আনন্দেই আছে সানন্দ: যেখানে গাড়ি কারখানা হওয়ার কথা ছিল, সেই জমিতেই এখন কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে মাছ চাষ হচ্ছে! একসময় রাজ্যের শিল্পের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে যে সিঙ্গুরের নাম উঠে এসেছিল, সেটাই কার্যত আজ পরিণত হয়েছে শিল্পের সমাধিতে। সভ্যতার চাকা, যা বদলে দিতে পারত সিঙ্গুরের ভাগ্য। কিন্তু তা হয়নি। বরং সেই চাকার দৌলতে খুলে গেছে সানন্দের কপাল। গুজরাতের এই অখ্যাত গ্রাম যা আজ কার্যত শিল্পের হাবে পরিণত হয়েছে।
আমদাবাদ থেকে ৩৫ কিমি দূরে, GIDC সানন্দে তৈরি হয়েছে এই কারখানা। যা তৈরি হওয়ার পরে ছবিটাই বদলে গেছে। আর এই বদলে উচ্ছ্বসিত স্থানীয়রাও। দশ বছরে একদম উল্টে গিয়েছে ছবিটা। তৈরি হয়েছে জনবসতি। বেড়েছে জীবিকার পথও। যার কৃতিত্ব টাটা গোষ্ঠীকেই দিচ্ছেন তাঁরা। সানন্দের এক বাসিন্দার কথায়, “এখানে ১০ বছর আগে কিছু ছিল না। টাটারা আসার পরে পরিবেশটাই বদলে গেছে। এত লোকজন আসছেন। কর্মীরা আসছেন মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে। ভিতরে বেশ কয়েকটা কলোনি তৈরি হয়েছে।’’
বাংলায় শিল্পায়নের আশায় কলকাতায় বসেছে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। আর সেখান থেকে, ৪৫ কিলোমিটার দূরে হুগলির সিঙ্গুর আর প্রায় ২৩০০ কিলোমিটার দূরে গুজরাতের সানন্দ। তিন জায়গার ছবির ফারাকটা সহজেই বোঝা যায়। সিঙ্গুর থেকে সানন্দে টাটা গোষ্ঠীর চলে যাওয়ায় ঠিক কতটা উপকার হয়েছে তা উঠে এসেছে সেখানকার বাসিন্দাদের কথাতেই। সানন্দের ব্যবসায়ী হীতেশ কুমার কুন্দন বলেন, “এখানে আগে জঙ্গল ছিল। টাটাদের ন্যানো আসার পরে এখানে উন্নতি হয়েছে। অনেক দোকানপাট হয়েছে।’’ গুজরাতের সানন্দ অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ বলীয়ান হচ্ছে। ২০১০ সালে সানন্দে কারখানা তৈরির পরে, সামনেই কর্মীদের জন্য খাবারের দোকান দিয়েছিলেন। এই কারখানার জন্যই সংসার এখন তরতরিয়ে চলছে অনেকের। এক ব্যবসায়ী বলছেন, “রুজি-রুটি চলছে সবার। চায়ের দোকান, হোটেল চলছে আমাদের। ওদের জন্য আমাদেরও ব্যবসা বেড়েছে।”
সিঙ্গুর থেকে চলে যাওয়ার পরে, সানন্দে ১১০০ একর জমিতে নতুন কারখানা গড়ে টাটারা। সময় লাগে মাত্র ১৪ মাস। প্রায় ১৩ বছর আগে ২০১০-এর জুনে প্রথম ন্যানো উৎপাদন শুরু হয়। এরপর টিয়াগো এবং টিগর – এই দুটি মডেলের উৎপাদন হচ্ছে এখানে। ২০১৭ সালে টিগর-ইলেকট্রিক ভেহিকল মডেলের গাড়ি তৈরি শুরু হয় এই কারখানায়। সানন্দে টাটাদের এই কারখানায় দৈনন্দিন ৪০০টি করে গাড়ি তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিদিন ২টি করে শিফটে কর্মীরা কাজ করেন।
