Durga Puja 2023: লস অ্যাঞ্জেলস যেন লেকটাউন, পুজোয় সরগরম মার্কিন মুলুক

Durga Puja 2023: লস অ্যাঞ্জেলস যেন লেকটাউন, পুজোয় সরগরম মার্কিন মুলুক

লস অ্যাঞ্জেলস থেকে নিবেদিতা হাজরা 

‘ব’ দা : হ্যালো ‘ম’ দা, আগামী শনিবার দুপুরে পুজোর মিটিং এ আসছেন তো ? ‘ই’ দি, ‘র’ দি , ‘স’ দা রা আসছে। অষ্টমীর রাতের ননভেজ মেনুতে পাঁঠার মাংসের সঙ্গে পোলাও রাখা হবে না সাদা ভাত রাখা হবে সেটা নিয়ে নিয়ে একটু আলোচনার প্রয়োজন।

‘ম’ দা : হ্যাঁ আসছি তো। তবে ১৫ মিনিটের মতো একটু দেরী হবে, ছোটছেলে টা কে একটু নাটকের মহড়ায় ‘ক’ দির বাড়িতে ছেড়ে আসতে হবে। দশমীর সন্ধ্যেতে ‘ক’ দির পরিচালনায় ‘কৈলাস অভিযান’ নাটকে গণেশের চরিত্রে অভিনয় করছে এবার।

ব’ দা : বাহ, তাই নাকি। আমার বড় মেয়ে তো মেনোকার রোল করছে। ঠিক আছে, দাদা দেখা হচ্ছে শনিবার। মিটিং এর টাইম টা হোয়াটস্যাপ করে দিচ্ছি।

সুন্দরী যুবতী ‘দ’ : হ্যাঁরে ‘ন’ , তোর কাছে সিলভারের কোনো নেকপিস আছে , আমার বড় ননদ মেরুন কালারের যে কাঞ্জিভরম টা পাঠিয়েছে তার সঙ্গে কি পরবো বুঝতে পারছি না।

পুজোর বড়কত্তা ‘ভ’ দা : এবারের অষ্টমীর পুজোর অঞ্জলীর সময় টা কি পুরোহিত মশাই জানিয়েছেন ? ‘ল’ দা কে বলুন হোয়াটস্যাপ গ্রুপে আর ফেসবুক পেজে আপডেট করে দিতে।

উঁহু , এই অব্দি পড়ে আপনি কি কলকাতার কোনো পুজো প্রস্তুতির ছবি বা বর্ধমানের কোনো পাড়ার দুগ্গা মন্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুজোর কর্মকর্তা দের কথোপকথনের দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করে ফেলেছেন? আরে মশাই , এ হল গিয়ে খোদ মার্কিন মুলুকে লস অ্যাঞ্জেলস-এর মাটিতে দুগ্গা পুজোর প্রস্তুতিপর্ব।

কে বলেছে ‘এখানে শরৎ ভীষণ নিস্তব্ধ’ ? নাই বা থাকলো এখানে শরতের শিউলি ফুলের মনকেমনকরা গন্ধ , নাই বা থাকলো চোখ জুড়ানো পদ্ম, নাই বা থাকলো ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি এনে দেওয়া কংক্রিটের শহর ঠেলে হালকা হাওয়ায় মাথা নেড়ে দুলতে থাকা কাশফুল, নাই বা থাকলো পুজোর আগেই পূজাবার্ষিকী গুলোকে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার সুযোগ, অনেক মনকেমনের মাঝেও বাঙালি উৎসবে মেতে উঠতে জানে , বাঙালি আনন্দ করতে জানে। সে বাঙালি কাটোয়ায় থাকুন বা ক্যালিফোর্নিয়ায়, নদীয়ায় থাকুন বা নিউ ইয়র্কে, ফুলবাগানে থাকুন বা ফ্লোরিডায়।

ওদিকে কলকাতায় যখন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাঁশ পড়তে শুরু করেছে , উপচে পড়া ভিড় কে উপেক্ষা করে পুজো শপিং শুরু করে দিয়েছেন মানুষজন, এদিকে লস অ্যাঞ্জেলসে পুজো পুজো গন্ধ এসে গেছে। অবিরাম চলতে থাকা ভিসা সমস্যা , হঠাৎ শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা, চাকরির বাজারে কালো মেঘের আবির্ভাব , এইসব কিছুকে কয়েকদিনের জন্য জীবন থেকে দূরে সরিয়ে নস্টালজিয়ায় লেপ্টে থাকা বাঙালি আবার একসঙ্গে মেতে উঠবে দুগ্গা মা এর আরাধনায় হাতে হাত মিলিয়ে।

লস অ্যাঞ্জেলস বেশ কয়েকটি পুজো হয়। তার মধ্যে একটি হলো ‘ভ্যালি বেঙ্গলি কমিউনিটি ‘ র দুর্গাপুজো। খুব বেশি দিন শুরু হয়নি এই পুজো , ২০১৬ সালে কিছু বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হয় এই পুজো। কিন্তু এই আট বছরেই লস এঞ্জেলস র অন্যতম জনপ্রিয় পুজোর পরিচিত পেয়েছে ‘ভিবিসি’ র পুজো। সারাবছর ধরেই নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , পিকনিক চলতে থাকে ‘ভিবিসি ‘ র উদ্যোগে , কিন্তু ভিবিসির দুর্গাপুজো যা কিনা ‘পাড়ার পুজো ‘ নামে বেশি পরিচিত অন্য এক মাত্রা আনে লস অ্যাঞ্জেলস বসবাসকারী বাঙালির যাপনে।

