চাকরি ছাড়ার পর থাকুন সুখে-আনন্দে, অবসরকালীন জীবনকে এক নতুন দিশা দিন

চাকরি ছাড়ার পর থাকুন সুখে-আনন্দে, অবসরকালীন জীবনকে এক নতুন দিশা দিন

#নয়াদিল্লি: অধিকাংশ মানুষ ভাবে যে, চাকরি থেকে অবসর (Retirement) নিলেই একটা সুন্দর এবং ভারমুক্ত জীবন কাটানো যাবে। কিন্তু বিষয়টা সত্যিই কি তা-ই? আসলে চাকরি জীবনে ঘর এবং কাজ সামলানোর ব্যস্ততা তো থাকেই। আর সেই ভারমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন আমরা দেখি। অবসরকালীন জীবনের জন্য নিরাপদ আর্থিক পরিকল্পনা (Retirement Planning) ছকে রাখাই যায়। সেই সঙ্গে এমন কিছু উপায় আছে, যা অবসরকালীন জীবনকে আনন্দে ভরে দেবে। সেই সঙ্গে বাঁচার নতুন দিশাও দেবে। দেখে নেওয়া যাক, সেই সব উপায়।এক বার এক প্রবীণ ব্যক্তি নিজের বান্ধবীর জীবনের গল্প বলছিলেন। ভদ্রলোক বলছিলেন, তাঁর সেই বান্ধবী দীর্ঘ সময় ধরে চাকরি করার পর মাত্র ৫০ বছর বয়সেই ভিআরএস নেওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁকে জানান। ওই বান্ধবী দাবি করেছিলেন যে, তিনি টানা এত বছর ধরে চাকরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর একটু বিশ্রামের দরকার। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন সেই ভদ্রলোক। কিন্তু ভদ্রমহিলা সাফ জানিয়ে দেন যে, তিনি ভিআরএস নিলে ২৫ লক্ষ টাকা তো পাবেনই। আর যে পেনশনটা পাবেন, সেটা তাঁর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সে-ভাবে তথাকথিত অবসর না-নেওয়ার দশ বছর পর সেই ভদ্রমহিলা এখন ভাবছেন, এ-বার তাঁর কী করা উচিত।

ওই ভদ্রলোক আরও বলেন যে, “আমরা আশির দশকে কলেজে পড়েছি। এমনকী আমরা বেশির ভাগ পড়ুয়াই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক কিংবা অর্থনীতি বিষয়ে আমরা ডিগ্রি অর্জন করেছি। এর পর সেই ডিগ্রি নিয়ে আমরা বিভিন্ন সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, রেল, অ্যাকাউন্ট অফিস, টেলিফোন এবং পোস্ট অফিসের মতো জায়গায় চাকরি পেয়েছি। আসলে এই ডিগ্রিগুলোই ছিল আমাদের নিরাপদ চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশের একটা টিকিট। আর সেই সময় একটা মেয়ে যদি ঠিকঠাক নিরাপদ চাকরি করত, তা-হলে অনায়াসেই কোনও সম্ভ্রান্ত ভদ্র পরিবারে তার বিয়ে হয়ে যেত। আর বিয়ের পর মেয়েদের থেকে বাড়ির সকলের এটাই প্রত্যাশা থাকত যে, তাঁরা একসঙ্গে ঘর এবং বাইরের কাজ দশভূজার মতো সামলাবে। আর মেয়েরা সেটাই করত। কিন্তু ঘর ও বাইরের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ত তারা।

আবার মহিলারাও আর্থিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে এবং সংসারে আর্থিক সাহায্য করতে পেরে যারপরনাই গর্ববোধও করত। আসলে সেই সময় থেকেই মহিলাদের কাছে চাকরিটা ছিল অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়। তবে চাকরিটা মেয়েরা এমন ভাবে করত, যাতে পরিবার এবং সংসারে কোনও সমস্যা না-হয়। আর আমার বন্ধুও ঠিক এটাই করেছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সে চাকরি জীবনে ইতি টানার সিদ্ধান্ত আচমকাই নিয়ে নেয়। আসলে তার মনে হয়েছিল যে, সে অনেক দিন ধরে এত দায়িত্ব সামলেছে। আর আমরা সব সময়ই জানি যে, জীবনের আসল লক্ষ্যই হল সুখ বা আনন্দ।”

