তীব্র অর্থ সঙ্কটেও হার না মানা লড়াই, সাহস আর ধৈর্য্যের হাত ধরে WBCS অফিসার সুজয়

তীব্র অর্থ সঙ্কটেও হার না মানা লড়াই, সাহস আর ধৈর্য্যের হাত ধরে WBCS অফিসার সুজয়

কলকাতা: মেধা ছিল মূল হাতিয়ার। কিন্তু মাধ্যমিক স্তর থেকে একাধিকবার বাধা এসেছে সামনে। তবে ভয় নয়, বরং সাহস আর ধৈর্য্যকে সঙ্গী করে সেই সব বাধা পেরিয়ে গিয়েছেন তিনি। ভয় জয় করেই একাধিক সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উতরে গিয়েছেন সহজে। কেমন ছিল পথটা? বাধা অতিক্রম করার মন্ত্রই বা কী? এবিপি লাইভে চড়াই-উতরাইয়ের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন WBCS অফিসার সুজয় ভট্টাচার্য। যিনি বর্তমানে অর্থ দফতরের অধীনে ডিরেক্টরেট অব রেজিস্ট্রেশন অ্য়ান্ড স্ট্যাম্প রেভিনিউ বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব রেভিনিউ হিসেবে কর্মরত। 

স্কুল স্তর থেকেই মেধাবী ছাত্র সুজয়। পড়াশোনায় ভাল হওয়ার কারণে প্রিয় ছিলেন শিক্ষকদের কাছেও। কিন্তু, মাধ্যমিকের আগেই তীব্র অর্থকষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সেই শুরু। সংসারের অনটনের মধ্যেই চালিয়ে গিয়েছেন পড়াশোনা। খরচ চালাতে গৃহ-শিক্ষকতা থেকে জ্যোতিষচর্চাও করেছেন। শেষমেশ সব বাধা অতিক্রম করে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। সুজয় জানাচ্ছেন, “নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বড় হয়েছি। আমার বাবা বেসরকারি সংস্থার কর্মী ছিলেন। ২০০৮ সালে বাবার চাকরি চলে যায়। সেই সময় আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সদ্য টেস্ট পরীক্ষা হয়েছে তখন। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ঠিকঠাকভাবে দিন কাটানোর টাকাও ছিল না।’’

কেন এই পেশা বেছে নেওয়া ?

বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সুজয়। কিন্তু কোনওদিন কোনও বাড়তি চাপ ছিল না। কী হতে চান তা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল বরাবরই। স্কুলের পড়ার সময়ই প্রথম WBCS সম্পর্কে জানা। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রাথমিকভাবে কলেজ স্তরে এই পরীক্ষার এবং তার বিষয়ের সঙ্গে পরিচয়। সুজয় বলেন, “ক্লাস সেভেনে একজন শিক্ষকের কাছে পড়তাম। তিনিই প্রথম WBCS –এর কথা আমাকে বলেছিলেন। আমার পরিবারের কেউ কোনওদিন কলেজে যায়নি। সেখান থেকেই এই পরীক্ষা দেব এমন ইচ্ছে হয়। পড়াশোনা বরাবরই ভালবাসাটা ছিল। একাদশে সায়েন্স ছিল। তারপর মৌলানা আজাদ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি। যেভাবে বড় হয়েছি, তাতে বাবা মায়ের আলাদা করে কোনও প্রত্যাশা ছিল না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন কোনও চাপও ছিল না আমার। কারণ সরকারি কলেজে পড়ার জন্য র‌্যাঙ্ক থাকতে হবে উপরের দিকে। তা না হলে বেসরকারি কলেজে পড়ার মতো আর্থিক পরিস্থিতি আমার ছিল না। মৌলানা আজাদ কলেজে WBCS-এর প্রস্তুতির জন্য বিশেষ ক্লাস করানো হত বিনামূল্যে। তিন মাসের জন্য সেই ক্লাস করার সুযোগ পাই। কলেজের পর ল্যাব তারপর WBCS-এর বিশেষ ক্লাস করতাম। যেসব জায়গায় ঘাটতি ছিল, সেগুলো ওই ক্লাস থেকে বুঝতে পারি। সেই সময় ওই ক্লাসেই এক শিক্ষক বলেছিলেন CGL পরীক্ষা দিতে। আমার নিজস্ব কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। এমনকী পরিবারেও কেউ কোনওদিন সরকারি চাকরি করেনি। ফলে শিক্ষকের কথাই আমার কাছে বেদ বাক্য ছিল।’’

