Durga Puja 2023: কাগজের নৌকা | ছোট গল্প | ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

Durga Puja 2023: কাগজের নৌকা | ছোট গল্প | ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

একপাশে বিশাল খাড়াই পাহাড়, রাজবাড়ি বা পুরোনো বনেদী জমিদার বাড়ির প্রকাণ্ড উঁচু প্রাচীরের মতন, যার গায়ে বহুদিনের অবহেলাতেও নরম ভেলভেটের মত শ্যাওলা, জায়গায় জায়গায় ফার্ণের চারা, লতাপাতার কল্কাকাজের আলপনার মাঝে-মাঝে রঙ বাহারী ছোট ছোট ফুলের জন্ম সার্থক ভাবে সন্ধ্যা তারাকে যেন মাটির কাছে নিয়ে আসে। চারধারে কুয়াশা, একহাত দূরে কি আছে বোঝা যায় না সঠিক। কাছেই একটা ঝর্ণার নিঃসাড়ে অলক্ষ্যে বয়ে যাওয়ার কলকল শব্দ কানে আসে। বিয়াস এক হাত দিয়ে সেই পাহাড়ের গা ধরে পা টিপে টিপে শ্যাওলা মাখা পাথুরে সিঁড়ির মত ধাপগুলো এক এক করে নামছে। সিঁড়ির অপর পাশে পাহাড়ি নদী। খরস্রোতা। এখন গোধূলি বেলা, চারদিকে কেমন একটা ধোঁয়াটে নীল গাঢ় সবুজের সাথে অবলীলায় মিশে যাচ্ছে। একটু বাদেই সন্ধ্যে নামবে। কেন যে এরম অদ্ভুত শখ হয় তার মাঝে মাঝে? এই সময়ে কেউ এই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির এত কাছে আসে? সে আসে। তার খেয়ালই ওরকম। পেছনেই অবশ্য সায়াহ্ন। এক পা করে নামছে বিয়াস আর ঘাড় ঘুরিয়ে একবার করে দেখে নিচ্ছে ওকে। মাঝে মাঝে নিজেকে ধরতে বলে হাতটা বাড়িয়েও দিচ্ছে পেছন দিকে। সায়াহ্ন বার বার সতর্ক হয়ে হাত ধরছে বিয়াসের। খানিকটা নামার পর পাথর গুলো আরও পিচ্ছিল হয়ে আসছে। সন্ধ্যে নামল বলে। সায়াহ্ন বারবার বলতে থাকে “এবারে ফিরতে হবে বিয়াস… চারদিক কালো হয়ে আসছে… আর নামা ঠিক হবে না” বিয়াস ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে একটু ফিচেল হাসি দিয়ে বলে “আর একটু…” বলেই সামনে ঘাড় ঘুরিয়ে ফের নামতে থাকে। প্রায় নদীটার কোলে এসে গেছে ওরা। হু হু স্রোতের গর্জন শোনা যায়। গভীর অরণ্যানীর ভেতর থেকে কিছু ঘরে ফেরা পাখীর শেষ কলকাকলি শোনা গেল একবার। সামনেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের সাথে বয়ে যাচ্ছে বিধ্বংসী মৃত্যুর ফেনিল স্রোত। বিয়াস অর্দ্ধেক ঘাড় ঘুরিয়ে হাত বাড়ায় ফের পেছন দিকে। সায়াহ্ন ঘাড় নীচু করে ফোনে কিছু দেখছে। ফোনের আলো পড়ছে মুখে। চারপাশের প্রায় জমাট বেঁধে আসা কালোর মধ্যে একা আলোকিত সায়াহ্ন। কার আলোয়? এই সময় কার আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে তার চোখ মুখ? সে কি জানে না এই নিকষ নিবিড়ের গভীরে এই মুহুর্তটুকু খুঁজে পেতে বিয়াস অবলীলায় নিজের কত আনবিক মৃত্যুও সহ্য করতে পারে? কত অবচেতন সাজিয়েছে শুধু এই দৃশ্যে যেখানে এই এত প্রলয়ের গভীর সান্নিধ্যে সে আর তার একদম নিজের মানুষটার অনাবিল প্রেমে শুধু আশ্বাসের বিনিময় থাকবে। শুধু “আমি আছি তো” টুকুই সেখানে যথেষ্ট। সে কি কিছুই জানে না? জানে না, এখন এত আলোর প্রয়োজন নেই সায়াহ্নর? একটু অন্ধকারই আসলে এখন দরকার।

