নিজেকেই বিয়ে করবেন গুজরাতের যুবতী, আইনত স্ব-বিবাহ বলে কি আদতে কিছু হয়? জানুন

নিজেকেই বিয়ে করবেন গুজরাতের যুবতী, আইনত স্ব-বিবাহ বলে কি আদতে কিছু হয়? জানুন

#নয়াদিল্লি: থাকবে আলোর রোশনাই। বাজবে সানাই। সেজে উঠবে ছাদনাতলা। থাকবেন পুরোহিতও। হাজির হবেন অতিথিরা। ছাদনাতলা আলো করে থাকবেন আভরণভূষিতা কনে। অথচ থাকবেন না কোনও বর! কিন্তু বর না-থাকলে বিয়ে হবে কী করে? আসল ট্যুইস্ট তো এখানেই! ছাদনাতলায় নিজেকেই বিয়ে করবেন কনে! না, এটা কোনও ছবির মজার দৃশ্য নয়। এই দৃশ্যই আগামী ১১ জুন দেখতে পাবেন গোটা ভারতবাসী! কারণ ওই দিন সম্পূর্ণ হিন্দু রীতিনীতি মেনে ছাদনাতলায় নিজেকেই বিয়ে করবেন গুজরাতের ভাদোদরার বাসিন্দা বছর চব্বিশের যুবতী ক্ষমা বিন্দু (Kshama Bindu)। আর স্ববিবাহের মতো একটা বিষয় বোধহয় এই প্রথম বার চাক্ষুষ করতে চলেছে গোটা দেশ। তবে বিশ্বে এটা প্রথম নয়, এর আগেও এমন বিয়ের বহু নজির রয়েছে।

কিন্তু আচমকা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন ওই তরুণী?

ক্ষমার বক্তব্য, বাঁধাধরা নিয়ম বা স্টিরিওটাইপ ভাবনাচিন্তা ভাঙার জন্যই এই পদক্ষেপ করতে চান। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা প্রকৃত ভালবাসা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন অথবা ভেঙে পড়েছেন, তাঁদেরকে অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্যও এই পথ বেছে নিয়েছেন ক্ষমা। আসলে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা বারবার প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছেন অথবা একাধিক বার বিবাহবিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। তাঁদেরও তো ভালো থাকার অধিকার রয়েছে! সেই সব মানুষ যাতে নিজেদের সব সময় ভালোবেসে জীবন কাটাতে পারেন, সেই বিষয়েও অনুপ্রেরণা জোগাতে চান ক্ষমা। নিজেকে উভকামী বলে দাবি করে ওই তরুণী আরও জানিয়েছেন, অতীতে তাঁর জীবনেও প্রেম এসেছিল। তিনি এক পুরুষ এবং এক মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু এবার সমস্ত ভালোবাসাটুকু নিজের জন্যই উজাড় করে দিতে চান তিনি। ক্ষমার দাবি, তাঁর এই বিয়েই ভারতের প্রথম স্ববিবাহের নজির গড়তে চলেছে।

সংবাদমাধ্যমের কাছে ক্ষমা বলেন, “আমি আসলে বুঝতে পেরে গিয়েছি যে, আমার জীবনে কোনও সুদর্শন রাজপুত্রের প্রয়োজন নেই। কারণ আমি নিজেই নিজের জীবনের রানি। আর এই কারণেই আমি আগামী ১১ জুন নিজেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার বন্ধুরাও এই বিয়েতে যোগ দেবে। আমি একদম কনের বেশে সমস্ত রীতিনীতি মেনেই বিয়েটা করতে চলেছি। শুধু বিয়ের শেষে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে নিজের বাড়িতেই ফিরে যাব।”

কিন্তু কী বলছে ক্ষমার পরিবার?

