ঝরেছে জৌলুস, কমেছে সংখ্যা, কেমন আছে এদেশের ডাকবাক্সেরা?

ঝরেছে জৌলুস, কমেছে সংখ্যা, কেমন আছে এদেশের ডাকবাক্সেরা?
পায়েল মজুমদার, কলকাতা: …’অবান্তর স্মৃতির ভেতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফেরত চাহো কিনা?’
(‘চাবি’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

হোয়াটসঅ্য়াপ, ই-মেলে এমন কিছু ফেরত চাইতে হলে আশ মেটে নাকি? ‘অবান্তর স্মৃতির’ কথা না হয় আপাতত বাদ থাক। সরকারি চাকরির আবেদনপত্র, নানা রকমের আইনি নথি –‘সফট কপি’পাঠিয়েও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়? মাথায় কালো টুপির মতো, পেটমোটা লাল রঙের ডাকবাক্সে যতক্ষণ পর্যন্ত জরুরি চিঠি বা নথি স্বহস্তে ফেলা না  হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি নেই। এই ডিজিটাল কমিউনিকেশনের যুগেও তাই  টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মরচে ধরা লাল ডাকবাক্স (Post Box In India)। অতীতের জৌলুস কমেছে, এখন অত ঘন ঘন তাকে দেখাও যায় না। তাতে কী? ইন্টারনেটের আগ্রাসনেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার নাম লাল ডাকবাক্স (Red Post Box In India)।

সুদূর অতীত থেকে…
আমাদের দেশে ডাকবাক্স বা সার্বিক ভাবে আধুনিক ডাক পরিষেবার ইতিহাস ব্রিটিশ ঔপনেবেশিক শাসনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যেমন ১৭২৭ সালে ভারতে প্রথম পোস্ট অফিস নির্মাণ করে কলকাতায়। ১৭৭৪ সালে আমাদের এই কলকাতা শহরেই তৈরি হয় দেশের প্রথম জেনারেল পোস্ট অফিস বা জিপিও। পরিকাঠামোর প্রয়োজনে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ডাকবাক্সের সংখ্যাও। তবে মজার ব্যাপার হল, মানুষের বিবর্তনের মতো ডাকবাক্সের চেহারা-ছবিও বহু বদলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কী রকম? একবার চোখ বোলানো যাক?

(লাহৌল-স্পিতি এলাকায় তৈরি হচ্ছে পোস্ট অফিস। ছবি:PTI)

চ্যানেল আইল্যান্ডস বক্স (১৮৫২)
এটি একেবারে গোড়ার দিকের ডাকবাক্স। ব্রিটিশ পোস্ট অফিসে এগুলিই ব্যবহার হত। সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা থাকত VR। অর্থাৎ কুইন ভিক্টোরিয়া।

লন্ডন অরনেট বক্স (১৮৫৭-১৮৫৯)
ডাকবাক্সের উন্নততর নকশা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের শিল্প ও বিজ্ঞান দফতরের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তার পরই তৈরি হয় লন্ডন অরনেট বাক্স। দেখতে সুন্দর, মুশকিল একটাই। পত্রপ্রেরক যে ফাঁকা অংশটি দিয়ে চিঠি ফেলবেন, গোড়ার দিকের নকশায় সেই ফাঁকা জায়গাটি রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন ডাকবাক্সের নির্মাতারা।

ওয়াল বক্স (১৮৫৭)
খরচে রাশ টানতে বানানো হয় এই ধরনের ডাকবাক্স। এগুলি দেওয়ালের ফাঁকা অংশের মধ্যেই বসিয়ে দেওয়া যেত, আলাদা করে পিলার বক্স তৈরির ঝামেলা নিতে হত না ব্রিটিশ সরকারের পোস্ট অফিসগুলিকে। তবে মূলত গ্রামের দিকেই এগুলি বেশি ব্যবহার করা হত।

ফার্স্ট ন্যাশনাল স্ট্য়ান্ডার্ড (১৮৫৯)
এই ডাকবাক্সটি ছিল সবুজ রঙের। এক এক জায়গায় এক এক রকম নকশার ডাকবাক্স যাতে না থাকে, সে জন্য গোটা ব্রিটেনজুড়েই ‘ফার্স্ট ন্যাশনাল স্ট্য়ান্ডার্ড’-র আদলে ডাকবাক্স বসানো হতে থাকে। এটিই ছিল এখনকার চেনা নলাকৃতি ডাকবাক্সের প্রথম ব্যবহার।

ভিক্টোরিয়ান টাইপ এ লেটার বক্স (১৮৭৯)
এই লাল-কালো ডাকবাক্সেই প্রথম নলাকৃতি দেহের উপর উত্তল ও গোলাকার ঢাকনা ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের শহরে যে কটি ডাকবাক্স দেখা যায়, তার সঙ্গে এই ডাকবাক্সগুলির বেশ মিল পাওয়া যাবে।

ধীরে ধীরে আরও বদল আসে ডাকবাক্সের নকশায়। ‘ল্যাম্প বক্স’ (১৮৯৬),’এয়ার মেল পিলার বক্স'(১৯৩০) ‘এফ টাইপ পিলার বক্স’ (১৯৬৮) এবং ‘কে টাইপ পিলার বক্স’ (১৯৮০)। এর মধ্য়ে ঢালাই লোহা দিয়ে তৈরি ‘কে টাইপ পিলার’বক্সের যে সময়ে প্রচলন হয়েছিল,সেই সময়ের নিরিখে তাকে ভীষণ আধুনিক নকশা বলে মনে করা হলেও খুব বেশি বছর এটির দাপট ছিল না। ২০০০ সালে এই ডাকবাক্সের নির্মাণ বন্ধও হয়ে যায়।

