টাটার হাত ধরে ৬ মাস এয়ার ইন্ডিয়া! রইল রিপোর্ট কার্ড! লাভ না ক্ষতি?

টাটার হাত ধরে ৬ মাস এয়ার ইন্ডিয়া! রইল রিপোর্ট কার্ড! লাভ না ক্ষতি?

মাস ছয়েক আগেই এয়ার ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিয়েছে টাটা গ্রুপ (Tata Group)। কিন্তু বর্তমানে কী অবস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার (Air India)? ব্যবসা, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য এবং ভাড়ার বিষয়ে কী বলছে এই ছয় মাসের রিপোর্ট কার্ড?

সালটা ২০২০! ভারতে প্রথম পাওয়া গিয়েছে মারণ কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত রোগীর। আর ঠিক সেই সময়ই অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক (Ministry of Civil Aviation)-এর তরফে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণের বিষয়ে প্রিলিমিনারি ইনফরমেশন মেমোরেন্ডাম (Preliminary Information Memorandum) প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ঠিক কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সবটা ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ তত দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) মারণ করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারী (Pandemic) হিসেবে ঘোষণা করে দেয়। যার জেরে থমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক জনজীবন। আর ফল স্বরূপ তার প্রভাব পড়েছে সমস্ত ক্ষেত্রেই। এমনকী বাদ যায়নি বিমান সংস্থাগুলিও (Air lines)। পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

ভারতে এর আগে যা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল, করোনা মহামারী কালে সেটাই সম্ভব হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিড জিতে অবশেষে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি ওই বিমান সংস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় টাটা গ্রুপ। আর এই ঘটনা ঘটেছিল অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের সেই মেমোরেন্ডাম প্রকাশের ঠিক দুই বছর পর। তারপর থেকে কেটে গিয়েছে ছ’মাস। মহামারীর গুরুতর পরিস্থিতি এখন অনেকটাই থিতিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জনজীবনও। কিন্তু টাটা দায়িত্ব নেওয়ার এই ছয় মাস পর কেমন আছে এয়ার ইন্ডিয়া, সেই বিষয় নিয়েই আজ আলোচনা করা যাক…

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-এর জানুয়ারি মাসে এয়ার ইন্ডিয়ার মাধ্যমে প্রায় ১৪ লক্ষ ৭০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করত। আর তখন এই সংস্থার মার্কেট শেয়ার (Market Share) ছিল ১১.৬ শতাংশ। সেই সময় দেশের সেরা বিমান সংস্থাগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করে রেখেছিল এয়ার ইন্ডিয়া। এর ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ চলতি বছর জানুয়ারি মাসে দেখা যায় যে, ওই সংস্থার মার্কেট শেয়ার হয়েছে ১০.২ শতাংশ। যার অর্থ হল হিসেব বলছে, মার্কেট শেয়ার আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আবার দুই বছর আগের তুলনায় যাত্রীর সংখ্যাও অনেকটাই কমেছে। এত কিছুর সত্ত্বেও কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া দ্বিতীয় স্থানের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। আর এর ঠিক পরের মাসেই দেখা যায় যে, সেরা ভারতীয় বিমান সংস্থার তালিকায় এয়ার ইন্ডিয়া দ্বিতীয় স্থানে নিজের জায়গা করে ফেলেছে। এর ফলে অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন যে, এ বার আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না ওই সংস্থাকে। কিন্তু বিষয়টা ঠিক সে-রকম হয়নি।

যথা সময়ে যাতায়াত বা অন-টাইম পারফরমেন্স:
দায়িত্ব নেওয়ার পর এয়ার ইন্ডিয়ার অন-টাইম পারফরমেন্স এবং পরিষেবা উন্নত করাই ছিল টাটা গ্রুপের মূল লক্ষ্য। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিমান যাত্রীদের দেওয়া খাবারদাবার নিয়ে প্রচুর পোস্ট দেখা গিয়েছে। কিন্তু নিজস্ব স্বাদ এবং পছন্দ অনুযায়ী সেই সব খাবারের রিভিউ দিয়েছেন যাত্রীরা। আবার অন্য দিকে, যথা সময়ে বিমানের যাতায়াত বা অন-টাইম পারফরমেন্স একটি প্রতিযোগিতামূলক বিষয়।

জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই বিমান সংস্থা চতুর্থ অথবা পঞ্চম স্থান দখল করে রেখেছিল। আসলে এই সময়ে উড়ানের অন-টাইম পারফরমেন্স ৮১ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করেছিল। আর প্রতিটা বিমান সংস্থাই সময়ানুবর্তিতার নিরিখে তালিকার শীর্ষেই থাকতে চায়। ফলে এই প্রতিযোগিতাটা খুব একটা সহজ হয় না।

এক সময় ইন্ডিগো (IndiGo) সময়ানুবর্তিতার হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। তবে সাম্প্রতিক কিছু সময় ধরে সময়ানুবর্তিতার নিরিখে তৈরি মাসিক তালিকায় এটি আর শীর্ষ স্থানে নেই। অতিমারীর আগের সময় থেকেই ধারাবাহিক ভাবে ইন্ডিগো-র সেই জায়গা কেড়ে নিয়েছে গো-এয়ার (Go Air) উড়ান সংস্থা। আসলে একটা উড়ান ছাড়তে দেরি হলে তার প্রভাব ক্রমাগত পড়তে থাকবে অন্যান্য সংস্থার উড়ানের উপরেও। আর কয়েকটি বিমানবন্দরে উড়ানের অন-টাইম পারফরমেন্সের জন্য কিছু থার্ড-পার্টি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংস্থার উপর নির্ভর করতে হয় টাটা গ্রুপকে। যার অর্থ হল, উড়ানের যথা সময়ে যাতায়াতের উপরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই টাটার। আর এয়ার ইন্ডিয়া যদি অন-টাইম পারফরমেন্সের নিরিখে সেরার জায়গা দখল করতে না পারে, তা-হলে সেরা দুইয়ের মতো শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছনোর জন্য ওই সংস্থাকে এখন কঠোর প্রচেষ্টা করতে হবে।

যাত্রী বহন সংক্রান্ত বিষয়:
জুন মাসে মার্কেট শেয়ারের নিরিখে পঞ্চম স্থানে চলে আসে এয়ার ইন্ডিয়া। মার্চ মাস থেকেই ভিস্তারা (Vistara) মার্কেট শেয়ারের নিরিখে ছাপিয়ে গিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়াকে। এর অর্থ হচ্ছে, এয়ার ইন্ডিয়ায় জানুয়ারি মাস থেকে মে মাসে সবথেকে কম সংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেছেন। অথচ সেই সময় কালের মধ্যে ডোমেস্টিক এয়ার ট্রাফিক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, জানুয়ারিতে ডোমেস্টিক এয়ার ট্রাফিক ছিল ৬.৪ মিলিয়ন, সেখানে মে মাসের এয়ার ট্রাফিক দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১১.৪ মিলিয়নে। অন্য দিকে, জানুয়ারি মাসে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানে যাতায়াত করেছেন প্রায় ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার ৮০৯ জন যাত্রী। আর এপ্রিলে যাতায়াত করেছেন প্রায় ৮ লক্ষ ২৬ হাজার ২৩ জন যাত্রী। কিন্তু মে মাসে যাতায়াত করেছেন প্রায় ৮ লক্ষ ২২ হাজার ৮১৪ জন যাত্রী। হিসেব বলছে, এটাই একমাত্র উড়ান সংস্থা, যার মাধ্যমে মে মাসে এপ্রিল মাসের তুলনায় কম সংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করেছেন।