সোম থেকে শুক্র অফিস কিংবা কলেজের কাজকম্ম সামলে হাতে থাকে মাত্র দুটো দিন । তাই পুজো প্রস্তুতি জোরকদমে চলে শনি আর রবিবার। প্রায় তিনমাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় পুজোর প্রস্তুতিপর্ব। পুজোর ভেনু ঠিক করা, পুজোর বিভিন্ন দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্যে বিভিন্ন কমিটি তৈরি করা , এইসব কাজ শুরু হয়ে যায় প্রায় মাস তিনেক আগে থেকেই। তবে ‘জিয়ানস্টাল’ বাঙালি এই ব্যস্ততা চেটেপুটে উপভোগ করে , কারণ কৈলাস থেকে মা আসছেন বলে কথা। এইসময় খুব মনে পড়ে যায় নচিকেতার গাওয়া সেই গান ‘ তুমি আসবে বলেই সোনালী স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে’।

চোখ জুড়ানো মণ্ডপ সজ্জা থেকে শুরু করে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব, পুরোহিতের ভূমিকা নিষ্ঠাভাবে পালন করা , সবকাজই কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। পঞ্জিকার সঙ্গে দিনক্ষণ মিলিয়ে বঙ্গভূমির সঙ্গে একই সময় দুর্গাপুজো হয়না বাইডেনের দেশে | হাতে গোনা দু একটি পুজো ছাড়া , সব পুজোই হয় উইকেন্ডে ভ্যালি বেঙ্গলি কমিউনিটির পুজোটিও হয় সপ্তাহের শেষে। এ বছর ২০, ২১ আর ২২ শে অক্টোবর বার্মিংহাম চার্টার হাই স্কুলে অনুষ্ঠিত হবে পুজো | সময় একটু কম হলেও , খামতি থাকে না আয়োজনের | ঢাকের বাদ্যি, শাঁখ –কাঁসরের মিশ্র আওয়াজ আপনাকে বুঁদ করে রাখবে, সঙ্গে সমস্ত রীতিনীতি মেনে অষ্টমীর পুজোর অঞ্জলি ,

চণ্ডীপাঠ, ধুনুচি নাচ, সন্ধ্যারতি , পাকাকলার আর ফুলের সাথে মিশে যাওয়া ধুপধুনোর গন্ধ , দশমীর দিন সিঁদুর খেলা সঙ্গে ঢাকের তালে কোমর দুলিয়ে নাচ , সবকিছু মিলেমিশে গিয়ে এই মাত্র আড়াই দিনে লস অ্যাঞ্জেলসর প্রবাসী বাঙালিকে ভিবিসি উপহার দিয়ে যায় এক টুকরো বাংলার আমেজ। এই কদিন বঙ্গপুরুষেরা শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে গরদের পাঞ্জাবি আর কোলাপুরি চটিতে সুসজ্জিত হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন তসরসিল্ক কিংবা তাঁত বেনারসীতে সুসজ্জিতা বঙ্গ রমণীদের ।’বং’ কচিকাচার দলও এই কদিন জিন্স, টি-শার্ট ছেড়ে সালোয়ার, কুর্তা পরে মণ্ডপে ঘোরাঘুরি করে।

এরপর আসা যাক ভুরিভোজের কথায় যেটা না থাকলে বাঙালির কোনো উৎসব ই ঠিক ‘ষোলো আনা’ হয়ে উঠতে পারেনা। ভ্যালি বেঙ্গলি কমিউনিটির সুস্বাদু খিচুড়ি ভোগ, পোলাও, লুচি , পাঁঠার মাংস, বেগুনী, পাঁপড় , চাটনি আর মিষ্টি পুজোর আনন্দকে একেবারে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। কচিকাচাদের জন্যে যদিও থাকে চিকেন নাগেটস উইথ ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস কিংবা পাস্তা।

ভুরিভোজের পাশাপাশি মনের রসাস্বাদনের জন্য ভিবিসি প্রতিবছর আয়োজন করে বিভিন্ন মনোগ্রাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লোকাল কলাকুশলী দের নাচ -গান -নাটকের পাশাপাশি দেশে থেকে আনা হয় জনপ্রিয় শিল্পীদের। এ বছর পুজোর অন্যতম আকর্ষণ সাহানা বাজপেয়ীর মায়াবী কণ্ঠ। ২০ শে অক্টোবর সন্ধ্যায় রুচিশীল প্রবাসী বাঙালি রা কখনও মুগ্ধ হবেন তাঁর গাওয়া ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে’ র গায়কি তে কিংবা কখনও তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমা তে গেয়ে উঠবেন ‘একটা ছেলে মনের আঙিনাতে এক্কা দোক্কা ‘ খেলে। সাহানা বাজপেয়ী কে যথাযত সঙ্গ দিতে মঞ্চ মাতাবে ‘লক্ষীছাড়া ‘ র দলও। একই মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত ,ফিউশন , লোক আর রক মিলে মিশে একাকার।

২১ শে অক্টোবর থাকছে আরও এক ধামাকাধার অনুষ্ঠান। রিয়েলিটি শো খ্যাত গৌরব সরকার আর সঞ্চারী সেনগুপ্ত মঞ্চ মাতাবেন ওইদিন বাংলা পুরাতন কিংবা আধুনিক গানে কিংবা বলিউডি মেজাজে। সব মিলিয়ে চারিদিকে একেবারে সাজো সাজো রব। আর শুধু সময়ের অপেক্ষা , তারপর কদিন বাদেই পুজো মন্ডপে দুইহাত জড়ো করে সবাই বলে উঠবেন ‘ ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সবার্থ সাধিকে, শরণ্যে ত্রন্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে’।

(Feed Source: zeenews.com)