ভারত ও ডাকবাক্স…
মজার বিষয় হল, ব্রিটেনে ডাকবাক্স তথা ডাক পরিষেবার উপর এত নজর দেওয়া হলেও পৃথিবীর প্রথম ‘এয়ারমেল’চালু হয়েছিল আমাদের দেশে। ভারত তখনও  ব্রিটিশ উপনিবেশ। ১৯১১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এলাহাবাদ থেকে নৈনি পর্যন্ত চিঠিপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য উড়ে গিয়েছিল একটি বেসরকারি বিমান। বিশ্বের ইতিহাসে যা কিনা প্রথম।  ডাক পরিষেবায় এমন একাধিক ঐতিহাসিক রেকর্ডের সঙ্গে ভারতের নাম জড়িয়ে। শুধু তাই নয়। ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর তথ্য় অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ দেশে পোস্ট অফিসের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৯৩৯, যা দিয়ে নিরন্তর নানা পরিষেবা দিয়ে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম ডাক ব্যবস্থা। সংখ্যার বিচারে,পোস্ট অফিসের পাঁচ গুণ ডাক বাক্স দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে। সোজা হিসেবে, দেশে ডাকবাক্সের সংখ্যা ৫ লক্ষেরও বেশি।

(বছরচারেক আগে কুম্ভমেলায় পুণ্যার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে পোস্ট অফিস তৈরি করেছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। সঙ্গে ছিল লাল ডাকবাক্স। ছবি:ANI X handle)

ভাবছেন ই-মেল ও হোয়াটসঅ্যাপের যুগে এদের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? তা হলে আরও কয়েকটি পরিসংখ্যানে নজর রাখা যাক। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো জানাচ্ছে, ফি-বছর গড়ে ২০.৪৮ কোটি রেজিস্টার্ড চিঠি এবং ৫৪০.৭১ কোটি আনরেজিস্টার্ড চিঠি লেনদেন করে ইন্ডিয়া পোস্ট। অর্থের বিচারে ২০১৪-১৫ সালে ১১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছিল ইন্ডিয়া পোস্ট । সংখ্যা যদি কথা বলে,তা হলে এটা স্পষ্ট যে চিঠিপত্তর এখনও ‘জঞ্জাল’ নয়। মরচে ধরা ডাকবাক্সের জৌলুস গেলেও সময় পুরোপুরি যায়নি।

ডাকবাক্স নিয়ে টুকিটাকি…
এখন প্রশ্ন হল, যে ডাকবাক্স ব্রিটিশ শাসনের সুবাদে ভারতে চালু হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের বড় অংশের ধারণা, সেটি ব্রিটেনে চালু হল কী ভাবে? সে জন্যও ইতিহাসের দিকে তাকানো ছাড়া গতি নেই। সালটা ১৮৪০। গ্রেট ব্রিটেনে চালু হল পোস্টাল রিফর্ম অ্যাক্ট, ১৮৪০। সস্তায় চিঠিপত্র পাঠানো ও সহজে ব্যবহার করা যায় এমন আঁঠালো স্ট্য়াম্প, এই দুটির সঙ্গে ব্রিটেনবাসীর পরিচয় ঘটে এই রিফর্মের মাধ্যমে। কিন্তু তার পরও একটা সমস্যা ছিল। যেখানে চিঠিপত্র সংগ্রহ করা হবে, ডাক পরিষেবার অফিসগুলি বেশ কয়েকমাইল দূরে দূরে ছিল। তা হলে কি সাধারণ মানুষ এত দূরে গিয়ে চিঠি ফেলে আসবেন? ভিক্টোরিয়ান যুগের সাহিত্যিক তথা জেনারেল পোস্ট অফিসের আধিকারিক অ্যান্টনি ট্রলোপের নজর কাড়ে এই সমস্যা। এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর খেয়াল হয়েছিল, ইউরোপের বহু জায়গায় ঢালাই লোহার তৈরি এমন বাক্স দেখেছেন যেখানে সাধারণ মানুষ চিঠি ফেলে দেন। তার পর দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেই চিঠি সংগ্রহ করে নিয়ে যান ডাক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। সেই ভাবনা থেকেই ১৮৫২ সালে চ্যানেল আইল্যান্ডে প্রথম ডাকবাক্স চালু করেন তিনি। তার পরের বিবর্তনটি কিছুটা জানা।

(ভারতের ‘প্রথম’ পোস্ট অফিস কূপওয়ারায়। ছবি:PTI)

দেশের প্রাচীনতম ডাকবাক্স…
গত বছর শিল্পপতি হর্ষ গোয়েঙ্কার একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। শিল্পপতি দাবি করেছিলেন, বেঙ্গালুরুর তাজ ওয়েস্টএন্ডে একটি লেটারবক্স রয়েছে যা কিনা দেশের প্রাচীনতম সচল লেটারবক্স। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়। শিল্পপতির সোশ্য়াল মিডিয়া পোস্টের পর একাধিক পোস্ট উঠে আসতে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কম-বেশি প্রত্যেকের একই দাবি ছিল। তবে সেই দাবি কতটা সত্য?ঠিক কোথায় প্রথম চালু হয়েছিল ডাকবাক্স?বিতর্ক চলুক, গবেষণাও।
মাঝে হয়তো আরও কিছু মরচে পড়বে ডাকবাক্সে। কিন্তু চিঠিপত্তরের দেওয়া-নেওয়া, মানুষের কথার লেনদেন যেন না ফুরোয়। তা হলেই অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে চেনা লাল ডাকবাক্স।

তথ্যসূত্র:https://www.postalmuseum.org
তথ্যসূত্র:https://www.indiapost.gov.in
তথ্যসূত্র:https://heritagecalling.com
তথ্যসূত্র:https://pib.gov.in