সঙ্কটে দার্জিলিং ছিল ঠাঁই, রাজনীতি মনে হতো বোঝা, প্রকৃতির কোলে আশ্রয় খুঁজতেন ইন্দিরা

সঙ্কটে দার্জিলিং ছিল ঠাঁই, রাজনীতি মনে হতো বোঝা, প্রকৃতির কোলে আশ্রয় খুঁজতেন ইন্দিরা

কলকাতা: দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, দুঁদে রাজনীতিক, নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্য, তাঁর এই পরিচয় সর্বজনবিদিত। কিন্তু এর বাইরেও আরও একটি পরিচয় রয়েছে ইন্দিরা গাঁধীর (Indira Gandhi), পরিবেশপ্রেমী। রাজনীতির পোকা যাঁরা, নেহরু-গাঁধী পরিবারের ইতিহাস যাঁদের নখদর্পণে, তাঁরা এ ব্য়াপারে অবগত হলেও, অধিকাংশ ভারতীয়ই ইন্দিরার এই পরিচয় সম্পর্কে অবগত নন।  এমনকি বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সূচনাও ঘটে তাঁর উপস্থিতিতেই (World Environment Day 2023)।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, মেয়েকে সে ভাবে সময় দিতে পারেননি নেহরু। সেই ঘাটতি পূরণ করতে কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চিঠিকে। ১৯২৮ সালে ইন্দিরাকে ৩০টি চিঠি লিখেছিলেন নেহরু, যা পরবর্তী কালে ‘লেটার্স ফ্রম আ ফাদার টু হিজ ডটার’ নামে বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি থেকে হিন্দি, স্পেনীয় ভাষাতেও অনুবাদ হয় সেই বই। দীর্ঘ সেই চিঠিতে, ভারতীয় ঐতিহ্য, মানব সভ্যতার ইতিহাস এবং সর্বোপরি পরিবেশ সম্পর্কে নিজের ভাবনা বুঝিয়েছিলেন নেহরু।

বাবার কাছ থেকে পাওয়া সেই চিঠিই ইন্দিরাকে পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছিল। কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ পরে ইন্দিরার জীবনীর নামও রাখেন ‘ইন্দিরা গাঁধী: আ লাইফ ইন নেচার’। জয়রামের সেই বইও প্রশংসিত হয়। তাতে ‘আয়রন লেডি’ ইন্দিরার চরিত্রের অন্য দিকগুলি তুলে ধরেন তিনি। দুঁদে রাজনীতিক ইন্দিরা আসলে মনের দিক থেকে কেমন ছিলেন, পাহাড়-পর্বত পরিবেশ তাঁকে কতটা টানত, বইয়ে বিশদে তা তুলে ধরেন জয়রাম।

জরুরি অবস্থা জারি থেকে বিরোধী শিবিরের নেতাদের প্রতি কঠোর আচরণপর্ব বাদ দিয়ে ইন্দিরাকে শুধুমাত্র পরিবেশপ্রেমী হিসেবে তুলে ধরায় বিস্তর সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় জয়রামকে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ছিল, “ইন্দিরা গাঁধী আসলে পরিবেশপ্রেমীই ছিলেন। অন্তত নিজেকে তা-ই ভাবতেন ইন্দিরা গাঁধী। রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে কার্যতই টেনে আনা হয় তাঁকে। কিন্তু আসলে পাহাড়, পর্বত, বন-জঙ্গলই ছিল তাঁর ভালবাসা। বন্যপ্রাণ, পাখি, নুড়ি-পাথর জঙ্গলের প্রতি ছিল টান। নগরায়ন এবং শিল্পায়নে পরিবেশের ক্ষতি বলেই মনে করতেন।” ইন্দিরার পুত্রবধূ মানেকা গাঁধীও এক সাক্ষাৎকারে শাশুড়ির সঙ্গে দার্জিলিং ভ্রমণের কথা তুলে ধরেছিলেন। কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার যাওয়ার পর কাকভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং সুর্যোদয় দর্শন, পাড়ারে কোলে হেঁটে বেড়ানো, ইন্দিরার সঙ্গে এমন স্মরণীয় মুহূর্তের কথা তুলে ধরে ধলেন তিনি।

