গায়ে টোকা দিতে সফল NASA, চাঁদের বুকে নিদ্রারত ল্যান্ডার বিক্রমের খোঁজ মিলল অবশেষে

গায়ে টোকা দিতে সফল NASA, চাঁদের বুকে নিদ্রারত ল্যান্ডার বিক্রমের খোঁজ মিলল অবশেষে

নয়াদিল্লি: প্রায় এক চন্দ্রদিবস চাঁদের মাটিতে থাকার পর গা ঢাকা দিতে হয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে আর ঘুম ভাঙেনি ভারতের চন্দ্রযান-৩ মহাকাশযানের ল্যান্ডার ‘বিক্রমের’। নিরাপদে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার পর সফল ভাবে নিজের কার্য সম্পাদন করে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’। কিন্তু চাঁদের বুকে রাস্তাঘাটের উপর পৃথিবীবাসীর নিয়ন্ত্রণ না থাকার জন্যই তার অবস্থান নিয়ে ধন্দ ছিল। এবার ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’র গায়ে কার্যত টোকা দিয়ে, তার অবস্থান নিশ্চিত করা গেল। (NASA Pings Lander Vikram) চাঁদের বুকে নিদ্রারত ল্যান্ডার ‘বিক্রম’কে তাই ল্যান্ডমার্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA এই অসাধ্য সাধন করেছে। ভারতের চন্দ্রযান-৩ অভিযানে NASA-রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’ চাপিয়ে বিস্কিটের আকারের ছোট একটি রেট্রোরিফ্লেক্টর চাঁদে পাঠায় NASA. গায়ে আলো ফেললে, পাল্টা আলো প্রতিফলিত করে নিজের আবস্থানের জানান দেয় সেটি। যত দূর থেকেই আলো ফেলা হোক, যে কোণ থেকেই আলো ফেলা হোক, পাল্টা সাড়া মেলাই দস্তুর।। ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’ বসানো সেই রিফ্লেক্টর থেকেই সাড়া পেল NASA. (Chandrayaan-3)

NASA-র তরফে বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, গত ১২ ডিসেম্বর, পৃথিবীর সময় অনুযায়ী দুপুর ৩টে নাগাদ Lunar Reconnaissance Orbiter থেকে Laser Altimeter Instrument থেকে ‘বিক্রমে’র দিকে তীক্ষ্ণ আলো ফেলা হয়। কিছু ক্ষণ পর সাড়া মেলে ‘বিক্রমে’ বসানো রিফ্লেক্টর থেকেও। সেখান থেকেও আলোক তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। পাইগান থেকে নির্গত তীক্ষ্ণ আলোর মতো, আলোর সূক্ষ্ম তরঙ্গের মাধ্যমেই এই বার্তালাপ ঘটে। ওই আলোকরেখার মাধ্যমে দূরত্বও নির্ধারণ করা হয়। যে সময়ের মধ্যে আলো গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছয়, সেই নিরিখে দূরত্ব নির্ণয় করেন বিজ্ঞানীরা।

২০০৯ সালের ১৮ জুন Lunar Reconnaissance Orbiter নামের স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযানটির উৎক্ষেপণ করে NASA. মেরু অঞ্চল বরাবর চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সেটি। ওই মহাকাশযান থেকে আলো ফেলেই ‘বিক্রমে’র থেকে সাড়া পেয়েছে NASA. ভারতের ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এই মুহূর্তে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে Manzinus গহ্বরের কাছে অবস্থান করছে বলে জানা গিয়েছে। NASA-র Lunar Reconnaissance Orbiter থেকে ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’র দূরত্ব এই মুহূর্তে ১০০ কিলোমিটার।

আমেরিকার মেরিল্যান্ডে NASA-র গোদার্দ স্পেস ফ্লাইট সেন্টার থেকে এই কার্য সম্পাদক করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিজ্ঞানী শিয়াউলি সুন। তিনি বলেন, “কক্ষপথ থেকে চাঁদের মাটিতে নিজেদের রেট্রোরিফ্লেক্টরের অবস্থান নির্ধারণ করতে পেরেছি আমরা। তবে আরও উন্নতি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের অভিযানে রেট্রোরিফ্লেক্টর ব্যবহারের অভ্যাস রপ্ত হয়।”

