ইউক্রেন, কেন যুদ্ধভূমির রেল নেটওয়ার্কের উপর হামলা প্রতিবেশী দেশের?

ইউক্রেন, কেন যুদ্ধভূমির রেল নেটওয়ার্কের উপর হামলা প্রতিবেশী দেশের?

নয়াদিল্লি: রাশিয়ার সামরিক বাহিনী (Russia’s Military) ইউক্রেন রেল নেটওয়ার্কের (Ukraine’s Railway Network) উপর একের পর এক আক্রমণ শুরু করেছে। সন্দেহ নেই, রেলব্যবস্থা ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র সরবরাহ, শরণার্থীদের সরিয়ে নেওয়া এবং খাদ্য রফতানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন রুশ কর্মকর্তা বলেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা দেশগুলি থেকে ইউক্রেনে অস্ত্র (Arms) সরবরাহ ব্যাহত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে আক্রমণের শুরুতে ইউক্রেনের রেল লাইনগুলিকে অনেকাংশে রেহাই দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক হামলাগুলি এখন সিস্টেমকে ধ্বংস করার চেয়ে আরও বেশি ক্ষতির চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।

ইউক্রেনের জন্য রেল এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

ইউক্রেনের একটি বিশাল রেলওয়ে নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা পশ্চিমা অস্ত্রের সরবরাহের (Western Arms Shipments) জন্য সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই রেল লাইন ব্যবহার করেই রাশিয়ান বিমান হামলা থেকে বাঁচানোর জন্য লাখ লাখ ইউক্রেনীয়কে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বহু মানুষ ট্রেনে করেই সীমান্তে পৌঁছে অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে চলে গিয়েছে।

পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ার প্রাথমিক আক্রমণকে ভোঁতা করে দিয়েছিল। ডনবাস (Donbas) যুদ্ধেও পশ্চিমা অস্ত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলেও মনে করা হচ্ছে। কিভ দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কো (Moscow) জানিয়েছে যে তাদের লক্ষ্য এক ডনবাস। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির (Ukrainian President Volodymyr Zelenskyy) অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA) এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্রের চালান বাড়িয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু (Russian Defense Minister Sergei Shoigu) হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র সরবরাহকারী যে কোনও যানবাহনকে টার্গেট করবে মস্কো। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ইগর কোনাশেনকভ (Maj. Gen. Igor Konashenkov) বুধবার বলেছেন, রেল লাইনে হামলার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহ ব্যাহত করা।

সর্বশেষ টার্গেট কী ছিল?

রাশিয়ান বাহিনী গত দিনে ইউক্রেন জুড়ে পাঁচটি রেল স্টেশনের জন্য তৈরি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা (Missile Strike) চালিয়েছে। পোল্যান্ডের (Poland) সীমান্তের কাছাকাছি পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লভিভ (Lviv) এবং তার আশপাশের কয়েকটি স্টেশনে হামলা চালানো হয়। এই অঞ্চল দিয়েই ন্যাটো (Nato)-র সরবরাহ করা অস্ত্র নিয়ে আসছে ইউক্রেন। লভিভের মেয়র বলেছেন, হামলায় তিনটি পাওয়ার সাবস্টেশন (Power Substation) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শহরের এমন কিছু অংশে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

রেল নেটওয়ার্কে এর আগে কি হামলা চালানো হয়েছে?

একটি রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র গত মাসের ৮ তারিখ পূর্ব ইউক্রেনের একটি জনাকীর্ণ ট্রেন স্টেশনে আঘাত হানে। তাতে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত এবং আরও কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়। হাজার হাজার অসামরিক নাগরিক, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু ডনবাস অঞ্চল থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ক্রামতোর্স্ক (Kramatorsk) শহরের ওই স্টেশনে জড়ো হয়েছিল। আর তখনই রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে স্টেশনে। জেলেনস্কি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্টেশনে হামলার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। পাল্টা রাশিয়াও ইউক্রেনকে দোষারোপ করে বলেছে যে মস্কোর সেনাবাহিনী ওই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে না, যেটি স্টেশনে আঘাত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষের দিকে, অস্ত্র সরবরাহ ব্যাহত করতে ইউক্রেনের পশ্চিমে বেশ কয়েকটি জংশন রেল স্টেশনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।

রাশিয়ার পরিকল্পনা কী?

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছে যে রাশিয়া আগ্রাসনের শুরুতে ইউক্রেনের রেল ব্যবস্থাকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ সারা দেশে নিজেদেরই সেনা ও অস্ত্র সরানোর জন্য রেলের ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিল মস্কো। কারণ, ক্রেমলিন আশা করেছিল যে যা তারা দ্রুতই কিভ (keiv) দখল করে নিতে পারবে। অবসরপ্রাপ্ত ফরাসি জেনারেল ডমিনিক ট্রিনকুয়ান্ড (French General Dominique Trinquand) বলেছেন, “এখন যেহেতু রাশিয়ার সেই প্রচেষ্টা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে, জেনে গিয়েছে যে রেল নেটওয়ার্ক তারা ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না, তাই তারা রেল নেটওয়ার্কে হামলা চালাচ্ছে। যা ইউক্রেনীয়দের কাছে ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল বা আসছে।”

