বল হাতে যেন বুলেট! আকাশ দীপকে দলে নিতে জরুরি বৈঠক হয়েছিল সৌরভের সঙ্গে

বল হাতে যেন বুলেট! আকাশ দীপকে দলে নিতে জরুরি বৈঠক হয়েছিল সৌরভের সঙ্গে

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: দু’পা দৌড়ে কেউ এত জোরে বল করতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হতো না সৌরাশিস লাহিড়ীর! ইডেন গার্ডেন্সের (Eden Gardens) ইন্ডোরে প্রথম দিন দেখে তাঁর যেন মনে হয়েছিল, বল নয়, কেউ যেন বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছে।

আকাশ দীপ (Akash Deep Debut)। শুক্রবারের আগে পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে যাঁরা এই নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, বেলা গড়াতেই সেই নাম নিয়ে কৌতূহল। অনেকে হাতের স্মার্টফোনে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (India vs England Test Series) পোস্ট করা তিন উইকেটের ভিডিও দেখে চলেছেন। সেই সঙ্গে খোঁজখবর নিচ্ছেন, এ ছেলে এতদিন কোথায় ছিল!

কলকাতা ময়দানে অবশ্য কৌতূহল নেই, বরং রয়েছে বুকভরা গর্ব। আকাশের স্বপ্নের উড়ান যে সকলের চোখের সামনে ঘটে গেল।

ছিলেন টেনিস বলের তারকা। এমনই ছিল তাঁর চাহিদা যে, টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছেন। সেই আকাশ দীপ শুক্রবার রাঁচির ঝাড়খণ্ড ক্রিকেট সংস্থার স্টেডিয়ামে প্রথম স্পেলে এমন আগুন জ্বালালেন, যাতে পুড়ে ছারকার হল ইংরেজ শিবির। কাকতালীয় হলেও, আকাশের দীপ হয়ে ওঠা মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পাড়ায়। সেই ধোনি, যিনি এক সময় কর্মসূত্রে থাকতেন খড়্গপুরে। এবং খেলে বেড়াতেন টেনিস বলের টুর্নামেন্ট। সেখান থেকে ধোনির ভারতীয় ক্রিকেট দলের মসনদে বসা আর সাফল্যের কাহিনি রূপকথা হয়ে রয়েছে। আকাশের শুরুটাও টেনিস বলেই হয়েছিল। তারপর বাংলা রাজ্য দল হয়ে এখন ঠিকানা টিম ইন্ডিয়া। যে সফরে একজনের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

সৌরাশিস লাহিড়ী। ছাত্রের অভিষেক আর সাফল্যের দিনে যাঁর চোখের কোণ চিকচিক করছে। এবিপি আনন্দকে সৌরাশিস বলছিলেন, ‘আমি খেলা ছাড়ি ২০১৫-১৬ মরশুমে। ২০১৭ সালে বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দলের কোচ হই। দায়িত্ব নিয়ে খুব ছটফটানি, ইচ্ছেশক্তি কাজ করছিল। ভাল কিছু করতে হবে। মাঠে মাঠে গিয়ে প্লেয়ার খুঁজে আনব, যোগ্য ক্রিকেটারদের খেলাব, এমন পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলাম। বেঙ্গালুরুতে আমাদের একটা শিবির ছিল। জয়দীপদা (বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার জয়দীপ মুখোপাধ্যায়) প্রথম আমাকে বলে, প্যাটসি, আকাশ দীপ নামে একটা নতুন ছেলে ইউনাইটেড ক্লাবে খেলছে। শুনলাম খুব জোরে বল করে। ওকে দেখতে পারিস।’

নামটা তখনই গেঁথে গিয়েছিল বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার সৌরাশিসের মগজাস্ত্রে। বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় ফিরে আকাশকে ডেকে পাঠান সৌরাশিস। ইডেন গার্ডেন্সের ইন্ডোরে বল করতে বলেন। তারপর? ‘মরশুম তখন প্রায় শেষ। ছবিটা এখনও চোখের সামনে ভাসে। ইডেন গার্ডেন্সের ইন্ডোরে কালো টি শার্ট ও লাল রংয়ের হাফপ্যান্ট পরে এসেছিল আকাশ। দু’পা দৌড়ে গুলির মতো বল করছিল। এত গতি,’ বলছিলেন সৌরাশিস। যোগ করলেন, ‘অনূর্ধ্ব ১৬ বা অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট খেলেনি আকাশ। টেনিস বলে ক্রিকেট খেলত। টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতে দুবাইয়ে গিয়েছিল। ওর কাকা আসানসোলে থাকতেন। বিহারের সাসারামের ছেলে আকাশের বাংলায় আসা টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতেই। সেখান থেকেই হয়তো কারও কথায় ইউনাইটেড ক্লাবে যোগ দেয়।’