বিয়াস কয়েক ধাপ উঠে ফোনটা কাড়তে গেল। সায়াহ্নও জেদী, তাড়াতাড়ি পকেটে ফোন ঢোকাতে যেতেই হ্যাঁচকা টান দিল সেই হাতে বিয়াস… ভেসে যাচ্ছে বিয়াস, আকুল স্রোত, উথাল পাতাল ডুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, পড়িমরি হাত পা ছুঁড়ে সায়াহ্নকে খোঁজার দুঃসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে সে। কিন্তু ঘন অন্ধকার। কিভাবে সে খুঁজে পাবে এবার সায়াহ্নকে? কিভাবে? একটা স্ক্রীনে আলো ভেসে ওঠা ফোন বিয়াসের সামনে দিয়েই প্রবল তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। বিয়াস সেটাকে ধরার জন্য এবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। বলতে থাকল “কে তুমি? কেন এলে আমাদের মাঝে? কেন ভাঙলে আমার সংসার? কেন ভাসিয়ে নিয়ে গেলে ওকে? এবারে তোমায় ঠিক ধরে ফেলব আমি… দেখো… দেখো…” ফোনটা বাজছে… বেজেই যাচ্ছে।

চোখ খুলেই ঘামতে ঘামতে ফোনটার দিকে দেখল বিয়াস। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “ফোনটা তুলবে তো, বাজছে…” কথাটা বলার মধ্যেই সে দেখল বিছানায় তার পাশটা খালি। সম্বিৎ ফিরল তার। সায়াহ্ন আর নেই। সায়াহ্ন আর ফিরবে না… ফোনটা না দেখেই সাইলেন্ট করে সবার অলক্ষ্যে ভোরের প্রথম আলোয় বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল বিয়াস। মেঝেয় কাজের মেয়ে মুনাই এপাশ ওপাশ পাতলা ঘুম ঘুমোচ্ছিল। বিয়াসের কান্নার আওয়াজে উঠে বসে খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব ধীরে উঠে বিছানার পাশটায় বসে মাথা-গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে থাকল।

-ওইদিন অফিস গিয়ে থেকে একবারই ফোন করেছিল

-হ্যাঁ ওই লাঞ্চের সময় যেমন করত রোজ

-ওর কলিগ সাম্য প্রথম জানায়

-সন্ধ্যেবেলা

-না জানতাম না

-অফিসে ছিলাম। টি ভি দেখার কোনো উপায় ছিল না

-ও ছাড়া এখনও অবধি আরও ছত্রিশ জন

-না এখন আর কিছু খাব না। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট নিয়ে ওকে  আনতে যেতে হবে হাসপাতালে। রাখছি এখন।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঘরে লোক বাড়তে লাগল। সায়াহ্নর বাবা মাকে নিয়ে ওর দিদি জামাইবাবু এসে গেছে উত্তর দিনাজপুর থেকে। বিয়াস ফোনটা কান থেকে নামিয়ে কোনোক্রমে চেঞ্জ করে বাথরুম থেকে বেরোতে না বেরোতেই সায়াহ্নর মা তাকে জড়িয়ে ধরে পাগলাটে গলায় কাঁদতে লাগল, “এ কি হল মৌ? গেল রবিবার রাতেও তো তাতা ফোন করেছিল আমায়। ওষুধ ঠিকঠাক খাচ্ছি কিনা জিজ্ঞেস করল। বলছিল হাঁটুর জন্য এখানে কোন হাসপাতালে কথা বলেছে, সামনের মাসে আমায় নিয়ে যাবে ওখানে দেখাতে, কদিন থেকে যেতে বলল। আমার তাতা, আমার তাতা… এই বয়সে পুত্রশোকের এ কি জ্বালা দিলেন ঈশ্বর আমায় মৌ?”

