সৌমিতা মুখোপাধ্যায়
১৯৯৫ সালে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’-র সেই আইকনিক সিন, লন্ডন ফিরে যাচ্ছেন প্রবাসী ভারতীয় রাজ, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, বিয়ের লেহেঙ্গায় স্টেশনেই রয়ে গেছেন প্রেমিকা সিমরন, তাঁর হাত চেপে ধরে রেখেছেন বাবা, পাশে তাঁর হবু বর, আচমকাই এত প্রেম দেখে মন বিগলিত বাবার, বললেন ‘যা সিমরন যা জিলে আপনি জিন্দেগী’, হল ফেটে পড়ল সিটিতে। পঞ্জাবে কার্যত বিয়ের মন্ডপ থেকে কনেকে নিয়ে গেলেন প্রবাসী ভারতীয় রাজ। কাটু টু ২০২৩, রাজকুমার হিরানির ছবি ‘ডাঙ্কি’র দৃশ্য, পাঠানকোটে ঘোড়ায় বসে হরদয়াল সিং ধিলোঁ, প্রবাসী ভারতীয় প্রেমিকের সঙ্গে পালাল তাঁর হবু কনে। সারা পাঠানকোটে আজীবনের জন্য হাসির পাত্র হয়ে রয়ে গেলেন হার্ডি। একই ঘটনা ঘটেছে পঞ্জাবের লাল্তুর সুখীর জীবনেও। কেন বারবার প্রেমিকাকে নিয়ে চলে যায় প্রবাসীরা, প্রশ্ন তুলেছেন শাহরুখ তথা পর্দার রাজ ও হরদয়াল সিং ধিলোঁ? যে রাজ-সিমরণের প্রেমকে আদর্শ মেনে চলল কয়েকটা জেনারেশন, চোখে আঙুল দিয়ে সেই প্রেমের অপর পিঠও দেখিয়ে দিলেন কিং অফ রোমান্স। অন্য আরেক দৃশ্যে শাহরুখই আবার অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের সেই জনপ্রিয় সংলাপ ‘মর্দ কো দর্দ হোতা হ্যায়’ ভেঙে দিয়ে বলছেন, ‘মর্দ কো ভি দর্দ হোতা হ্যায়’। ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’-এর কড়া অ্যাকশনের পর পুরনো ইমেজে ফিরেছেন শাহরুখ আর রোমান্টিক দৃশ্যে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন কেন তিনি কিং অফ রোমান্স।
ছবির মূল বিষয় যে শরনার্থী সমস্যা তা ছবির নাম থেকেই স্পষ্ট। ‘ডাঙ্কি’ শব্দের অর্থ বেআইনিভাবে অর্থাৎ বিনা ভিসায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া। এই ছবিতে পঞ্জাবের কয়েকজন যুবক-যুবতী বাল্লি, বুগ্গু, মনু, সুখী তাঁদের পরিবারের জন্য টাকা রোজগার করতে লন্ডনে যেতে চায়। অন্যদিকে একজনকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির হন হার্ডি, যিনি একজন সেনা। কিন্তু লাল্তুতে এসে এক মৃত ব্যক্তির ঋণ মেটাতে ও মনুর প্রেমে পড়ে হার্ডিও সামিল হয়ে যায় সেই জার্নিতে। এখান থেকে শুরু হয় তাঁদের ডাঙ্কি মারার জার্নি। যাঁরা একদিন যেকোনও উপায়ে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন, ২৫ বছর পর দেখা যায় তাঁরাই ফিরতে চাইছেন দেশে। সিনেমার ভাষায় হালকা মেজাজেই অভিবাসনের মতো গুরুতর সমস্যার আইনি ও বাস্তব জটিলতা তুলে ধরেছেন পরিচালক রাজকুমার হিরানি। পরোক্ষভাবে বুঝিয়েওছেন এর ভালো ও মন্দ দিক। প্রেমের গল্পের প্রেক্ষাপটে অভিবাসনের মাধ্যমে কোথাও যেন তুলে ধরেছেন ভারতের আর্থ সামাজিক অবস্থা, চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন দেশপ্রেম এমনকী মাতৃভাষাকেও।
