#নয়াদিল্লি: বিগত কয়েক বছর ধরে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি (Blockchain Technology)। এই টেকনোলজি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা প্রতিশ্রুতিশীল এবং বৈপ্লবিক প্রযুক্তি যা দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। কীভাবে ব্যবসা করতে হয় এই ধারণাটাকেই সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে এবং রূপান্তরিত করেছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি সহজে বোঝাতে হলে বলতে হয়, এটা অনেকটা গুগল ডকের মতো কিন্তু অনেক বেশি জটিল এবং উন্নত। এই নিবন্ধে ব্লকচেইন প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্পর্কিত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল। যেমন ব্লকচেইন প্রযুক্তি কী, এটা কীভাবে কাজ করে, কেন এটা এত জনপ্রিয় এবং ভবিষ্যতে এটা কতটা সুযোগ তৈরি করতে পারে সেই সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি কী?
ব্লকচেইন টেকনোলজি হল একধরনের ডিজিটাল লেজার টেকনোলজি যা তথ্য রেকর্ড করে। বিশেষ করে লেনদেনের তথ্য। এমনভাবে করে যাতে সেগুলো পরিবর্তন করা, হ্যাক করা, দুর্নীতি করা বা সিস্টেমে প্রতারণা করা প্রায় অসাধ্য। এই লেনদেনগুলি ব্লকচেইনে কম্পিউটার সিস্টেমের সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিতরণ এবং রেকর্ড করা হয়। অন্য ভাবে বললে, এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত বিতরণ নেটওয়ার্ক যা চেইনে ব্লকের আকারে বিভিন্ন লেনদেন রেকর্ড করে। যখনই ব্লকচেইনে কোনও নতুন লেনদেন হয় তখনই তার রেকর্ড প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর লেজারে রেকর্ড করা হয়। কারও পক্ষে এই এন্ট্রি পরিবর্তন করা সম্ভব নয় কারণ প্রত্যেক লেনদেন রিয়েল টাইমে নথিভুক্ত করা হয়। এটাই গোটা প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তুলেছে। যদি কেউ এতে সংশোধন বা বদলানোর চেষ্টা করে তাহলে তাঁকে বিতরণ সংস্করণের চেইনের প্রতিটা ব্লক পরিবর্তন করতে হবে, যা কার্যত অসম্ভব। শুধু তাই নয়, খাতায় থাকা এই লেনদেনগুলি মালিকের ডিজিটাল স্বাক্ষর দ্বারা অনুমোদিত, ফলে এটা আরও স্বচ্ছ। ফলে সিস্টেমে কেউ বদল বা পরিবর্তনের চেষ্টা করলে সেটা দ্রুত শনাক্ত করা যায়।
বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের মতো ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভিত্তিক পণ্য (যেমন বিকল্প মুদ্রা) গত কয়েক বছরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি এত জনপ্রিয় কেন?
ব্লকচেইন প্রযুক্তি এত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, এর স্বচ্ছতা এবং অপরিবর্তনীয়তা। এটি একটি বিকেন্দ্রীভূত পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক সিস্টেম যার দায়িত্বে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নেই যে অন্যান্য কেন্দ্রীভূত, ঐতিহ্যবাহী লেনদেনের মতো লেনদেন পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করবে। এই প্রযুক্তি যারা তৈরি করেছে এবং যারা ব্যবহার করছে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর কাজ করে। এটাই ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
পুরনো পদ্ধতিতে একজনের সঙ্গে অন্যজনের লেনদেন প্রক্রিয়া চালাতে সর্বদা মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল, অর্থের জন্য ব্যাঙ্ক। যখন কেউ তাঁর বন্ধু বা পরিবারের কাছে টাকা পাঠায় তখন ব্যাঙ্ক গোটা প্রক্রিয়াটার সঙ্গে জড়িত থাকে। তারা সমস্ত রেকর্ড নথিভুক্ত করে, নিরীক্ষণ করে এবং সহজেই এতে হস্তক্ষেপও করতে পারে। এটা গোটা প্রক্রিয়াটাকে দুর্বল করে তোলে। যাইহোক, ব্লকচেইন টেকনোলজিতে মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই কারণ এটা এন্ড টু এন্ড প্রযুক্তি। তাই এটা এমনই ডিজিটাল লেজার যার রেকর্ডগুলো সহজে ট্যাম্পার করা বা মুছে ফেলা যায় না। শুধু তাই নয়, এটা লেনদেনকে দ্রুত এবং নিরাপদ করে তোলে।
