এক্সাইটিং বাইটিং! ২৯৫ টাকা থেকে বাঙালির ব্রিটানিয়া এখন ১২ হাজার কোটির সংস্থা

এক্সাইটিং বাইটিং! ২৯৫ টাকা থেকে বাঙালির ব্রিটানিয়া এখন ১২ হাজার কোটির সংস্থা

#কলকাতা: সাদা-কালো ছাপার ‘এক্সাইটিং বাইটিং’ থেকে রঙিন ‘দ্য হেলদিয়ার চয়েস’- সময়ের বয়স বাড়লেও ‘ব্রিটানিয়া বিস্কিটস আর দ্য বেস্ট’! নিছক বিজ্ঞাপনী ভাষা বোধহয় এ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একশো বছর পেরিয়ে আসা সব ভারতীয়র আবেগ, সব বাঙালির বিশ্বাস।

স্বাদের ঔপনিবেশিকতা
কলকাতার অন্য অনেক কিছুর মতো ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজেরও (Britannia Industries) পত্তন কিন্তু ব্রিটিশ হাতে। ১৮৯২ সালের কলকাতা শহরে দমদম এলাকায় একটি ছোট ঘর থেকে জনাকয়েক ব্রিটিশ বেকারের উদ্যোগে এই কোম্পানির শুরু হয়। মাত্র ২৯৫ টাকা দিয়ে খোলা হয় সাধের স্বাদের ব্যবসা। ১৮৯৭ সালে এসে ব্রিটানিয়া পড়ল বাঙালির হাতে, গুপ্ত ব্রাদারস (Gupta Brothers) নামে নলিনচন্দ্র গুপ্ত (Nalin Chandra Gupta) ব্রিটানিয়া কিনে নিলেন। ১৯১৮ সালের ২১ মার্চ, ২১ বছর পর সিএইচ হোমস (CH Holmes) নামে এক ইংরেজ ব্যবসাদার গুপ্ত ব্রাদার্সে যোগদান করেন। এরপর এটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। ১৯২১ সালের প্রথম ব্রিটানিয়া কোম্পানি গ্যাস ওভেন ব্যবহার করা শুরু করে।

দেশে তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে পুরোদমে। এক পয়সা খরচ করার আগেও ভারতীয়দের চিন্তা-ভাবনা করতে করতে হত। খরচ করার ক্ষমতা ছিল খুবই কম। দু’বেলার খাবার ঠিকমতো পাওয়াটাই ছিল যথেষ্ট, বিস্কুট কিনে খাওয়া বিলাসিতা তো বটেই। এই সমস্ত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ব্রিটানিয়া ব্যবসা তৈরি করে নেওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতাও তৈরি করে। মানুষ এই বিস্কুটের স্বাদ এবং মান দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।ব্রিটানিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খ্যাতি অর্জন করে এবং ১৯২৪ সালে মুম্বইয়ের কাসারা পিয়ার রোডে একটি নতুন কারখানা চালু করে। একই সময়ে কোম্পানিটি Peek Frean & Company Limited UK-এর একটি সাবসিডিয়ারি সংস্থানে পরিণত হয়। এরপর ব্রিটানিয়া কলকাতা ও মুম্বইয়ে একাধিক কারখানা চালু করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ব্রিটানিয়া কোম্পানিকে ব্যবহার করে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই কোম্পানির বেশিরভাগ প্রোডাক্ট সৈন্যদের পাঠানো হত। ব্রিটানিয়া একাই তাদের প্রয়োজনীয় পরিমাণের খাদ্য সরবরাহ করত। অনেক জায়গায় এও দাবি করা হয়েছে যে ব্রিটানিয়ার মোট উৎপাদনের প্রায় ৯৫ শতাংশ সৈন্যদের জন্য পাঠানো হত

