থেকে এগিয়ে, কারণ তাঁরা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। চন্দ্রিলের কথায়, যাঁরা এই বিজ্ঞাপনের জন্য লেখার দায়িত্ব দিচ্ছেন, তিনি ঠিকঠাক বাংলা ভাষা জানা লোককে দায়িত্বও দিচ্ছেন না, ‘তুই যা জানিস তা দিয়ে চালিয়ে দে তো’।সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। বাংলা ভাষা জানেন এমন মানুষের কাছে এত অর্থ নেই, যে তাঁরা লগ্নী করতে পারেন। মাঝে চন্দ্রিল বলেন, এনিয়ে সোশ্য়াল মিডিয়ায় কিন্তু প্রতিবাদ হবে না।
অনিন্দ্যর কথায়, আসলে বাংলা ব্যবহারিক ভাষা হয়ে ওঠেনি। সেটাও একটা ঝামেলার জায়গা। কথায় কথায়, চন্দ্রিল বলেন, আজকাল শিলাজিৎ ছাড়া কে আছেন যে গাড়ির নম্বর বাংলায় লেখেন, বা সই করেন। ঠিক সেসময়ই শ্রীজাত বলেন আমার চেকবই, পাসপোর্ট, প্যানকার্ডের সই কিন্তু বাংলায়। তবে, যখন কোনও অফিস বা অন্যকোথাও ঢুকি, তখন নাম বা ঠিকানা বাংলায় লিখলে নিরাপত্তারক্ষীও অবাক হন। তবে সবশেষে অনিন্দ্য বলেন, এখন অনেক ছাত্রছাত্রীরাই কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য কথা বলছেন, প্রতিবাদী হচ্ছেন সেটাই যা একটু আশার বিষয়।
((Source: zeenews.com)