এই ছবির মুখ্য চরিত্র হার্ডি তথা শাহরুখ খান আবারও প্রমাণ করেছেন শুধু ‘পাঠান’ বা ‘জওয়ান’ এর মতো অ্যাকশন নয়, অভিব্যক্তি, অভিনয়েও তিনি ছক্কা হাঁকাতে পারেন। ছবি জুড়ে তিনি হাসিয়েছেন, আবার কোনও দৃশ্যে অজান্তেই দর্শকের গাল বেয়ে নেমে এসেছে অশ্রু। তিনি আবারও প্রমাণ করে দিয়েছেন যে রোমান্সে তিনি এখনও সেরা। মনু অর্থাৎ তাপসী যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেরকম চরিত্র আগে দেখেছে ভারতীয় সিনেমার দর্শক। তবে অভিনয়ের কোনও সুযোগ ছাড়েননি তাপসী। স্ক্রিন জুড়ে যখন শাহরুখের মতো মেগাস্টার রয়েছেন তখন কিন্তু তাঁর পাশে একটুও ম্রিয়মাণ হয়ে যাননি ভিকি, তাপসী বা এই ছবির আরও দুই অভিনেতা বিক্রম কোচর, অনিল গ্রোভার। শিক্ষকের চরিত্রে বোমান ইরানি মনে করিয়ে দেন থ্রি ইডিয়টসের ভাইরাসের কথা। তবে বিশেষ অতিথি হয়েও শুধুমাত্র অভিনয় ক্ষমতার জেরে এই ছবির অন্যতম পাওনা সুখীর চরিত্রে ভিকি কৌশল। ছোট চরিত্রেও কীভাবে দর্শকের মন জয় করা যায় তা শিখিয়ে দিলেন ভিকি।
রাজকুমার হিরানি, অভিজাত যোশী, কণিকা ধিলোঁর লেখা গল্পে কোনও খুঁত নেই। কিন্তু সেই গল্পকে পর্দায় তুলে ধরার সময় আরও একটু বিশেষ নজরের প্রয়োজন ছিল। রাজু হিরানির ছবি তৈরির ক্রাফট এই ছবির অন্যতম পাওনা, প্রোডাকশন ডিজাইন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং পুরো ছবিতে গানের ব্যবহার ছিল রাজকুমারচিত। প্রীতমের সুরে ঘরে ফেরার গানে চোখে জল আনবে সোনু নিগমের কন্ঠ। ট্রেলারেই স্পষ্ট ছিল যে এই ছবিতে দুটো সময় দেখানো হবে। সেই মতোই এই ছবিতে ২৫ বছরের যে সফর দেখানো হয়েছে তাতে চরিত্ররা প্রয়োজনের তুলনায় যেন একটু বেশিই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ছবির বেশ কিছু দৃশ্যে আপনার মনে পড়ে যাবে শাহরুখের ডিডিএলজে ও বীর-জারা ছবির কথা। হাসি, কান্না, মজা, দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, প্রেম, বিচ্ছেদের মিশেল শাহরুখের ডাঙ্কি। কিন্তু কোথাও যেন এক সুতোয় বাঁধা হল না সবকিছুকে। সংলাপে হাসির রোল ওঠার কথা থাকলেও কোথাও যেন কমিক টাইমিংয়ে রয়ে গেল সমস্যা। শাহরুখ কিং অফ রোমান্স হলেও তাপসীর সঙ্গে রসায়নে থেকে গেল কিছু ফাঁক।
কিছু খামতি থাকলেও তা ছাপিয়ে গেছে ‘ডাঙ্কি’। শরনার্থী সমস্যার সঙ্গে পরিচালক রাজকুমার হিরানি যেভাবে মিশিয়েছেন প্রেমকে তার জন্য কোনও তারিফই যথেষ্ট নয়। বিশ্বের অন্যতম সংকটকে সরলভাবে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তি হার্ডির সঙ্গে। মোহ কেটে গেলে যেভাবে মানুষ ভালোবাসার কাছে ফেরে, ঠিক সেভাবেই একটা সময়ের পরে দেশের কাছে ফিরতে মরিয়া হয়ে ওঠে শরণার্থীও। শাহরুখের মাধ্যমে রাজু হিরানি বুঝিয়েছেন শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়েই মানুষ শরণার্থী হয়ে ওঠে না, প্রেম থেকে দূরে গিয়েও মানুষ শরণার্থী হয়ে ওঠে। ভালবাসাহীন হয়ে বাঁচাও আসলে শরণার্থী হয়ে থাকা, বুঝিয়ে দিলেন শাহরুখ খান ও রাজকুমার হিরানি জুটি।
(Feed Source: zeenews.com)