কঠিন পথ অতিক্রম: আর্থিক প্রতিকূলতা ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই মাধ্যমিকের পর থেকে শুরু হয় গৃহশিক্ষকতা। তাতে একদিকে সংসার খরচ যেমন হয়ে যেত, তেমনভাবেই বিভিন্ন স্তরের পড়াশোনার সঙ্গেও যোগ থাকত। কলেজ স্তর পেরোতেই শুরু হয় সরকারি চাকরির প্রস্তুতি। সুজয় বলেন, “২০১০ সাল থেকে বাড়িতে পড়াতাম। এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেটা করানো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। মাধ্যমিকের সময় যে স্কুলে সিট পড়েছিল, সেখানে যাতায়াতের জন্য টাকা দিয়েছিলেন আমার বন্ধুর বাবা। প্রায় চার বছরে প্রচুর ছাত্রছাত্রী হয়ে গিয়েছিল। গ্র্যাজুয়েশনের পরই শুরু করলাম CGL-এর প্রস্তুতি। মূলত খুঁটিয়ে বই পড়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পাশাপাশি, সরকারি চাকরির পরীক্ষার যে পত্রিকা রয়েছে তা থেকে দেখতাম কোথায় কী শূন্যপদ রয়েছে। বিভিন্ন স্যাম্পল প্রশ্ন সমাধান করতে শুরু করলাম।’’

একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য: কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁতে দাঁতে চেপে লড়াই করার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। ২০১৪ সালে স্নাতক হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়া। একসঙ্গে একাধিক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ায়, কোনওটা না কোনওটায় উতরেও গিয়েছেন। সুজয়ের কথায়, “২০১৫ সালে প্রথম সরকারি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরিতে LTC-এর লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হই। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই চাকরিটা পাইনি। ২০১৬ সালে প্রথম WBCS পরীক্ষা দিই। ইন্টারভিউ পর্যন্ত গিয়েও সেই চাকরি পাইনি। এরপর ২০১৭ সালে ফের পরীক্ষা দিই। অন্যদিকে, হাইস্কুলে ক্লার্কের চাকরি পাই ওই বছরই। ২০১৮ আগরপাড়ায় একটা স্কুলে যোগ দিই। CGL-এর অন্যান্য যে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেগুলোতেও হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালে কৃষি প্রযুক্তি সহায়কের পরীক্ষায় প্রথম হই। সেটা ছিল ৬ নম্বর সরকারি চাকরি। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তখন তাতে যোগ দিই। এই পর্যায় প্রাইভেট টিউশন পড়ানো চলছিল। পাশাপাশি নিতাম WBCS-এর প্রস্তুতিও। মাঝে আরও দুটো সরকারি চাকরি পেলেও, WBCS ছিল মূল লক্ষ্য। পরীক্ষা দেওয়া, চাকরি করা এবং WBCS-এর প্রস্তুতির মাঝেই জ্যোতিষচর্চা শিখে নিই। বেশ কিছু দিন প্র্যাক্টিসও করি। এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য ছিল আর্থিক পরিস্থিতি আরও মজবুত করা।”