বিয়াস কারো সামনে কাঁদতে পারে না এমনিতে। কিন্তু এখন নিজের কান্না পেয়ে গেল। তবু কোনো রকমে চেপে শক্ত হয়ে বলল “তুমি বসো। আমি ওর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা আনতে যাচ্ছি এখন। তোমরা রেস্ট নাও। আজ বিকেলেই ওর বডি ছেড়ে দেবে বলল। বাড়িতে নিয়ে আসা হবে একবার। ততক্ষণ একটু ধৈর্য্য ধরো…”

সায়াহ্নর মায়ের কানে যেন কিছুই যাচ্ছিল না। তিনি বিছানায় বসে দেওয়ালে আটকে থাকা ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে  অঝোরে কাঁদতে লাগলেন, আর আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে লাগলেন। সায়াহ্নর দিদি মধুশ্রীর স্বামী অভিজিত ঘরে এসে বিয়াসকে বলল “আমিও তোমার সাথে যাব বিয়াস”

বিয়াস একটু ইতস্তত করে বলল কিন্তু ঘরে মা দিদি একা থাকলে অসুবিধে হতে পারে, বাবার শরীরটাও ভালো নেই। আর মা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তুমি না জোর করলে কেউ কিছু দাঁতেও কাটবে না। বাবার তো ইনসুলিন নেওয়ার ব্যাপারও আছে

দিদিও আলসারের রুগী। এই অবস্থায় খালি পেটে থাকা ঠিক হবে না। মুনাই একা সামলাতেও পারবে না সবাইকে।

অভিজিত এবারে একটু গম্ভীর হয়ে বলল “কথাটা ঠিকই, কিন্তু এখন তোমাকে কারো খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি চলো, আমি যাচ্ছি তোমার সাথে। মধুকে বলে যাচ্ছি। মধু সামলে নেবে। আর বুবুন এসেছে আমার সাথে। তুমি চিনবে। আমার মাসতুতো ভাই। তাতার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ব্যাচমেট। ও রইল… কারো কিছু দরকার লাগলে ও সেদিকটা দেখে নেবে”

বিয়াস এবারে আর কথা বাড়াতে পারল না। ওর ইচ্ছেও করছে না আর কথা বলতে। অভিজিতের সাথে বাড়ির গাড়িটা নিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল।

গাড়িতে বসে বিয়াস ভেবে চলেছে সায়াহ্ন ওর মাকে আসতে বলেছিল। কই ওকে তো একবারও জানায়নি? ওর অফিসেও তো আগে থেকে ছুটির জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে হয়। হুট করে বললেই তো ছুটি পাওয়া যায় না। কোনওদিনই কি তাহলে ওর চাকরিটা মেনে নিতে পারেনি সায়াহ্ন? বিয়ের আগে পাঁচ বছরের প্রেম, তারপর এই বছর তিনেকের সংসার। এই আট বছরে কি তাহলে বিয়াসের জায়গা এক চুলও শক্ত হয়নি ওর কাছে?

বিয়াস গড়পড়তা মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, গায়ের রং হলুদ বাটা, ঢাল চুল। কথা বার্তাও বেশ চৌখস, কোনো রকম ন্যাকামি ছাড়াই কথা বলতে পারে, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারে। তুলনায় সায়াহ্ন শান্ত, রিজার্ভ, সব সময়ই মনের মধ্যে যেন কিসের একটা অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশে কোনো দিকে খুব একটা ভ্রূক্ষেপ নেই, কেমন বাঁধনহীন হাঁটাচলা, উদাস উদাস চাহনি। সেই চাহনিরই প্রেমে পড়েছিল বিয়াস। কিন্তু কোনোদিনই কি পারল ওই দৃষ্টি ভেদ করে সায়াহ্নর ভেতরের সুড়ঙ্গে নেমে আসল মানুষটাকে আবিষ্কার করতে? কত কিছুই তো সে গোপন রেখেই চলে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে, কিছুতেই তার চিন্তার আকাশ বিয়াসের কাছে উন্মুক্ত করল না। তাতে কেন মেঘ জমেছিল, কেন নিম্নচাপ হয়েছিল আর কেনই বা কোনোদিন মিঠে রোদ খেলেছিল জানা হল না বিয়াসের। চৌত্রিশ বছরের সায়াহ্ন রায়, গোটা পৃথিবীর খুব সাধারণ আর পাঁচ জনের কোটায় নিজের স্ত্রীকেও