ডোমেস্টিক সেক্টর বা দেশীয় সেক্টরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ অতিরিক্ত উড়ান চালানো হয়েছিল। অথচ জানুয়ারি মাসের তুলনায় মে মাসে প্রায় ৮ শতাংশ কম উড়ান চালিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। আবার এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানের লোড ফ্যাক্টর (load factor) জানুয়ারি মাসে ছিল ৬০ শতাংশ। আর মে মাসের মধ্যেই তা বেড়ে হয়েছে ৮০ শতাংশ। লোড ফ্যাক্টর হল যাত্রীদের জন্য উপলব্ধ এমন সিট বা যাত্রী ধারণের জায়গা, যা যাত্রী দ্বারা পূর্ণ হয়েছে, তার শতকরা পরিমাপ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, উড়ান সংস্থা প্রায় যাত্রী বোঝাই উড়ান নিয়েই ওই সময় যাতায়াত করেছে।
বিমান চলাচলের প্রয়োজনীয় টারবাইন জ্বালানির দর যে সময় সর্বকালের সর্বোচ্চ থাকে, সেই সময় বিমানের ভাড়াও সীমাবদ্ধ থাকে। আর প্যাসেঞ্জার ট্রাফিকও করোনা পূর্ববর্তী সময়ের জায়গায় পৌঁছতে পারে না। যার ফলে কম লোড-সহ বেশি উড়ানের তুলনায় বেশি লোড-সহ অল্প উড়ান চালানো হয়।

মার্কেট শেয়ার:
২০২১ অর্থবর্ষে এয়ার ইন্ডিয়ার ৯৭৭৯ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। আসলে টাটা এই উড়ান সংস্থাকে অধিগ্রহণ করার পরে সিইও নিয়োগ নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তুরস্কের বিমান সংস্থার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ইলকার আইজে (Ilker Ayci)-কে ফেব্রুয়ারি মাসে সিইও এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেই পদ প্রত্যাখ্যান করে দেন।

আবার শুরুর দিকে এই উড়ান সংস্থায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৩০টি ডোমেস্টিক বিমান বা অন্তর্দেশীয় বিমান চলাচল করেছে। আর মে মাসের মধ্যেই সেই পরিমাণটা অনেকটাই কমে গিয়েছে। দেখা গিয়েছে যে, এই সময় প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৫টি অন্তর্দেশীয় বিমান চলাচল করেছে। আর এই বিষয়টা দেখে মনে করা হচ্ছে যে, ক্ষতির মুখে পড়া উড়ানগুলিকে নেটওয়ার্কের বাইরে বার করে দিতে চাইছে উড়ান সংস্থা। সেই সঙ্গে সীমিত সংখ্যক বিমানকে লাভজনক উপায়ে কাজে লাগানোর চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

তা-হলে এ-বার প্রশ্ন হচ্ছে, কোন উড়ানগুলি কোপের মুখে পড়ছে? সূত্রের খবর, সবার আগে অন্তর্দেশীয় ক্ষেত্রে নন-প্রফিটেবল বা অলাভজনক রুটগুলির উপরই এই কোপ পড়তে চলেছে। যদিও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে উচ্চ চাহিদা এবং বেশি ভাড়া হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে পরিস্থিতির বেশ উন্নতি দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক উড়ানগুলি বেশ ভালোই চলছে। ফলে এদের অবস্থা অন্তর্দেশীয় উড়ানগুলির মতো একেবারেই নয়।

এখন প্রশ্ন উঠছে যে, চারপাশের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে কোন বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দেবে এয়ার ইন্ডিয়া? যে কেউই বুঝতে পারবেন যে, উড়ান সংস্থার প্রথম মাথাব্যথাই হচ্ছে লোকসানের বোঝা কমানো! আর সেখানে নিশ্চিত রূপে উড়ান সংস্থার অগ্রাধিকারের তালিকায় একেবারে শেষে থাকবে মার্কেট শেয়ার!

Published by:Aryama Das

(Source: news18.com)