WBCS অফিসার হিসেবে যোগ: তবে WBCS-এর ক্ষেত্রে একবারে সাফল্য আসেনি। চতুর্থবারের চেষ্টায় জয়ের হাসি হেসেছেন তিনি। ভুল করেছেন, ভুল থেকে নিয়েছেন শিক্ষা। সুজয় জানাচ্ছেন, “২০২০ সালে পরীক্ষা দিয়েছিলাম প্রিলিমস। আমার অপশনাল ছিল এগ্রিকালচার। তাতে কিছুটা বাড়তি সুবিধা হয়। কারণ প্রতিবছর কেমিস্ট্রি নিয়ে কিছু লাভ হয়নি। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ এই তিন বছরই অপশনাল ছিল কেমিস্ট্রি। তাই চতুর্থবারে এগ্রিকালচার নিই। ৬ মাসে চুঁচুড়া ধান গবেষণাগারে ট্রেনিং নিই। সেই সময় কৃষি বিভাগের অনেক অফিসারের সহযোগিতা পেয়েছিলাম। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর যখন রেজাল্ট বেরোয় দেখতে পাই রেভিনিউ সার্ভিসে ৩ র‌্যাঙ্ক এসেছে। সবমিলিয়ে র‌্যাঙ্ক ছিল ২১। ৯ মাস ধরে এই বিভাগে কাজ করছি।”

সবসময় পাশে থেকেছেন যিনি: এই গোটা যাত্রাপথে বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছেন স্ত্রী। স্কুল জীবন থেকে পরিচয়, তারপর কলেজ পেরিয়ে চাকরি পর্যন্ত হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন তিনি। ভয়কে জয় করার সাহস জুগিয়েছেন তাঁর প্রিয় বন্ধু। সুজয় বলেন, “২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রিলিমিনারি। ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল আমার বিয়ে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। সঙ্গে বিয়ের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। তারই মধ্যে আবার চুঁচুড়া ধান গবেষণাগারে ট্রেনিং চলছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় সবটাই একা সামলাতে হয়েছে। সেই আবহেই পরীক্ষা প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা দিতে যাওয়া। এই গোটা জার্নিটাই আমি আমার স্ত্রীর প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। ২০১১ সাল থেকে আমাদের সম্পর্ক। বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে সবসময়।”

সাফল্যের মূল মন্ত্র কী?

একাধিকবার পড়ে গিয়েও লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন অবিরাম। নানা প্রতিকূলতা থাকলেও, তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি সেই সব। তাই বড় লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। সুজয়ের কথায়,

    • প্রতিভা একটু কম থাকলেও চলবে, কিন্তু সাহস আর ধৈর্য্যের এই দুটোর মধ্যে একটাও যদি কম থাকে তাহলে WBCS কেন যে কোনও সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে।
    • WBCS- লক্ষ্য নিলে ছোট-বড় যে কোনও পরীক্ষাই কভার হয়ে যাবে।
    • কখনও ছোট টার্গেট নিয়ে না এগোনই ভাল। লক্ষ্য থাকুক বড়। তাতে দেখা যাবে কোনও না কোনও একটা চাকরি ঠিক হয়ে গিয়েছে।
    • WBCS টার্গেট হলে, গ্রুপ C বা D নয়, টার্গেট হোক A বা B। এই দুটো পোস্ট থেকে IAS বা IPS প্রোমোশনের সম্ভাবনা থাকে।
    • অপশনাল মানে ওই বিষয় না পড়লেও চলবে। কিন্তু আসল অর্থ হল ৩৭টা বিষয়ের মধ্যে সবথেকে পারদর্শী যে বিষয়ে তাতে নিজের মুন্সিয়ানা দেখানো সম্ভব। তাই প্রথম থেকেই অপশনালের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই বিষয় নিয়ে একদম অবহেলা করা যাবে না।
    • মেনসের জন্য প্রস্তুতি প্রথম দিন থেকে করতে হবে। একদম প্রিলিমসের শুরুর দিন থেকেই লক্ষ্য থাকতে হবে মেনস পাওয়ার জন্যই পড়াশোনা করছি। তাতে কখনও মুখ থুবড়ে পড়তে হবে না।
    • বই খুঁটিয়ে পড়তে হবে। তারপর তা থেকে নোটস করা যেতে পারে। কিন্তু বইকে অবহেলা করা যাবে না।

(Feed Source: abplive.com)