Durga Puja 2023: শেষ চিঠি | ফিচার | চন্দ্রা রায়

Durga Puja 2023: শেষ চিঠি | ফিচার | চন্দ্রা রায়

চন্দ্রা রায়

সারা সকাল তিথির সংসারে যেন কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে যায়। তারপর সায়ন অফিসে আর ছেলে স্কুলে বেড়িয়ে গেলে সারা বাড়িতে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তখন তার অখণ্ড অবসর। চাকরি করা হয়নি, সেই দুঃখ ভুলতে সপ্তাহে তিন দিন একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতে যায়। এতেই তার মানসিক শান্তি। বাকি সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে আর লেখালেখি করে।

একা থাকার মুহুর্তে মাঝেমাঝেই অতীত স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় সুদূর অতীতে আর তখনই প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হয় জীবনের আনন্দ মুহুর্ত। মনে পড়ে স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কি সুন্দর সেইসব সোনালী দিনগুলো মনিমুক্তর মতো গোপনে ছড়িয়ে আছে।

তিথি দের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটা ছিল খুব সুন্দর। চারদিকে ঝিল দিয়ে ঘেরা প্রচুর গাছ গাছালিতে ভরা। তার মধ্যে রাঙা ধূলোর পথ চলে গিয়েছে বিভিন্ন বিভাগের দিকে। সেই আলোছায়া মাখা পথে দাপিয়ে বেড়াতো ওদের দশজনের দলটা। বিভিন্ন বিভাগের হলেও কীভাবে যেন বন্ধুত্ব হয়েছিল ওদের।

সবথেকে বেশি হৈচৈ করত স্বাতী। ওর নাম ছিল ঝড়। ওদের দলের সবথেকে শান্ত আর চুপচাপ ছিল নির্বাণ। প্রান্তিক গ্রাম থেকে আসা শ্যামলা মুখশ্রীতে সবথেকে সুন্দর ছিল ওর গভীর মায়াময় চোখ দুটো। সুন্দর গানের গলা ছিল ওর। আর ছিল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন।

সবাই যখন হৈচৈ করত ও চুপচাপ থাকত আর হাসত। এটা আবার অসহ্য ছিল স্বাতীর কাছে। সবসময় ওর পিছনে লেগে থাকত স্বাতী। যদিও স্বাতীর সব অত্যাচারই হাসিমুখে সহ্য করত নির্বাণ। কারণ নির্বাণ এটা জানত যে স্বাতীর বন্ধুত্বে কোনও খাদ নেই।

ধীরে ধীরে একটা সময় ওর ভারসার জায়গা হয়ে উঠল তিথি। হঠাৎ হঠাৎ ওর মনের কথা, দুঃখ, আনন্দ, ব্যাথার কথা তিথিকে বলত। আবার কখনও কিছুই বলত না। তিথির মনে হতো ও যেন সবার মাঝে থেকেও এক আলাদা জগতে বাস করে।

দিন বয়ে চলে। সামনে পরীক্ষা। তারপর শেষ হবে ওদের হস্টেল জীবন। সবাই এগিয়ে যাবে নিজের পথে। হয়ত কখনও দেখা হবে আবার হয়ত দেখা হবেনা কোনও দিনই। তবে সবাই কথা দেয় যোগাযোগ রাখার।

ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার আগে ওরা ঠিক করে কোথাও গিয়ে কটা দিন কাটিয়ে আসবে সবাই মিলে। সেইমত দল বেঁধে ওরা হাজির ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে। সারাদিনে ঘুরে বেরিয়েই কেটে গেল কটা দিন। দেখতে দেখতে এসে গেল ফিরে যাওয়ার আগের রাত। সবাই মিলে বসে রিসর্টের বারান্দায়। আবছা চাঁদের আলোয় মায়াময় হয়ে উঠেছে সামনের দৃশ্য। এরমাঝেই স্বাতীর অনুরোধে শুরু হল নির্বাণের গান, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’। এগিয়ে চলেছে গান, আর সুরের মাদকতায় সুদূরে ভেসে চলেছে বাকি নয় জনের মন। নিস্তব্ধ চরাচরে হঠাৎ নির্বাণের গলায় বেজে উঠল নতুন সুর, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’। গানের শেষের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল রীনার কথায়, ‘এটা তো তিথির প্রিয় গান’।

অবশেষে এসে গেল সেই বিদায়বেলা। পরীক্ষা শেষে এবার একে অপরের কাছে যোগাযোগ রাখা, ফোন করার মতো বহু রাখতে না পারা কথা দিয়ে চলে যেতে হবে যে যার পথে।

একে একে ক্যাম্পাস ছেড়ে সকলেই চলে গেলেও স্বাতীর অনুরোধে তিথি থেকে গিয়েছে একদিন। বিকেলে হঠাৎ ওদের হস্টেলে এসে হাজির নির্বাণ। অবাক তিথির প্রশ্ন, ‘কিরে বাড়ি যাসনি’? উত্তর না দিয়েই নির্বাণের পাল্টা প্রশ্ন, ‘গোলাপ গার্ডেনের পুকুর পাড়ে যাবি’?