কথোপকথনে পরিবেশের প্রতি অমোঘ আকর্ষণের কথা নিজেও বার বার তুলে ধরেছেন ইন্দিরা। আমেরিকার প্রখ্যাত দার্শনিক ডরোথি নরম্যান ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁকে পাঠানো চিঠিতে ইন্দিরা লেখেন, ‘সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিতে মন চায় আমার। প্রত্যন্ত দূরে কোথাও, পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে অবসরযাপনের ইচ্ছে জাগে’। ১৯৫৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ইন্দিরা। তার পরই আর এ বন্ধুকে পাঠানো চিঠিতে ইন্দিরা লেখেন, ‘শান্তি এবং নির্বিঘ্নে বছরটা কাটাব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু অসম্ভব কঠিন এবং গুরুদায়িত্ব নেমে এল আমার কাঁধে’।

১৯৭২ সালে স্টকহোমে আয়োজিত মানবসভ্যতা ও পরিবেশ সম্মেলনে প্রথম বার বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৫ জুন দিনটি তার জন্য নির্ধারিত করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলেন ইন্দিরাও। সুইডেনের তৎকালীন রাষ্ট্রনেতা ব্যাতীত একমাত্র ইন্দিরাই কোনও দেশের প্রধান হওয়ার নিরিখে বক্তৃতা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে ইন্দিরা জানিয়েছিলেন, একমাত্র পৃথিবীই মানুষের আশ্রয়স্থল। তাই পৃথিবীর স্বার্থে নয়, মানুষের স্বার্থেই পৃথিবীকে বাঁচানো প্রয়োজন।

মানব সভ্যতা এবং পরিবেশের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইন্দিরা বলেন, “শুধুমাত্র সহনাগরিক নয়, সমস্ত সৃষ্টিকে বন্ধুর নজরে দেখতে না পারলে কখনওই প্রকৃত, সভ্য মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। সমগ্র ভারত জুড়ে প্রস্তর এবং লৌহস্তম্ভগুলিতে খোদাই করা অভিজ্ঞানগুলি এই কারণেই স্মর্তব্য যে, সম্রাট অশোক রাজার কর্তব্যকে শুধুমাত্র নাগরিককে রক্ষা এবং অন্যায়কারীকে শাস্তিপ্রদান বলে গন্য করেননি। বরং রাজার কর্তব্যের মধ্যে বন্যপ্রাণ এবং বনভূমি সংরক্ষণকেও রেখেছিলেন। যতদূর মনে করতে পারি, সম্রাট অশোকই প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র শাসক, যিনি আমোদ-প্রমোদ এবং খাদ্যের সংস্থানের নামে বিপুল প্রজাতির পশুহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। আজ এই সম্মেলন যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, ঢের আগেই তার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলেন সম্রাট অশোক। আরও একধাপ এগিয়ে, বিজয়োল্লাসে মত্ত নিজের সামরিক বাহিনীর ব্যাপক হত্যালীলা নিয়ে অনুশোচনা হয়েছিল তাঁর। বরং ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমেই প্রাপ্ত শান্তির মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার বিধান দিয়েছিলেন উত্তরসূরিদের।“

পরিবেশ ধ্বংস করে কখনও উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মত ছিল ইন্দিরার। তাই বলেন, “আমরা এই পরিবেশের অংশ। প্রাত্যহিক চাহিদার জন্য পরিবেশর উপরই নির্ভরশীল। অথচ প্রতিনিয়ত সেই পরিবেশেকেই শোষণের কথা বলে চলি।  ১৯৫৩ সালে যখন উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গে মানুষের আরোহণ ঘটে, সেই সময় ‘এভারেস্ট জয়’ শব্দবন্ধটি নিয়েই আপত্তি তুলেছিলেন জওহরলাল নেহরু। ঔদ্ধত্য বলে মনে হয়েছিল ওঁর। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই তাগিদ কি সত্যিই প্রয়োজন? আমার মনে আছে, ব্রিটিশ লেখক এডওয়ার্ড টমসন, যিনি ভারতের পরম বন্ধু, মহাত্মা গাঁধীর কাছে বন্যপ্রাণ নিধন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। উত্তরে গাঁধী বলেছিলেন, ‘জঙ্গল থেকে বন্যপ্রাণ কমছে ঠিকই, কিন্তু শহরে বড্ড বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ছে’।”