আসলে আমরা বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছি, তার থেকেও আমরা ভালো থাকার কথা কল্পনা করি। আর মনে মনে কল্পনা করে নিই যে, আমাদের জীবনটা অন্য রকম ভাবে হতে পারত। তাই আমরা আমাদের সাম্প্রতিক দায়িত্ব কাঁধ থেকে নামিয়ে আমাদের কল্পনার জগতে বাস করতে থাকি।
ওই প্রবীণ ব্যক্তির কথায়, আমার বন্ধুর কাছে আসলে অবসর বিষয়টা ছিল অনেকটা সে-রকমই। প্রতিদিন ভোরে উঠে সংসারের কাজকর্ম সেরে অফিসে ছুটত। আর অবসর মানেই ছিল ওর কাছে এই সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি। যাতে সে নিজের সকালটা শান্ত ভাবে কাটাতে পারে, সেটাই ছিল তার মূল চাহিদা। সেই সঙ্গে আবার সকালের সবথেকে ভালো সময়টা তার কাটত অফিসের ডেস্কে এবং সহকর্মীদের সঙ্গেই। কিন্তু অবসর নিলে সে সেই সময়টা হয়তো নতুন বন্ধু তৈরি করতে পারে। এমনকী দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরার পরিবর্তে গান শুনে কিংবা ভালো খাবার খেয়ে সিনেমা দেখেই কাটাতে পারে। এ-ভাবেই আমার বন্ধু নিজের অবসরকালীন জীবনকে কল্পনা করত।

কিন্তু অবসর নেওয়ার ঠিক ১০ বছর পর সমস্যার একটা বড় তালিকা তৈরি হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নতুন বন্ধু তৈরি করা। আসলে নতুন বন্ধু তৈরি করা তাঁর পক্ষে ততটাও সহজ ছিল না। এখানেই শেষ নয়, অবসর গ্রহণ করার পরে বিশ্রাম নিতে নিতে জীবনটা তাঁর একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। কখনও কখনও নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক বলেও মনে হত। আবার পরিবার কিংবা সন্তানদের সঙ্গে আগে ব্যস্ততার কারণএ সেভাবে সময় কাটানো হয়নি বলে তাঁদের সঙ্গে মন খুলে গল্প করতে পারত না। যে রান্নাঘরে এক সময় কাটাতে সে বিরক্ত হত, অবসরের পর সেই রান্নাঘরেই রান্না করে কাটত তার বেশির ভাগ সময়টাই।

আসলে ভদ্রমহিলা মেয়াদের আগেই অবসর নেওয়ার পরে যে সব কাজকর্ম করবেন বলে ভেবেছিলেন, সেই সব কাজ করার সময় তাঁকে অনেক ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছিল। কারণ যা তিনি করবেন ভেবেছিলেন, তার জন্য অনেকটা টাকার প্রয়োজন হয়। যেমন – ঘুরতে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা করার জন্য তো প্রচুর টাকার দরকার হয়। এমনকী কোনও অনুষ্ঠান করা কিংবা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। আর এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনি ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। আর সেটা কাটানোর উপায়ও কিন্তু রয়েছে। সেই বিষয়েই আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, কীসে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়, সেই বিষয়টা সময় নিয়ে খুঁজে বার করতে হবে। আসলে জীবনের অনেকটা সময় ধরে ঘর এবং বাইরের কাজ সামলাতে গিয়ে অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠে না। সেই সব জিনিসই ভেবে নিতে হবে। আসলে যেসব জিনিস করা হয়নি, সেই জিনিস করার ইচ্ছেই মনে জাগাতে হবে। এমন অনেক উদাহরণও রয়েছে। অবসর নেওয়ার পর বহু মহিলাই রান্নাবান্না নিয়ে বিভিন্ন রকম কাজ করছেন। আবার বহু মহিলা আঁকার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। কেউ কেউ তো আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে ট্যুরিস্ট গাইডের কাজও করছেন। আবার এমন এক জনের কথাও জানা গিয়েছে, যিনি সংস্কৃত শিখছেন এবং তার পাশাপাশি প্রাচীন সাহিত্য অনুবাদের কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই উদাহরণের তালিকা এতটাই বড় যে বলে শেষ করা যাবে না। আসলে উদ্দেশ্যটাকে খুঁজে বার করতে হবে। তা-হলে বাকি সব কিছুই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত, এক জন মানুষ যা করতে চাইছে, সেটা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আটকে গেলে কিন্তু চলবে না। শুধু তা-ই নয়, অপ্রয়োজনীয় মতবাদ অনুসরণ করারও প্রয়োজন নেই। নতুন কাজে যে অর্থ উপার্জন করতেই হবে, এমনটা একেবারেই নয়। শুধুমাত্র মনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য সমাজ ও সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্যও কাজ করা যেতে পারে। আর দারুণ খাবার খেতে হবে অথবা দুর্দান্ত পোশাক পরতে হবে, এমনটা না-ও হতে পারে। সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে, আমি কী চাইছি। আর মন যেটা চাইবে, সেটাতে টাকার গন্ধ না-ও থাকতে পারে।

