দশহাজারি মনোজ! সাফল্য উৎসর্গ করছেন স্ত্রী সুস্মিতাকে, তবু কেন আক্ষেপ?

দশহাজারি মনোজ! সাফল্য উৎসর্গ করছেন স্ত্রী সুস্মিতাকে, তবু কেন আক্ষেপ?

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: দৃশ্যটা এখনও যেন ভুলতে পারছেন না মনোজ তিওয়ারি (Manoj Tiwary)। ঘরের মাঠ। ক্রিজে ততক্ষনে বেশ জমে গিয়েছেন বঙ্গ অধিনায়ক। রবি কিরণের বল বাইরে যাবে ভেবে ব্যাট তুলে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তাঁকে হতবাক করে বল কাট করে ঢুকে এল ভেতরে। অফস্টাম্পে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল। ১৯ রান করে বোল্ড হয়ে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল মনোজকে। অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল ঘরের মাঠে নজির স্পর্শ করার সুযোগ।

শুক্রবার গুয়াহাটির বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামে যে মাইলফলক স্পর্শ করলেন মনোজ (Bengal vs Assam)। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দশ হাজার রান পূর্ণ করলেন। বাংলার প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে। কীর্তি গড়ার পর এবিপি আনন্দকে মনোজ বললেন, ‘ইডেনে ছত্তীসগড়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে বলটা আচমকা এমন ভেতরে ঢুকে এল যে… না হলে দশ হাজার রান ঘরের মাঠেই হয়ে যেত। সেটাই ভীষণভাবে চেয়েছিলাম।’

ইডেনে ১০ হাজার থেকে ৪৮ রান দূরে আটকে গিয়েছিলেন মনোজ। বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামে যে লক্ষ্যপূরণ হল। অসমের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির (Ranji Trophy) ম্যাচের প্রথম দিনের শেষে ৬৮ রানে অপরাজিত মনোজ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ হাজার রান হয়ে গেল ডানহাতি ব্যাটারের।

কতটা স্পেশ্যাল অনুভূতি? মনোজ বলছেন, ‘খুবই স্পেশ্যাল। খুব কম ক্রিকেটারেরই এই নজির রয়েছে।’ তারপরই তাঁর গলায় আদর্শ টিমম্যানের ঝলক। বলে উঠলেন, ‘তবে এটা শুধু আমার কৃতিত্ব নয়। যারা আমার সঙ্গে ক্রিজে ব্যাট করেছে, পার্টনারশিপ গড়েছে, তাদের সকলের কৃতিত্ব। এটা সকলের দশ হাজার রান। শুধু মনোজ তিওয়ারির নয়। আমার সব ব্যাটিং পার্টনারদের ধন্যবাদ দেব।’

দশহাজারি মনোজের সাফল্যের ঝুলিতে ২৯টি সেঞ্চুরি। একটি ট্রিপল সেঞ্চুরি। সেরা ইনিংস কোনটা? মনোজ অবশ্য কোনও সেঞ্চুরি নয়, বেছে নিচ্ছেন এমন একটা ইনিংস, যেখানে তাঁকে থেমে যেতে হয়েছিল তিন অঙ্ক থেকে ৬ রান দূরে। হেরে গিয়েছিল বাংলাও। ২০০৬-০৭ মরশুমে, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ৯৪ রান করেছিলেন তিনি। বাংলা ম্যাচ হেরে গেলেও প্রশংসিত হয়েছিল মনোজের সেই ইনিংস। সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসেও আগ্রাসী ৪৩ রান করেছিলেন। সেই ইনিংসের কথাও বলছেন মনোজ। কেন সবচেয়ে প্রিয় ওই দুই ইনিংস? মনোজ বলছেন, ‘মুম্বইয়ের কী শক্তিশালী দল ছিল সেবার। সচিন তেন্ডুলকর থেকে শুরু করে রোহিত শর্মা, সকলে খেলেছিল। কী দুর্দান্ত বোলিং লাইন আপ। জাহির খান। অজিত আগরকর। রমেশ পওয়ার। ওদের বিরুদ্ধে রান করতে পারার আলাদা আনন্দ আছে।’