রাশিয়ানরা গত সপ্তাহে রেল নেটওয়ার্ক ও পাওয়ার সাপ্লাই লাইনগুলিতে নির্ভুল হামলা চালিয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের লক্ষ্য এখনও রেল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার পরিবর্তে ক্ষতি করা। প্রাক্তন ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফ্র্যাঙ্ক লেডউইজ (Frank Ledwidge) বলেছেন, “এটি ইউক্রেনীয়দের থামাতে পারবে না, তবে এটি তাদের ব্যাহত করবে। রাশিয়ানরা ইউক্রেনের মনোবলকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ারও লক্ষ্য নিয়েছে। মস্কো এটা বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে ‘কোথাও নিরাপদ নয়। সেনাবাহিনী রক্ষা করতে পারবে না। আমরা আমাদের ইচ্ছায় তোমাদের দেশে রাজত্ব করব।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী বলেছে?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উর্ধ্বতন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন যে রাশিয়ানরা লভিভের আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে আঘাত করার চেষ্টা করেছে, বিশেষ করে রেল লাইনগুলিকে লক্ষ্য করে। যদিও ইউক্রেনের বাহিনীর উপর কোনও প্রভাব পড়েনি। এটাও স্পষ্ট নয় যে আদৌ রুশ হামলাগুলি খুব সঠিক ছিল কি না এবং তারা ইউক্রেনে অস্ত্র পাওয়ার চেষ্টাতেও বাধা দেয়নি।” এখনও পর্যন্ত মস্কোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করছেন ইউক্রেনের রেলের সিইও ওলেক্সান্ডার কামিশিন (Oleksandr Kamyshin)। ৩৬ বছরের কামিশিন বলেছেন, “আমাদের সবচেয়ে বেশি এক ঘন্টা ট্রেন পরিষেবায় দেরি হয়েছে। রাশিয়া একটিও সামরিক ট্রেনে হামলা চালাতে পারেনি।” ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, শুধু সামরিক সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলেই রেল পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।

রেল নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে মরিয়া ইউক্রেন: ইউক্রেনের মন্ত্রী ইউরি ভাসকভ (Deputy Infrastructure Minister Yuri Vaskov) একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে মস্কোর লক্ষ্য হল সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে যতটা সম্ভব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করা। রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে বন্দর অবরোধ করে রেখেছে, সেতু ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং চেকপয়েন্টগুলিতে যান চলাচলে বাধা দিচ্ছে। স্নারলিং ট্রাকিং ট্র্যাকও অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। কারণ, ২২ হাজার কিমি এই ট্র্যাক হল ইউক্রেনের অর্থনীতির প্রধান লাইফলাইন এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। রাশিয়া সমুদ্র বন্দর অবরুদ্ধ করে দেওয়াতে ইউক্রেন প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছোট শস্যের চালান পাঠাতে শুরু করেছে। ইউক্রেন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রফতানিকারক ছিল। যুদ্ধের কারণে রফতানি ব্যাহত হওয়াতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য শৃঙ্খলে বাধা দিয়েছে। যাতে খাদ্যপণ্যের আকাল তৈরি হয়েছে, যার কারণে আবার বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্যের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী। রাশিয়া প্রচুর পরিমাণে সারের মূল উপাদন, যেমন পটাশ (Potash) এবং ফসফেট (Phosphate) উৎপাদন করে। সরবরাহের খরচ বৃদ্ধি, বেলারুশের (Belarus) উপর নিষেধাজ্ঞা (আরেকটি প্রধান পটাশ সরবরাহকারী) এবং চরম আবহাওয়ার মিলিত সমস্যায় গত বছর সারের দাম বাড়ে। যা সরাসরি খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে। রাশিয়া এবং বেলারুশ গত বছর মোট রফতানির ৪০ শতাংশ পটাশ উৎপাদন করেছিল। যুদ্ধের কারণে এবার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অভ্যন্তরীণভাবে ট্রেনগুলি মানবিক সহায়তা এবং অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করছে। কামিশিন জানিয়েছে যে তাঁরা ক্রিভি রিহ (Kryvyi Rih)-তে অ্যাসেলরমিত্তাল স্টিল প্ল্যান্ট (AcelorMittal Steel Plant) পুনরায় চালু করতে সক্ষম হয়েছেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া আক্রমণ করার পর থেকে ইউক্রেনের ট্রেনগুলি ১ লাখ ৪০ হাজার টনেরও বেশি খাবার বিতরণ করেছে এবং মে মাসের মাঝামাঝিতে রাষ্ট্রীয় ডাক পরিষেবার জন্য প্রায় ১ মিলিয়ন কিলো মেল বহন করবে। জানা যাচ্ছে, ইউক্রেনে ১ হাজারের বেশি স্টেশনের মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে রাশিয়া হামলা চালিয়েছে। কামিশিন আরও জানিয়েছেন যে রেলের মোট ২ লাখ ৩০ হাজার কর্মী রয়েছে। ১২২ জন নিহত এবং ১৫৫ জন আহত হয়েছেন, তাতেও রেলের কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরেনি।

কামিশিন বলেছেন যে তিনি ইউক্রেনের রেল নেটওয়ার্ক ঠিক রাখতে সারাদিনই নজরদারি চালাচ্ছেন। কামিশিন বলেছেন যে তাঁর এখন অগ্রাধিকার হল ইউক্রেনের দক্ষিণের বন্দরগুলি থেকে পোল্যান্ড, রোমানিয়া (Romania) এবং বাল্টিক রাজ্যে শস্য রফতানি (Grain Export) আবারও শুরু করা। যা দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে। তিনি বলেছেন যে রাশিয়া এই যুদ্ধে তার অনিবার্য পরাজয়ের পরেও ইউক্রেনের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, “এই পাগল প্রতিবেশী আমাদের সঙ্গে থাকবে। কেউ জানে না তারা আবার কবে আসবে।”

(Source: news18.com)