ক্যাম্পাসের শেষ বিদায়ঘণ্টা বাজার আগে ওই পুকুরপাড়ে ওরা কাটিয়েছিল বহুক্ষণ। সেদিন ছিল চৈত্র মাস। মৃদু দখিনা বাতাসে ছিল ভালোলাগার ছোঁয়া। এই হাওয়াই যেন বয়ে নিয়ে এলো সেই বার্তা। হঠাৎই তিথি অনুভব করল, নির্বাণকে অনেকটা ভালবাসে সে। হয়তো এখানে না এলে বুঝতেও পারতোনা সে।

বারংবার নির্বাণের মুখের দিকে তাকিয়েছে তিথি। যদি একবার কিছু শোনা যায় ওর মুখে। প্রতিবারই তার উৎসুক চাহনিকে বিফল করে নির্বাণের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল অস্তগামী সূর্যের তেরছা হয়ে দুরে চলে যাওয়া রশ্মীর শেষ বাঁকে।

হঠাৎই খুব রাগ হয় তিথির। সঙ্গে হয়ত ছিল হালকা অভিমানের ছোঁয়া। নির্বাণকে ধাক্কা দিয়ে তিথি বলে ওঠে, ‘চল এবার ফিরি’। স্বপ্ন ভেঙে উঠে দাঁড়ায় নির্বাণ। অন্যমস্ক নির্বাণের মুখ থেকে বেরোয়, ‘যাবি? চল তাহলে’। হালকা চাঁদের আলোয় আলপথ ধরে ফিরে আসে ওরা। সেই শেষ। এরপর আর দেখা হয়নি নির্বাণের সঙ্গে।

বাড়ি ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় তিথির। ওর সব বন্ধুরাই এসেছিল বিয়েতে। আসেনি শুধু নির্বাণ। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল তিথি। আশা ছিল আসবে নির্বাণ।

কালের স্রোতে দিন বয়ে চলে। আজ সকাল থেকে সবার কথা মনে পড়ছে খুব। যোগাযোগ কমে গিয়েছে সবার সঙ্গেই। সুধু স্বাতী আসে মাঝে মাঝে। ঝড়ের মতোই আসে গল্প করে। কখনও ঘুরতে যায় ওরা দুজনে।

কিন্তু আজ এত নির্বাণের কথা মনে পরছে কেন? যেন কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে ওর গানের সুর। হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে কে বাঁধবে?

কয়েকদিন পরে হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়ার ফোন। খুব উত্তেজিত ওপারের গলা। অনেকদিন পরে দেশে ফিরেছে নির্বাণ। কিছু একটা কাজ আছে ওর। হঠাৎই স্বাতীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও যে বিদেশে সেটা জানতনা কেউই। সবশেষে স্বাতীর যে কথাটার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল তিথি, ‘নির্বাণ তোর ফোন নম্বর নিয়েছে’।

পরের দিনই এলো সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ফোন। যেন বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে আসছে সেই শান্ত গলা। একবার দেখা করতে চায় তিথির সঙ্গে। গিয়েছিল তিথি, নির্ধারিত দিনে সেই নির্দিষ্ট জায়গায়। কিন্তু না। নির্বাণ আসেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে রাগ, দুঃখ, অভিমান মেশানো এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছিল তিথি।

কয়েকদিন পরে ক্যুরিয়ারে একটা চিঠি এলো তিথির নামে। হাতের লেখা এতদিন পরেও চিনতে একটুও অসুবিধা হলনা তিথির। ইচ্ছা করছিল ছিঁড়ে ফেলে দিতে কিন্তু এক অদম্য কৌতূহলে পড়তে শুরু করল সে।

তিথি,

এই চিঠি যখন তোর কাছে পৌঁছাবে তখন আমি মাঝ আকাশে। ফিরে যাচ্ছি। সেদিন ওখানে গিয়েও তোর সামনে আসতে পারিনি। শুধু দুর থেকে দেখেছি তুই অপেক্ষা করে আছিস। তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা, শুধু তোর জন্যই আমার দেশে ফেরা। শুধু তোকে একবার দেখবো বলে। এই পৃথিবীতে আর মাত্র কয়েক দিনের অতিথি আমি। খুব তারাতারি চলে যাবো তারাদের দেশে। ওখান থেকেই তোকে দেখব প্রতিদিন। ভালো থাকিস নিজের সংসারে।

শুধু সেদিন গোলাপ বাগানে অনেক চেষ্টা করেও যে কথা তোকে বলতে পারিনি সেটা বলে যাই – ‘প্রহর শেষের রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্র মাষ, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’।

(Feed Source: zeenews.com)