আন্তর্জাতিক মঞ্চে শুধু ভাষণ দেওয়া নয়, ভারতে ব্যাঘ্রপ্রকল্পের সূচনাও করেন ইন্দিরাই। ব্যাঘ্র সংরক্ষণে সূচনা করেন ‘প্রজেক্ট টাইগার’-এর। এর পাশাপাশি, কুমির, সিংহ, হরিণ এবং অন্য়ান্য বিপন্ন বলে পরিচিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণেও উদ্যোগী হন ইন্দিরা। ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং ১৯৮০ সালের বনভূমি সংরক্ষণ আইনও ইন্দিরারই প্রয়াসের ফলশ্রুতি। জল এবং বায়ুদূষণের মোকাবিলায় ১৯৭৪ সালে জল আইন (দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ) এবং ১৯৮১ সালে বায়ু আইনের (দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ) প্রবর্তন ঘটে তাঁর আমলেই।

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং পশ্চিমঘাটের বৃষ্টি অরণ্যকে পরিবেশগত ভাবে স্পর্শকাতর ঘোষণা করতেও নিজের রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগান ইন্দিরা। দিল্লি বার্ড ওয়াচিং সোসাইটি, বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির গঠনের নেপথ্যেও ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ব্যাঘ্রশিকার নিষিদ্ধ করেন। রাজপরিবার এবং বিশিষ্টজনেদের শিকারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

তবে বিতর্ক এড়াতে পারেননি ইন্দিরাও। স্টকহোমের ওই সম্মেলনেই ইন্দিরাকে বলতে শোনা যায়, “পরিবেশের ক্ষতিসাধন চাই না আমরা। তবে বিপুল সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যকেও উপেক্ষা করতে পারি না। দারিদ্র এবং চাহিদা কি অন্যতম দূষণকারী নয়? অরণ্যেই যাঁদের বাসভূমি, অরণ্যের আশেপাশেই যাঁরা থাকেন, সেই জনজাতি মানুষদের কর্মসংস্থান এবং জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দিতে না পারলে, খাদ্য এবং জীবনধারণের সন্ধানে অরণ্যে চিরুণি চালানো থেকে তাঁদের বিরত রাখতে পারি না আমরা, তাঁদের হাতে শিকার এবং গাছপালা ধ্বংস হওয়াকেও রুখতে পারি না। তাঁদের বঞ্চিত করে রেখে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণকে কী করে এগিয়ে রাখতে পারি আমরা?”

ইন্দিরার এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক বাধতে সময় লাগেনি। যদিও তাঁর মন্তব্যের বিকৃত মর্মার্থ বের করা হয় বলেই মত ইতিহাসবিদদের একাংশের। তাঁদের মতে ইন্দিরা সরাসরি পুঁজিবাদী দেশগুলিকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। যে সমস্ত ধনী দেশ ভারতের দারিদ্র্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নিজেরা যা করতে পারে, ভারত তা করতে পারে না বলে চোখ রাঙায়, তাদেরকেই কড়া বার্তা দিতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা। দারিদ্র ঘোচাতে উদ্যোগী না হয়ে, শুধু ভাষণ দিয়েই যারা কাটিয়ে দেয়, আসলে ইন্দিরা তাদেরকেই কটাক্ষ করেছিলেন বলে মত ইতিহাসবিদদের একাংশের। তাই রাজনীতিক ইন্দিরাকে নিয়ে সমালোচনার অবকাশ থাকলেও, পরিবেশপ্রেমী ইন্দিরার অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন থাকা অবাঞ্ছনীয় বলে মত তাঁদের।

(Feed Source: abplive.com)