রেখে চলে গেল। অথচ বিয়াসের গুণ, পরিচিতি, জনপ্রিয়তা সায়াহ্নর চেয়ে অনেক অনেক বেশী। একটা ছদ্ম অহংকারও ছিল এতদিন সেই কারণে। নিজের এককালের প্রেমিক তথা বর্তমান স্বামীর আর পাঁচজনের কাছে গর্ব করার একটা কারণ স্বয়ং বিয়াস। কিন্তু এখন আর কোনো গুণ, কোনো অহংকারই বিয়ের তিন বছরের মাথায় বিধবা হওয়ার কারণকে আটকানোর জন্য জোড়ালো মনে হচ্ছে না।

গাড়ি রবীন্দ্র সদন চত্বরের কাছে বড় হসপিটালটার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে নামিয়ে অভিজিত পার্কিং খুঁজতে গেল। বিয়াস নেমে এমার্জেন্সীর সামনে গাছতলায় শান বাঁধানো বেদীটার ওপর বসল, তার আশেপাশে, সামনে অপেক্ষারত বহু লোকের জটলা। অভিজিত খানিক ক্ষণের মধ্যেই এসে বলে গেল “তুমি এখানেই থাকো, আমি একটু কথা বলে আসছি।” আশপাশের মানুষের কেউ কেউ সেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের প্রায় চার দিন বাদেও স্বজন হারানোর যন্ত্রণার একই দাবদাহে আস্ফালন করছে, কেঁদে চলেছে ঘনিষ্ঠ মানুষদের কাছে। চারপাশের ভয়ঙ্কর বিষাদ বিয়াসের ঠিক ভালো লাগছে না। আসলে ও ঘরে ফিরে যেতে চায়, সায়াহ্ন আর তার ঘরটায়। নিস্তব্ধে, নিরিবিলিতে একটু ভাবতে চায় ফেলে আসা দাম্পত্য জীবনের মুহুর্ত গুলো। পার্ক স্ট্রীটে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর অফিসে চাকরী করত সায়াহ্ন শেষ সাত বছর, তার আগে পুণেতে এক গাড়ির কোম্পানীর স্পেয়ার পার্টস ডিজাইনের দায়িত্বে ছিল বছর তিনেক। সেই পুণের কোম্পানী থেকে শেষ এক বছর কলকাতায় পাঠায় সায়াহ্নকে, আর তখনই এক বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকীর ঘরোয়া আড্ডায় সায়াহ্নর সাথে পরিচয় বিয়াসের। বিয়াস তখন উদ্যমী হার্ড নিউজ জার্নালিস্ট। রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নিউজ চ্যানেল খুললেই দেখা যায় ক্যামেরায় অমুকের সঙ্গে বিয়াস ভট্টাচার্যের রিপোর্ট। সেই তুলনায় সায়াহ্ন একটু বোকা বোকা, দিশাহীন, কোনোমতে একটা চাকরি করে। ভাবখানা এমন যে চাকরিটা না করলে সবচেয়ে ভালো হত, সেদিন সেই আড্ডায় সবার অনুরোধে একটা নব্বইয়ের দশকের বহুল প্রচলিত প্রেমের গান গীটার বাজিয়ে গেয়ে শোনাল। বিয়াসের সেই সায়াহ্নকে খোঁজা শুরু, তারপর বিয়েও হল একদিন সায়াহ্নর বহু দ্বিধা-দন্দ্ব কাটিয়ে। কিন্তু কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম মতের অমিল, জীবন দর্শনের ফারাক রয়েই গেল।

পার্ক স্ট্রীটের দেড়শ বছর পুরোনো এই বিল্ডিং-এর অফিসে যেদিন আগুন লাগল, তার দুদিন আগে থেকেই খুব সামান্য এক ঘরোয়া ঝামেলায় সায়াহ্ন আর বিয়াসের কথা বন্ধ ছিল। সায়াহ্ন কোনোদিনই সুক্ষ্ম সাংসারিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি। সে বলত “ওসব ক্ষুদ্র গন্ডির চিন্তা আমাকে মোটেও নাড়া দেয় না, কিছু করতে লাগলে বোলো, করে দেব…” ক্লান্ত বিয়াস অফিস থেকে ফিরে তাই একা হাতেই আবার সংসারের খুঁটি নাটি নিয়ে হাঁতড়াতে বসত। আজ সেই ঘটনাগুলোই ওকে ভাবাচ্ছে তবে কি সায়াহ্ন স্বেচ্ছায় সেই মৃত্যুর পথ বেছে নিল? কোনো ভাবেই কি বাঁচার চেষ্টা করেনি একবারও? বিয়াসের জন্যও না? কতজন তো বেঁচেও গেছে। পরস্পরের এত কাছে থাকা সত্বেও, ভেতর-ভেতর নিজের জীবন দিয়েও দূরে যাওয়ার এত তীব্র আকাঙ্ক্ষা কোনো মানুষ কি সত্যিই লালন করতে পারে? তাহলে তো একবার অন্তত সায়াহ্ন ওর কাছ থেকে মুক্তি চাইতে পারত। কিন্তু কখনও তো সেরকম কিছু বলেনি। অবশ্য, চাইলেই কি মুক্তি দিয়ে দেওয়া যায়? বিয়াস আবার এটাও ভাবে যে ও হয়ত চূড়ান্ত অসফল হত সায়াহ্ন এরকম কিছু সত্যিই চেয়ে বসলে। তবে কি সেটা বুঝেই সায়াহ্ন নিজের চাকরীর মত ওকেও শুধুমাত্র একটা রোজনামচার খাতায় রেখে দিয়েছিল? ক্লান্ত বোধ করে বিয়াস। ঘুম পায় ওর।

পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বিয়াসের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে দেখে ডাকলেন “ঘুম হয়নি? অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। যিনি নেই  তিনি আপনার কে হন?” এতক্ষণে বিয়াস লক্ষ্য করল সেই ভদ্রলোককে, গায়ের গড়ন মাঝারি, দোহারা চেহারা। একটা চেক কাটা হাফ শার্ট পড়া। তাকে দেখে খুব সন্তপ্ত মনে হচ্ছে না। একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল বিয়াস, তবু উত্তরে কোনোমতে বলল “হাজবেন্ড।” ভদ্রলোক একই গাম্ভীর্য ও উদাসীনতা বজায় রেখে বললেন “আমার প্রাক্তন স্ত্রী পর্ণাও এখানে চাকরী করত।” বিয়াস এবারে একটু অবাক হয়ে ভ্রূ দুটো সামান্য কুঁচকে বলল “পর্ণা? মানে পর্ণা গোস্বামী? আপনার স্ত্রী ছিলেন?” ভদ্রলোক বলল “হ্যাঁ, তবে আমরা একসাথে থাকতাম না বহু দিন, প্রায় বছর দুয়েক। আবার ডিভোর্সও হয়নি আমাদের। আপনার স্বামীর নাম?” বিয়াস বলল “সায়াহ্ন রায়। আমি বেশ কয়েকবার আপনার স্ত্রীর নামটা শুনেছি। দেখেওছি ফোনে।” ভদ্রলোক এবারে একটু ইতঃস্তত করে বললেন “আমিও। তবে শুধু শুনেছি। তাও আমাদের কয়েকজন কমন ফ্রেন্ডের মুখে।” বিয়াস একটু

অবাক হয়ে বলল “শুনেছেন মানে? কি শুনেছেন?” ভদ্রলোক এবারে একটা চিলতে হাসি দিয়ে বললেন “বিশেষ কিছু নয় ঠিকই, তবে পর্ণার নামের সাথে আপনার হাজব্যান্ডের নামটা বিশেষ কৌতুকের সাথে ব্যবহার হতে শুনেছি…” বিয়াস একদম চুপ করে খানিকটা বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা। তারপর নিজেই মুখটা উদাস ভাবে অন্যদিকে ঘুরিয়ে ভাবতে লাগল পর্ণা গোস্বামী… এই নামের ফোনটা মাঝেমাঝেই আসত শেষ মাস ছয়েক, হয়ত রাতে খেতে বসেছে ওরা। সায়াহ্ন ব্যালকনিতে উঠে যেত কথা বলতে। অবশ্য কোনোদিনই অফিসের কেউ ফোন করলে ঘরে কথা বলত না। ওই ব্যালকনিতেই পায়চারী করতে করতে বলেছে। সকালে হয়ত রেডি হয়ে বেরোতে যাবে ওরা দুজনে, ভীষণ ব্যস্ততা, তখনও বেশ কয়েকবার সায়াহ্নর ফোনে ‘পর্ণা’ নামটা কানে এসেছে বিয়াসের। কিন্তু সেরকম অস্বাভাবিক কিছুই মনে করতে পারছে না বিয়াস। তবে কি সায়াহ্ন এতটাই নিখুঁত খেলোয়ার ছিল? এত সুকৌশলে তারই নাকের নীচে তারই স্বামী বিগত ছ’ মাস ধরে অফিসের এক অন্য মহিলার সাথে প্রেম করে গেল, আর সে টের পর্যন্ত পেল না! হঠাৎ বিয়াসের মনে হল এসব ভাবাটা ঠিক নয়, আজ সে নেই। তবে কি সেই অসমাপ্ত ঝগড়ার রেশ এখনো কাটেনি নিজের ভেতর? আবার ক্লান্তি আসতে লাগল বিয়াসের।