স্বাধীন ভারত এবং ব্রিটানিয়া

ব্রিটানিয়া কোম্পানির অংশীদারিত্ব, মালিকানা এবং শেয়ারহোল্ডিং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। ব্রিটানিয়া গুপ্ত ব্রাদার্সের মাধ্যমে সিএইচ হোমস, পিক ফ্রেন এবং পরে এবিআইএল কোম্পানির কাছে যায়। ১৯৫১ সালে ব্রিটানিয়ার কলকাতার কারখানা দমদম থেকে তারাটোলা রোডে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু হয় এবং একটি অটোমেটিক প্লান্ট স্থাপন করা হয়। ১৯৫৪ সালে মুম্বইতেও একটি অটোমেটিক কারখানা স্থাপন করা হয়। একই সময়ে কোম্পানি পাউরুটি তৈরি শুরু করে এবং দিল্লিতে সেই কারখানা স্থাপন করে।

কোম্পানিটি ভারতীয় গ্রাহকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায় এবং ধীরে ধীরে ব্রিটানিয়া বড় হতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালে কোম্পানি দিল্লিতে একটি নতুন ব্রেড বেকারি শুরু করে। ১৯৭৬ সালে ব্রিটানিয়া ব্রেড কলকাতা এবং চেন্নাইতেও চালু করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৩ অক্টোবর কোম্পানিটি ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি লিমিটেড থেকে ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হয়ে যায়।

বিস্কুট সম্রাট রাজন পিল্লাই

১৯৮০ সালে ব্রিটানিয়া কোম্পানি নেবিকো প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ১০ বছরের টেকনিকাল কোলাবরেশন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই সময় রাজন পিল্লাই (Rajan Pillai) নামে কেরলের একজন ব্যবসায়ী এই কোম্পানির দায়িত্ব নেন। এই পিল্লাই ভারতে ‘বিস্কুট কিং’ নামে পরিচিত। তিনি আগে 20th Century Foods নামে একটি কোম্পানির মালিক ছিলেন এবং Olay ব্র্যান্ড নামে আলুর চিপস বিক্রি করতেন। এক পর্যায়ে এসে তিনি ব্রিটানিয়ায় ৩৮ শতাংশ শেয়ার হাতে নেন।

১৩ বছর পর ওয়াদিয়া গ্রুপ ABIL-এর অংশীদারিত্ব অধিগ্রহণ করে। তারাও বিদেশি গ্রুপ ড্যানোন-এর মতো কোম্পানির একটি সমান অংশীদার হয়ে যায়। ড্যানোন, ওয়াদিয়া এবং পিল্লাই কোম্পানির অংশীদারত্ব নিয়ে লড়াই করতে থাকে। ১৯৯৫ সালে আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলায় জেলে যান রাজন পিল্লাই এবং ৪ দিন পর সেখানেই মারা যান তিনি।

২০০৬ সালে ওয়াদিয়া এবং ড্যানোনের সংঘর্ষ বাঁধে। ওয়াদিয়া ড্যানোনের বিরুদ্ধে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। ড্যানোন টাইগার ব্র্যান্ড নামে বিস্কুট চালু করেন। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান এবং মিশরে এই বিস্কুট ভাল বিক্রি হচ্ছিল। ২০০৯ সালে দুই সংস্থা একটি বোর্ডরুম মিটিং করেন এবং ওয়াদিয়া কোম্পানির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন।

ব্রিটানিয়া বিজনেস মডেল কেমন?

কোম্পানি দুটি ব্যবসায়িক বিভাগে কাজ করছে। বেকারি পণ্য এবং দুগ্ধজাত পণ্য। কোম্পানির ৯৫ শতাংশ রেভেনিউ আসে বিস্কুট সেগমেন্ট থেকে। অন্য দিকে, মোট বিক্রির ৫ শতাংশ লাভ হয় নন-বিস্কুট ক্যাটাগরি থেকে। কেক, মাখন, চিজ- নানা পণ্য মিলিয়ে ব্রিটানিয়া এখনও ভারতের প্রায় প্রথম পছন্দ।

(Source: news18.com)