এই কারণেই বিটকয়েনের মতো ব্লকচেইন পণ্য ফিনান্স, সাপ্লাই চেইন, হেলথকেয়ার, উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির সুবিধা
ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক সুবিধা রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি নিচে তালিকাভুক্ত করা হল:
· এটা অত্যন্ত সুরক্ষিত: জালিয়াত মুক্ত লেনদেন করতে এই প্রযুক্তিতে ডিজিটাল সাক্ষর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোনও ব্যবহারকারীর ডেটাতে পরিবর্তন বা হেরফের করার অনুমতি না দেওয়া এটাকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।
· বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা রয়েছে: অন্যান্য ঐতিহ্যগত লেনদেনের জন্য কিছু নিয়ন্ত্রক বা কেন্দ্রীভূত সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয় যা লেনদেনগুলি পরিচালনা করে। ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে লেনদেন হয় ব্যবহারকারীর পারস্পরিক সম্মতিতে। তাই কোনও তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন এখানে হয় না।
· স্বয়ংক্রিয় এবং দ্রুত: এই প্রযুক্তিকে এমন ভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাতে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিভিন্ন কাজ এবং ইভেন্ট সম্পাদন করতে পারে। তারওপর তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ না থাকায় গোটা প্রক্রিয়াটা হয় দ্রুত, একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে।
ব্লকচেইন ডেভেলপার কারা, কীভাবে হয়ে ওঠা যায়?
ব্লকচেইন ডেভেলপাররা ব্লকচেইন প্রটোকলের পাশাপাশি আর্কিটেকচারের জন্য বিকেন্দ্রীভূত অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট এবং অপ্টিমাইজ করে। তাদের প্রতিদিনের কাজের মধ্যে রয়েছে, ব্লকচেইন প্রটোকল এবং চলমান ব্লকচেইন নোডের উপর ভিত্তি করে অ্যালগরিদম তৈরি করা, প্রোগ্রামিং করা এবং অপ্টিমাইজ করা। এঁদের দক্ষতা এবং জ্ঞান অনেকটা গেম ডেভেলপারদের মতো ৩ডি মডেলিং এবং ৩ডি বিষয়বস্তুর সঙ্গে জড়িত।
যাই হোক, ব্লকচেইন ডেভেলপারদের দ্বারা ডেভেলপ করা অ্যাপ্লিকেশনগুলি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা অন্যভাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ তারা ওয়েব ৩.০ নামে ইন্টারনেটের বিকেন্দ্রীভূত সংস্করণে কাজ করে। এটা ব্লকচেইন ডেভেলপারদের কাজকে কিছটা জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। কারণ ওয়েব ৩-এর মান সাধারণ ওয়েবের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। তাই তাঁদের বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রয়োজন। তাঁদের কাজকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
· কোর ব্লকচেইন ডেভেলপার: কোর ব্লকচেইন ডেভেলপাররা মূলত ব্লকচেইনের সঙ্গে একেবারে নিচের পর্যায়ের যোগাযোগ রাখে। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে ব্লকচেইন প্রোটোকল এবং নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার ডিজাইন, ডেভেলপ করা এবং পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি প্রোটোকল তত্ত্বাবধান করা এবং বিভিন্ন ব্লকচেইন বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়ণ করা।
· ব্লকচেইন সফটওয়্যার ডেভেলপার: ব্লকচেইন সফটওয়্যার ডেভেলপাররা মূলত ব্লকচেইন প্রযুক্তির সঙ্গে উচ্চ স্তরে যোগাযোগ বজায় রাখে। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে ব্লকচেইন ডেভেলপারদের দ্বারা তৈরি করা অ্যালগরিদমগুলিকে তাদের অ্যাপ্লিকেশানগুলিতে প্রয়োগ করা এবং অন্তর্ভুক্ত করা, ব্লকচেইন মেকানিজমগুলিতে চালিত বিকেন্দ্রীভূত অ্যাপ্লিকেশনগুলি ডেভেলপ করা, এপিআই তৈরি করা, অ্যাপ্লিকেশনগুলির ফ্রন্টএন্ড এবং ব্যাকএন্ড ডিজাইন করা এবং ডেভেলপ করা ইত্যাদি।
ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে অনেকগুলি লক্ষণীয় দক্ষতার ফাঁক রয়েছে এবং এর ডেভেলপারদের চাহিদা সর্বকালের সর্বোচ্চ। এর কারণ হল পেশাদার ব্লকচেইন ডেভেলপার হওয়ার জন্য ব্যাপক দক্ষতা এবং প্রচুর জ্ঞানের সঙ্গে অনেকগুলি প্রাক-প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। ব্লকচেইন ডেভেলপারদের জন্য সম্পূর্ণ রোডম্যাপ নিচে দেওয়া হল।
· প্রথম ধাপে রয়েছে পড়াশোনা। ব্যক্তিকে অবশ্যই কম্পিউটার সায়েন্স বা এই সম্পর্কিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। এবং অন্য যে কোনও ডেভেলপারের মতো সি++, জাভা, পাইথনের মতো মৌলিক প্রোগ্রামিং ভাষা জানতে হবে। এছাড়াও তার ডেটা স্ট্রাকচার এবং অ্যালগরিদম বুঝতে হবে। পাশাপাশি থাকতে হবে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা।
· পরবর্তী ধাপে আর্কিটেকচার এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি-সহ ব্লকচেইন প্রযুক্তির ভিত্তিগত এবং মৌলিক ধারণাগুলো জানতে হবে।
· ব্লকচেইনের মূল বিষয়গুলি বোঝার পরে, প্রয়োজনীয় ডেভেলপার টুলস এবং ব্লকচেইন প্রোগ্রামিং ভাষার জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। এর মধ্যে রয়েছে স্মার্ট চুক্তি লেখা, অ্যালগরিদম তৈরি করা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন।
· একবার ব্লকচেইন প্রোগ্রামিং শেখা হলে, পরবর্তী ধাপে বিকেন্দ্রীভূত অ্যাপ্লিকেশন তৈরি এবং ডেভেলপ করা এবং বিকেন্দ্রীভূত মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনগুলি ডেভেলপের জন্য হ্যান্ডস-অন সেশনগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই অংশে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ফ্রেমওয়ার্কের ব্যাপক ব্যবহার জড়িত। এটা সাধারণত ব্লকচেইন সফটওয়্যার ডেভেলপারের কাজের মধ্যে পড়ে।
যাই হোক, কেউ যদি ব্লকচেইন ডেভেলপার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় তবে তার জন্য কিছু নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক।
ব্লকচেইন ডেভেলপার হতে যে দক্ষতাগুলির প্রয়োজন তা নিচে দেওয়া হল:
· ডেটা স্ট্রাকচার এবং অ্যালগরিদম বোঝা: ব্লকচেইন হল ক্রিপ্টোগ্রাফির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা একটা ডেটা স্ট্রাকচার যা বিভিন্ন কাজের জন্য অ্যালগরিদমের উপর নির্ভর করে। সুতরাং এক্ষেত্রে কাজের জন্য প্রত্যেকের ডেটা স্ট্রাকচার এবং অ্যালগরিদমের ধারণা থাকা আবশ্যক।
· প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে ব্যাপক দক্ষতা: সি++, সি#, জাভাস্ক্রিপ্ট, পাইথন, রুবি বা জাভার মতো প্রোগ্রামিং ভাষাগুলি ব্লকচেইন প্রযুক্তির জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয়। সুতরাং, একজনকে অবশ্যই এই ভাষাগুলির একটি বা একাধিক বিষয়ে দক্ষ হতে হবে।
· ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পর্কে জ্ঞান: ক্রিপ্টোগ্রাফি হল বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সুরক্ষিত করার উপায় যা কোন তৃতীয় পক্ষকে জড়িত না করে ভাঙা বা বদল করা কঠিন। সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তিও ক্রিপ্টোগ্রাফির উপর ভিত্তি করে তৈরি। সুতরাং, একজন ব্লকচেইন ডেভেলপারকে এই দক্ষতায় শান দিতেই হবে।
· স্মার্ট কনট্রাক্টের সঙ্গে পরিচিতি: স্মার্ট কনট্রাক্ট হল স্ব-নির্বাহী চুক্তি, যেমন একটি প্রোগ্রাম বা স্ক্রিপ্ট যা ব্লকচেইনে চলে, মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করার সময় পক্ষগুলির মধ্যে লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের মধ্যে পরিষেবা বিনিময়ের অনুমতি দেয়। সুতরাং, এটির সঙ্গে পরিচিত থাকা সর্বদা একটি প্লাস পয়েন্ট।
অনলাইনে বিভিন্ন সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে যেগুলো ব্লকচেইন প্রযুক্তি শেখার এবং কেরিয়ার গড়তে বেছে নেওয়া যায়। এই ক্ষেত্রটি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যত গড়ার জন্য এটা চমৎকার সুযোগ হতে পারে। তাই ব্লকচেইন ডেভেলপার হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে এবং দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।