পাশে বসে থাকা ভদ্রলোকই ফের নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। দুহাতের পাতায় বেদীটাতে ভর দিয়ে কাঁধ থেকে মাথাটা মাটির দিকে ঝুলিয়ে বললেন “পর্ণা আর আমার এমনি সব ঠিক ছিল জানেন… কিন্তু একটা সাইলেন্ট ওয়ার চলত আমাদের মধ্যে, সেটা হয়ত আদর্শগত ছিল। ও সাধারণের মধ্যেও খুব অসাধারণ ছিল। কিন্তু আমি আবার একটু আমুদে মানুষ, ও অবশ্য বলত ‘মোটা দাগের’। রোববার দুপুরে মাংস ভাত, সন্ধ্যেবেলা বন্ধু বান্ধব নিয়ে একটু ভালো পানীয় হাতে হুল্লোড়, বাকি দিন নিজের ব্যবসায় জমিয়ে খাটনি… এই আমার জীবন ছিল। ওর আবার নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশ, কবিতা, বই, গান, নাটক… ওর একটা নাটকের দলও ছিল ‘আখর’, এগুলোই ভালোবাসা ছিল। চাকরিটা জাস্ট এনগেজমেন্ট, নাহলে আমার যা রোজগার ছিল তাতে ওসব চাকরি করার দরকারই পড়ত না। অবশ্য আমরা আলাদা হওয়ার পরে এই চাকরিটা ওর সারভাইভালে হেল্প করেছে অনেক। আমার কোনো কিছুই ও নিতে চায়নি। শেষ খবর পেয়েছিলাম আপনার স্বামী মানে সায়াহ্ন নাকি ওর কোন

এক নাটকে মিউজিকও ডিরেকশন দিচ্ছে। আপনি জানবেন বোধ হয়। আসলে যে কোনো দাম্পত্যকে দীর্ঘমেয়াদী করতে গেলে কোথাও না কোথাও একটা সম মানসিকতার বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে লাগে। আমাদের বিবাহিত জীবনের রান্নায় শুধু সেই বন্ধুত্বের নুন টুকুরই অভাব রয়ে গেল।”

বিয়াস এবারে রীতিমতন চমকে গেল। কি বলছে লোকটা! সায়াহ্ন মিউজিক ডিরেকশন দিচ্ছিল? এই জন্য শেষ মাস খানেক বাড়ি ফিরে বা ছুটির দিনে গীটার নিয়ে বসত নিয়ম করে, যখন তখন বেরিয়ে যেত। কই, এটাও তো ওকে বলেনি? বিয়াস বুঝল এতদিন সে যত বাকপটু ছিল, এবারে তার নিজেকে বাকরুদ্ধ করে নেওয়ার সময় এসেছে। বিয়াস আবার চুপ করে বসে রইল ভাবলেশহীন ভাবে অন্য দিকে চেয়ে।

খানিকক্ষণ পরে অভিজিত এসে বলল “বডির তো সেরকম কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, তবু যা, যেটুকু ছিল তারও সমস্ত ফর্ম্যালিটি কমপ্লিট। আমরা এবারে বডি নিয়ে বেরোব। তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো, আমি একটা ছোট্ট দরকার মিটিয়েই আসছি।”