তৃতীয়ত, মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর মতো আর একটা পৃথিবী কিন্তু হয় না। তাই এটা ভেবে লাভ নেই যে, ওই দুনিয়ায় আমি কী করতাম, বা কেমন থাকতাম এই বিষয়গুলি। যার অর্থ হচ্ছে, যেটা আছে সেটাই নিজের প্রকৃত স্বরূপ। বর্তমান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, নিজের পছন্দের কাজের ক্ষেত্রে ছোট ছোট পদক্ষেপ করতে হবে। আর এর পাশাপাশি নিজের স্বপ্নের দুনিয়াকেই নিজের জীবনে নিয়ে আসতে হবে। নতুন আমি, নতুন একটা পৃথিবী হবে – এই ভাবনা ভেবে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

চতুর্থত, নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী টাকার বিষয়টাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধরা যাক, এক জন ব্যক্তি নিজের বাড়িতে থাকছেন এবং তাঁর উপর কেউ নির্ভরশীল নন। সে-ক্ষেত্রে তাঁর জন্য পেনশনটাই যথেষ্ট। সে-ক্ষেত্রে সঞ্চয় ও সংরক্ষণের তেমন প্রয়োজন নেই। আর আর্থিক নিরাপত্তা বজায় রাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল বাজেট তৈরি করা এবং জরুরি কিছু খাতে খরচের জন্য টাকা সরিয়ে রাখা। বড় খরচের বিষয়ে কল্পনা করারই প্রয়োজন নেই। নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী লাইফস্টাইল বজায় রাখতে হবে।

পঞ্চমত, এমন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে, যে কাজে টাকার সে-ভাবে প্রয়োজন হয় না।

আসলে ছোটবেলা থেকেই আমরা সহপাঠীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামি। আর এর মধ্যে কখনও কখনও তুলনার জেরে আমরা নিজেদের দিশাই হারিয়ে ফেলি। এর পর কেরিয়ারেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আর কীভাবে সহকর্মীদের সঙ্গে ঈর্ষা ছাড়াই কাজ করে কেরিয়ারে এগোনো যায়, সেই পন্থাটাই আমরা খুঁজে বেড়াই। এই সব করতে গিয়ে অনেকটাই সুন্দর সময় হারিয়ে ফেলি আমরা। তাই অবসরের সময় মানুষের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ গড়ে তোলা উচিত। সেই সঙ্গে কথাবার্তা বলা, আলাপ-আলোচনা করা এবং মানুষকে সাহায্য করা চালিয়ে যেতে হবে। আসলে মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়ে উঠলে আনন্দ এবং উদ্দেশ্যের রাস্তাই আপনা-আপনিই খুলে যাবে। সবশেষে এটাই বলা যায় যে, যত দিন বাঁচব, উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচব। কারণ ওই বয়সে গিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে বেঁচে থাকা ভীষণই বিপজ্জনক। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য উদ্দেশ্য খুঁজে বার করে সেই অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। কারণ আমাদের জীবন সব থেকে দামি!

Published by:Raima Chakraborty

(Source: news18.com)