NASA জানিয়েছে, ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’ তাদের যে রেট্রোরিফ্লেক্টর বসানো রয়েছে, সেটিকে লেজার রেট্রোরিফ্লেক্টর অ্যারে বলা হয়। আয়তন ২/৫ সেন্টিমিটার। গম্বুজের মতো দেখতে এই রেট্রোরিফ্লেক্টরটি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি। ওজন ২০ গ্রাম। তার উপর বৃত্তাকার খোদাই করা বৃত্তাকার ছিদ্রের মধ্যে বসানো রয়েছে কাচ। একেবারে সাদামাটা নকশা, টেকসইও। আলাদা করে বিদ্যুৎ বা অন্য কোনও শক্তির প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই দেখভালেরও। এমনিতেই কয়েক দশক টিকে যেতে পারে। কাচগুলি এমন ভাবে বসানো রয়েছে, যাতে যে কোনও দিক থেকেই আলো এসে পড়ুক, সেই পথেই আলো প্রতিফলিত হয়।

‘অ্যাপোলো’ অভিযানের সময় থেকেই এই ধরনের রেট্রোরিফ্লেক্টর ব্যবহার করে আসছে NASA. প্রতি বছর পৃথিবী থেকে চাঁদ যে ১.৫ ইঞ্চি করে দূরে সরে যাচ্ছে, তা, ব্রিফকেসের আকারের একটি রেট্রোরিফ্লেক্টর মারফতই জানা যায় প্রথম বার। তারই নয়া সংস্করণ এই ক্ষুদ্রাকার রেট্রোরিফ্লেক্টর। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনেই এগুলি ব্যবহার করা হয়। সেগুলির অবস্থানের নিরিখেই মহাশূন্যে জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়। আগামী দিনে ওই রেট্রোরিফ্লেক্টর ব্যবহার করে মহাশূন্যে বা অন্য কোনও গ্রহ বা উপগ্রহে নির্দিষ্ট গন্তব্যে অবস্থান করা সম্ভব বলে মত বিজ্ঞানীদের। মহাশূন্যে হারানো জিনিস ফিরে পেতেও সেগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে, ঠিক যেমনটি ঘটেছে ল্যান্ডার ‘বিক্রমে’র ক্ষেত্রে। চাঁদের বুকে অন্ধকার নেমে আসার পর আর ঘুম ভাঙানো যায়নি তার। অন্ধকার কোনও জায়গায় ঢুকে পড়াতেই সেটির খোঁজ মিলছিল না, অবস্থান জানা যাচ্ছিল না এতদিন।

পৃথিবীতে যেমন ২৪ ঘণ্টায় একদিন হয়, এক চন্দ্রদিবস বলতে পৃথিবীর হিসেবে ১৪ দিনকে বোঝায়। পৃথিবীর হিসেবে ধরলে, ১৪ দিন চাঁদের উপর সূর্যের আলো পড়ে, তখন হয় দিন। তার পরের ১৪ দিন আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখন হয় রাত। পৃথিবীর হিসেবে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এবং রোভার ‘প্রজ্ঞানে’ চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখার ১২ দিন পর চাঁদে রাত্রি নামে। গোড়াতে ১৪ দিনের মাথায় ঘুম পাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু সূর্যের অবস্থানের নিরিখে সময়ের আগে ঘুম পাড়ানো হয় তাদের।

রাত্রিকালে চাঁদের তাপমাত্রা অত্য়ন্ত কমে যায়। ওই ঠান্ডায় ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এবং রোভার ‘প্রজ্ঞানে’র পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই রাত্রি নামার আগেই, নিরাপদ জায়গায় ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয় ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এবং রোভার ‘প্রজ্ঞান’কে। ১৪ দিন ব্যাপী এই নিদ্রা থেকে উঠে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ এবং রোভার ‘প্রজ্ঞান’ ফের কাজে ফিরবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল গোড়া থেকেই। সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়।

(Feed Source: abplive.com)