অত্যন্ত ভারাক্রান্ত শরীরে উঠে দাঁড়াল বিয়াস। শ্লথ পায়ে এগোতে গিয়েও পেছন ফিরে একবার ভদ্রলোককে বলল “কোনোভাবেই একসাথে থাকা যায়নি, তবু এই দু বছরের লম্বা মেয়াদ কাটিয়েও কেন এলেন সেই মানুষটার শেষ দিনে?” ভদ্রলোক এবারে ঘাড়টা বিয়াসের দিকে তুলে বললেন “এই প্রশ্নের দুটো উত্তর হয়। প্রথমত, কেউ ছিল না ওর। বাবা, মা বহু আগেই গত, ও সিঙ্গল চাইল্ড ছিল। রিলেটিভরা কেউ ঘটনাটা জেনেছে কিনা আমার জানা নেই, আর আমার সাথে তাঁদের যোগাযোগও নেই। কাজেই…” একটু থেমে ভদ্রলোক আবার বললেন “আর দ্বিতীয় কারণটা আমি খুব ভালোবাসতাম বললে ব্যাখ্যা হবে কি? হবে না বোধ হয়। কারণ শব্দ দিয়ে কিছুই ব্যাখ্যা হয় না। প্রেম-ভালোবাসা একরকম, সংসারের ভালোবাসা অন্য রকম। ও আমাকে মোটা দাগের ভাবত এটাই আমার ভালো লাগা, কারণ অত তলিয়ে দোষ-গুণ ভাবলে দু বছর বাদে এই দেখাটাও হত না যে…” বিয়াস আর কথা বলার শক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না, তবু কোনোক্রমে বলল “ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। ভালো থাকবেন।”

গাড়ির পেছনে শববাহী যান পলিথিনে মোড়া, কুঁকড়ে ছোট্ট হয়ে যাওয়া সায়াহ্নর দেহ নিয়ে বাড়ির পথে আসছে। বিয়াসের মনে হল, সায়াহ্ন এখন নিঃশব্দে তার চিন্তার পিছু নিয়েছে। প্রচন্ড অভিমানের ঝোড়ো দাপট শুরু হয়েছে যেন খাঁচার ভেতর। লোকটা যে কথা গুলো বলল তার সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই ঠিকই, পুরোটাই একটা ধারণা, কিন্তু সায়াহ্নই বা কেন লুকোলো এতগুলো ঘটনা? তার চিৎকার করে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল “এগুলো আমি কি শুনে এলাম? সত্যি কি তুমি…?” পরক্ষণেই সে ভাবল এরকম চিৎকার কত ঘটনায় সে আগেও করেছে। কিন্তু সায়াহ্ন সে সব পাত্তা না দিয়ে একটা আলগা হাসির রেখা টেনে বলেছে “এবারে একটু শান্ত হও, না শুনলে বলব কি করে?” সে বলা আর হয়ে উঠত না, বিয়াসের তিন চারদিন কি এক সপ্তাহ টানা রাগের কারণে। কথাটা ভেবেই বিয়াস ভাবল সত্যি তো! কত কথা তো সায়াহ্ন বলতে চেয়েছে, সে শোনার ধৈর্য্য দেখায়নি। তাহলে কি তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই সায়াহ্ন ইচ্ছাকৃত আত্মাহুতি দিল? এত ক্ষোভে ছেলেটা জ্বলেছে ভেতর-ভেতর যে ওই বিশাল আগুনে নিজেকে বাহ্যিক ভাবে পুড়িয়ে দেওয়াটাও কোনো ব্যাপারই মনে হল না ওর? কিন্তু পর্ণা? পর্ণার জন্যেও কি বাঁচা যেত না? নাকি পর্ণার মৃত্যুতেই সে নিজেকেও সঁপে দিল? কে এত প্রশ্নের উত্তর দেবে বিয়াস জানেনা। কিন্তু ক্রমাগত এই অন্তর্দন্দ্বে আবার ঘুম পেয়ে গেল বিয়াসের। অনেক ঘুম দরকার এখন, অনেক ঘুম… প্রতিটা ঘুম একটু একটু করে সায়াহ্ন রায়কে নতুন করে রচনা করবে বিয়াসের মস্তিষ্কে। ঘুমন্ত বিয়াস শুধু প্রশ্ন করে যেতে লাগল, আমরা বন্ধু ছিলাম না?

শববাহী যান ক্ষণিকের জন্য জানলার কাচে এলিয়ে পড়া বিয়াসের পাশে এসে দাঁড়াল। ময়দানের রাস্তার ওপর তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঘুম ভেজা মাথার মধ্যে কেউ যেন সস্নেহে বলে গেল “এবারে একটু শান্ত হও…” বিয়াস দেখতে পেল না সায়াহ্নর নিথর শরীর কিভাবে তাকে ছাড়িয়ে ঘন বৃষ্টিতে মিশে গেল।

(Feed Source: zeenews.com)