২০০৬ সালে সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন রতন টাটা। এক বছরের মধ্যে ন্যানো কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তারপরই শুরু হয় তৃণমূলের জমি আন্দোলন। তারপরের ঘটনা সকলেরই প্রায় জানা। ১৫ বছর আগে রাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন টাটারা। সানন্দে যখন আনন্দের ছবি। তখন এ বাংলার বুকে সিঙ্গুরের ছবিটা একেবারে ভিন্ন। যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ার কথা ছিল তা আজ ধূ ধূ প্রান্তর। আদালতের নির্দেশে জমি ফেরত পেয়েছেন জমিদাতারা। তবে তাতে না হয়েছে শিল্প, না হয়েছে আগের মতো চাষাবাদ। কালের নিয়মে সেই জমিতেই এখন মাছ চাষ হচ্ছে। তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম জলাশয়। তাতে খেলে বেড়াচ্ছে মাছ।
সানন্দে টাটাদের কারখানা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরেই শ্রমিকদের থাকা জন্য তৈরি করা হয়েছে বারন্তি, বড়চারক্রি নামে একাধিক কলোনি। আর সেখানেই কর্মরত এই রাজ্য থেকে যাওয়া একাধিক বাঙালি যুবক। উত্তর ২৪ পরগনা থেকে পশ্চিম বর্ধমান, এরাজ্যের বিভিন্ন জেলার মানুষ কাজ করছেন সেখানে। যাঁদের কথায় উঠে এল ভিন রাজ্যে গিয়ে কাজ করার আক্ষেপের কথা। কেউ কেউ বলছেন পরিযায়ী শ্রমিকের তকমা লেগে গেল।
উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের বাসিন্দা রবি দাস বর্তমানে টাটাদের কারখানার কর্মী। ভিনরাজ্যে গিয়ে কাজ করায় তাঁর গলাতেও আক্ষেপের সুর। তাঁর প্রশ্ন “কেন মন খারাপ হবে না বলুন? কোম্পানি নিজের এলাকা থেকে উঠে চলে এসেছে এখানে। সেটা তো আমাদের পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে দেখা গেল, সেটা অনেকটা লস। পাবলিকের, সরকারের, প্রত্যেকেরই লস।” তিনি আরও বলেন, “আজ কোম্পানি ওখান থেকে উঠে আসার ক্ষেত্রেই, আমাদের ওখান থেকে চলে আসতে হয়েছে। পশ্চিমবাংলা ছেড়ে আমাদেরও গুজরাতে চলে আসতে হয়েছে আজকে।’’ টাটাদের কারখানায় কর্মরত দুর্গাপুরের বাসিন্দা অয়ন মোহান্তি। সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ার আক্ষেপ এখনও রয়ে গিয়েছে মনে। তিনি বলেন, “বাইরে আছি। পরিযায়ী শ্রমিক হয়েই। একটা তকমা লেগে গেছে মনের মধ্যে। কিন্তু, যদি সিঙ্গুরে হত, তাহলে ভাল হত। ওখানে হওয়া উচিত ছিল। অনেকজন চাকরি পেত। আর বাংলায় তো এখন সেরকম চাকরি বলতে গেলে নেই। এখন নর্মাল একটা বিটেকের স্টুডেন্টও দেখছি, ওদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে।’’
শুধু সানন্দের বারন্তি কলোনিই নয়, এই কারখানার সৌজন্যে থারাল, ছারোডি, বলগাঁওয়ের মতো আশেপাশের গ্রামগুলিরও চেহারা বদলে গেছে। ঝাঁ চকচকে সড়কপথ। আর ছারোডি রেল স্টেশনের মাধ্যমে বেড়েছে যাতায়াতের গতি। ওই এলাকার এক দোকানদার নরেন্দ্রসিন বাঘেলা জানাচ্ছেন “সরকার ২৮-৩০ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। প্রত্যেক কৃষককে টাকা দেওয়া হয়েছিল। যত ছোট কৃষকই হোক না কেন, কেউ ৫, কেউ ২৫, কেউ ৫০, সরকার অনেক টাকার বিনিময়ে জমি নিয়েছিল। আশেপাশের এলাকায় আগে ২৫-৩০ হাজার টাকাতেও কেউ জমি নিতে চাইত না। আজ ওই সমস্ত জমির দাম কোটি টাকা।’’
(Feed Source: abplive.com)