পরের বছর বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দল নির্বাচনের আগে ট্রায়ালের জন্য আকাশকে ডেকে পাঠান সৌরাশিস। কিন্তু তরুণ পেসারের কোমরে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার। বল করবেন কী, নড়াচড়াই করতে পারছেন না ঠিকঠাক! সৌরাশিসের কথায়, ‘আকাশ এসে বলে, ওর কোমরে চোট রয়েছে। ঝুঁকতে, নীচু হতে পারছে না। আমি মনে মনে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, এই ছেলে আমাকে বৈতরণী পার করাবে। কিন্তু চোটের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যাই। কল্যাণীতে ট্রায়াল ক্যাম্পে নির্বাচকেরা ওকে বল করাতে চান। কিন্তু আমি ওর কোমরের চোটের কথা বলি। জানাই যে, ও দলে থাকুক। পরে ফিট হয়ে গিয়ে খেলবে। সেদিন কল্যাণীর ট্রায়াল ক্যাম্প থেকে আমি ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়ে এসেছিলাম। কলকাতায় কিছু কাজ ছিল। গাড়িতে আসতে আসতেই ওর ফোন পাই। বলে, স্যর আমাকে নির্বাচকেরা বল করিয়েছেন। আমার ব্যথা খুব বেড়ে গিয়েছে। আমি বলি, সর্বনাশ। কিন্তু ট্রায়ালে তো বল করে দেখে নেওয়াই দস্তুর। ওকে কলকাতায় আসতে বলি। আমাদের ফিজিও শুভেনকে রিপোর্ট দেখাই। ও দেখে বলে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার প্যাটসিদা। সময় লাগবে। তবে সেরে যাবে।’

জহুরির চোখ জহর চিনতে ভুল করেনি। চোট থাকলেও আকাশকে দলে রাখতে চেয়েছিলেন সৌরাশিস। কিন্তু নির্বাচকেরা রাজি ছিলেন না। সৌরাশিস বলছেন, ‘সেটাই স্বাভাবিক। একটা চোট পাওয়া প্লেয়ার, যে শুরুর দিকে খেলতেও পারবে না, তাকে কেনই বা দলে রাখবে। সেটা আমার প্রথম বছর কোচ হিসাবে। স্নায়ুর চাপে ছিলাম আমিও। তখন আমি সোজা দাদির (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) কাছে হাজির হই। জানাই গোটা ঘটনাটা। বলি, একটা ছেলে আছে, আকাশ দীপ নাম। বহুত জোরে বল করে। চোট আছে। তবে ফিট হয়ে যাবে। ভাল করবে ছেলেটা। তুমি যদি একটু দলে রাখার কথা বলো। দাদি জিজ্ঞেস করে, তুই আত্মবিশ্বাসী তো? আমি বলি, দাদি, তুমি দেখে নিও। এই ছেলে অনেক দূর যাবে। তফাত গড়ে দেবে। দাদি বলে, তুই তোর মতো করে রেডি কর। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি। দাদির ওই উপকার কোনওদিনও ভুলব না।’

তারপর আকাশ বেঙ্গালুরুতে যান বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দলের সঙ্গে। ওখানেই শুরু হয় রিহ্যাব। বেঙ্গালুরু থেকে ফিরে দিন পনেরো কলকাতায়। তারপর বিশাখাপত্তনমে খেলা। সৌরাশিস বলছেন, ‘তখন বাংলার বোলিং কোচ ছিল রণদেব বসু। রণদেবও খুব সাহায্য করে। যদিও আকাশকে কবে খেলানো হবে, জানতে চেয়ে ফোন আসছিল বারবার। দলে রাখা হয়েছে অথচ ম্যাচ খেলছে না, সেটা মোটও প্রত্যাশিত নয়। অবশেষে ও নেটে বোলিং শুরু করে। তারপর মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে। সেই ম্যাচে পাঁচ উইকেট আর ৫০ রান করে। সি কে নাইডু টুর্নামেন্টে ওর ডাক পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। ২০১৮ সালে সি কে নাইডু ট্রফিতে খেলে আকাশ।’

বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দলে শুরুতেই নজরকাড়া পারফরম্যান্স। সৌরাশিস বলছেন, ‘আমাদের ফাইনালে নিয়ে যায়। একা নিজের দমে জেতায়। সেবারই বাংলার সিনিয়র দলে ডাক পায় আকাশ। সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফির শেষ দিকে বাংলার তখনকার কোচ অরুণ লাল জানতে চান, কেমন বুঝছিস ছেলেটাকে? আমি জোর দিয়ে বলি, লালজি, খেলিয়ে দিন। এ ছেলে হতাশ করবে না। ইনদওরে মুস্তাক আলি ট্রফির শেষ দুই ম্যাচ খেলে। ৪টি উইকেট নেয়। সেই থেকেই সিনিয়র বাংলা দলে জায়গা পাকা করে নেয়। পরের বছর ইডেনে গুজরাতের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক। সেই ম্যাচে ৬ উইকেট। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

মাঝখানে অবশ্য আকাশে দুর্যোগের কালো মেঘও ঘনিয়েছে। বাবা ও দাদাকে হারিয়েছেন আকাশ। বাড়িতে মা কার্যত একা। সঙ্গে বৌদি ও ছোট দুই ভাইঝি। সম্পত্তি, জমি-জায়গা নিয়ে বিবাদ। পারিবারিক সমস্যায় জেরবার। তাতেও ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ধাক্কা খায়নি। যে সংকল্প দেখে আপ্লুত সৌরাশিস। বিহারের সাসারাম থেকে কলকাতায় এসে ইডেনে সিএবি-র ডর্মেটরিতে থাকতেন। এখনও সেটাই ঠিকানা আকাশের। আইপিএলে আকাশ খেলেন বিরাট কোহলিদের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরে। ‘আমি বলেছি, এবারের আইপিএল খেলে এসে আগে বাড়ির ব্যবস্থা কর,’ হাসতে হাসতে বলছিলেন সৌরাশিস। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতীয় দল থেকে টেস্ট অভিষেকের জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছিল আকাশকে। সৌরাশিসকেও সেটা জানিয়েছিলেন আকাশ।

মুকেশ কুমারের পর আর এক ছাত্রকে জাতীয় দলে সুযোগ পেতে দেখার অনুভূতি কীরকম? সৌরাশিস বললেন, ‘আমরা তিরুঅনন্তপুরমে রঞ্জি ম্যাচ খেলছিলাম। কেরলের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচ খেলে ফিরছিলাম। আমিই প্রথম খবর পাই যে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয় টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছে আকাশ। আমরা তিরুঅনন্তপুরম থেকে কলকাতায় এলাম। ও রাজকোটে চলে গেল। এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে, বলার নয়। আমার স্ত্রী প্যারিস থেকে একটা ব্রেসলেট কিনে দিয়েছিল। সেটাই ওকে দিয়েছিলাম। তিরুঅনন্তপুরমে থাকাকালীনই ওর মায়ের সঙ্গে ফোনে প্রথম কথা বলায়। ভীষণ সরল মানুষ।’

ছাত্রের কোন গুনটা সবচেয়ে ভাল লাগে? সৌরাশিস বলছেন, ‘দারুণ ছেলে। ওর সঙ্গে সময় কাটাতেও ভাল লাগে। খুব দ্রুত শিখে নেয়। বিপদে আপদে, সব সময় একে অপরের পাশে থাকি।’ যোগ করলেন, ‘ইনস্যুইঙ্গার ওর সহজাত। বল পড়ে সোজা হয়ে যাওয়াটা ওর এমনিই হয়। পরে শিখেছে আউটস্যুইংও। কোন বলটা ভিতরে আনতে হয়, কোনটা বাইরে নিয়ে যেতে হয়, এখন আয়ত্ত করে ফেলেছে। নিজের বোলিং, রান আপ, রিলিজ নিয়ে পরিশ্রম করেছে। মহম্মদ শামির ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখেছি। শামি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভাল বোলার ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর অন্য পর্যায়ে নিয়ে চলে গিয়েছে নিজেকে। মুকেশও এখন অনেক পরিণত। আকাশের ক্ষেত্রেও সেটাই হবে। ওই পর্যায়ে থাকলে ক্রিকেট দর্শনটাই পাল্টে যায়।’

(Feed Source: abplive.com)