মুম্বই হোক বা কর্নাটক, তামিলনাড়ুর মতো ঘরোয়া ক্রিকেটের দৈত্যরা, বড় দল দেখলেই বারবার জ্বলে উঠেছেন মনোজ। বাড়তি তাগিদ পান বড় ম্যাচে? মনোজ হেসে বলছেন, ‘যখন খেলা শুরু করি, চারদিকে বলাবলি হতো, বাংলা থেকে কোনও ক্রিকেটার নেই। ওরা খেলতে পারে না। এগুলো ভীষণ ধাক্কা দিত। গায়ে জ্বালা ধরাত। তাই চেয়েছিলাম ব্যাট দিয়ে সব উপেক্ষার জবাব দেব। সেই থেকে প্রমাণ করার বাড়তি তাগিদ পেতাম বড় দল সামনে থাকলেই।’

আক্ষেপ রয়েছে ভারতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলতে না পারারও। দশ হাজার রান করেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাদা জার্সিতে লাল বলের ক্রিকেট খেলা হয়নি মনোজের। পারফর্ম করেও ব্রাত্য থেকেছেন। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে জাতীয় দলে খেললেও, পাননি পর্যাপ্ত সুযোগ।

দশ হাজার রানের সাফল্য কাকে উৎসর্গ করবেন? ‘আমার স্ত্রী সুস্মিতাকে,’ এক মুহূর্তও না ভেবে বললেন মনোজ। যোগ করলেন, ‘আমার জীবনে সুস্মিতা আসার পর অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। গত মরশুমে আমি অবসর ঘোষণা করে দিয়েছিলাম। তখনও ও-ই বলেছিল যে, মাঠ থেকে অবসর নেওয়া উচিত। ওর জন্যই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফিরি। অনেক খারাপ সময়ও গিয়েছে। পাশে থেকেছে সুস্মিতা, উৎসাহ দিয়েছে। অনেক আত্মত্যাগ করেছে আমার জন্য। বছরের পর বছর। এটা ভাষায় বলে বোঝানো যাবে না।’ মনোজ আরও বলছেন, ‘পাশাপাশি মানব স্যরের কথাও বলব (কোচ মানবেন্দ্র ঘোষ)। স্যর যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন, শিখিয়েছেন, আমার সাফল্যের নেপথ্যে স্যরের অবদানও ভোলার নয়।’

আগে এক সময় মন খারাপ থাকলে, হতাশ লাগলে ইউটিউবে প্রেরণামূলক ভিডিও দেখতেন। মনোজ বলছেন , ‘তবে সুস্মিতা জীবনে আসার পর থেকে ও-ই প্রেরণা দেয়। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুস্মিতা বুঝিয়েছে। ইডেনে আগের ম্যাচে আউট হয়েও হতাশ ছিলাম। স্ত্রী ইতিবাচক কথা বলেছিল। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ওর কথা শুনলে। বিয়ের পর থেকে জীবন বদলে গিয়েছে সম্পূর্ণ।’

অসমের বিরুদ্ধে টস হেরে শুরুতে ব্যাটিং করতে নেমে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল বাংলা। মাত্র ৫৭ রানে পড়ে গিয়েছিল ৪ উইকেট। সেখান থেকে অবিচ্ছেদ্য পঞ্চম উইকেটে ১৮৫ রানের পার্টনারশিপ অনুষ্টুপ মজুমদারের সঙ্গে। অনুষ্টুপ ১২০ রান করে ক্রিজে। মনোজ অপরাজিত ৬৮ রানে। দিনের শেষে বাংলার স্কোর ৭৮ ওভারে ২৪২/৪।

কোন মন্ত্রে পরিস্থিতি সামলালেন? মনোজ বলছেন, ‘ক্রিজে গিয়ে শুরুতে পরিবেশ বুঝতে চেষ্টা করি। রুকু (অনুষ্টুপের ডাকনাম) ততক্ষনে ২০-২৫ রান করে ফেলেছিল। জানতাম, উইকেটে থাকলে রান আসবে। সোজা সোজা ভি-এর মধ্যে খেলতে চেয়েছিলাম। রুকুও অভিজ্ঞ। মাঝে একবার রুকু সরে গিয়ে মারতে গিয়েছিল। বারণ করলাম। নতুন করে শুরু করি। বল দেখে খেলেছি। আলগা বলে শট খেলেছি। তাতেই সাফল্য।’

দশ হাজার সম্পূর্ণ করেও অধরা রঞ্জি জয়ের অভিযানে নতুন করে কোমর বাঁধছেন মনোজ।

(Feed Source: abplive.com)