এই প্রসঙ্গে ক্ষমা জানিয়েছেন, তাঁর মা অন্য শহরে বসবাস করেন। আর তিনি তাঁর মেয়ের এই ‘প্রথা ভাঙা বর-হীন’ বিয়েতে অনুমতিও দিয়েছেন। ক্ষমার কথায়, “আমি ইতিমধ্যেই এক জন পুরোহিতকে বিয়ের দায়িত্ব দিয়েছি। আমি লক্ষ্য করেছি, পশ্চিমি দেশগুলির মতো ভারতে ততটা প্রচলিত নয় স্ব-বিবাহ। তাই আমি এই নতুন ধারা বা ট্রেন্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাতে অন্যরাও আমায় দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। অবশ্য আশে-পাশের লোকজনের হয় তো আমার এই সিদ্ধান্ত পছন্দ হবে না। কিন্তু আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। আর আমি জানি, আমি ঠিকই করছি।”
ক্ষমার স্ব-বিবাহের এই খবর চাউর হতেই স্বাভাবিক ভাবেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে সব জায়গায়। কেউ কেউ প্রশংসা করলেও অনেকেই এটা নিয়ে মুখ বেঁকাচ্ছেন। কারও বা বক্তব্য, এ-সবই পাবলিসিটি স্টান্ট। অর্থাৎ খ্যাতির লোভেই এই সব করছেন ওই তরুণী। যদিও এসব কথায় কান দিতে নারাজ ওই যুবতী। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। এই প্রসঙ্গে ক্ষমার বক্তব্য, “আমি ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে কাজ করে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছি।”
প্রেম অথবা সম্পর্কের ভাঙার মতো বিষয় অনেকের জীবনেই গভীর ছাপ রেখে যায়। আর আজকাল তো কান পাতলেই শুধু প্রেম ভাঙা অথবা বিচ্ছেদের কথাই শোনা যায়। সেখানে গুজরাতের ওই যুবতীর এই স্ববিবাহের সিদ্ধান্তকে কুর্নিশ জানাচ্ছে অনেকেই। আবার কারওর কারওর মনে এই নিয়ে সুপ্ত ইচ্ছে থাকলেও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেননি। ক্ষমার এই স্ব-বিবাহের দৃষ্টান্তের পর হয় তো অনেকেই এই পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাবেন। আসলে বেশিরভাগ মানুষই এই স্ব-বিবাহের ট্রেন্ডের বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য জানেনই না। আবার অনেকের মনেই প্রশ্ন ওঠে স্ব-বিবাহ সংক্রান্ত নিয়মকানুন নিয়ে। কারণ এতে যেহেতু নিজেকেই বিয়ে করেন পাত্র অথবা পাত্রী, তাই সেক্ষেত্রে আইন কী বলে। কিংবা এর পিছনে কোনও আইনি জটিলতা থাকবে কি না, সেই বিষয়টাও এখনও অজ্ঞাতই রয়েছে তাঁদের কাছে। তাই জেনে নেওয়া যাক, স্ব-বিবাহের সমস্ত নিয়মকানুন নিয়ে।

স্ব-বিবাহ বা সোলোগ্যামি (Sologamy) কী?

কোনও পুরুষ অথবা মহিলা পরিবার-পরিজন-বন্ধুবান্ধব নিয়ে যখন অনুষ্ঠান করে নিজের সঙ্গেই বিয়ে করেন, তখন সেটাই হল স্ব-বিবাহ বা সোলোগ্যামি। এই প্রথা আবার অটোগ্যামি নামেও পরিচিত। যদিও এই ধরনের বিবাহের ক্ষেত্রে কোনও রকম আইনি অনুমোদন থাকে না। এই প্রতীকী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আসলে উদযাপন করা হয় নিজেকে। আর স্বীকৃতি দেওয়া হয় নিজের প্রতি নিজের ভালবাসাকে কিংবা নিজের স্বাধীনতাকেই।

কবে এই স্ব-বিবাহের প্রথা শুরু হয়েছিল?

আমেরিকার এক মহিলার হাত ধরে এই প্রথা সামনে এসেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা পেশায় ডেন্টাল হাইজিনিস্ট লিন্ডা বেকার ১৯৯৩ সালে প্রথম নিজেকে বিয়ে করেছিলেন। আর এই ঘটনাকেই বিশ্বের প্রথম স্ব-বিবাহের ঘটনা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। লিন্ডার সেই চমকপ্রদ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর ৭৫ জন বন্ধুবান্ধব।
আবার স্ব-বিবাহ বিচ্ছেদের কথাও গত বছর প্রকাশ্যে এসেছিল। সেই সময় ৩৩ বছর বয়সী ব্রাজিলীয় মডেল ক্রিস গালেরা জানিয়েছিলেন, স্ব-বিবাহের নব্বই দিনের মাথায় তিনি বিচ্ছেদ করতে চলেছেন। কারণ তিনি অন্য এক জনের প্রেমে পড়েছিলেন।

স্ব-বিবাহের ক্ষেত্রে রীতিনীতি কেমন হয়?

এই ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনও সামাজিক রীতি-নীতি থাকে না। এটা প্রচলিত বিয়ের রীতির মতোও হতে পারে, আবার তা না-ও হতে পারে। আর এখন এই ট্রেন্ড বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ফলে গোটা বিশ্বেই এই স্ব-বিবাহের অনুষ্ঠান সামলানোর পরিষেবাও দেওয়া হয়। যেমন – কানাডায় রয়েছে ম্যারি ইওরসেলফ (Marry Yourself)। যেখানে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এবং কনসাল্টেশনেরও সুবিধা মেলে। আবার সান ফ্রান্সিসকোর আইম্যারেডমি.কম (IMarriedMe.com) গ্রাহকদের স্ব-বিবাহ সংক্রান্ত প্যাকেজের সুবিধা দেয়। আবার কিয়োটোর সের্কা ট্রাভেল (Cerca Travel)-ও দুদিনের স্ব-বিবাহের প্যাকেজের সুবিধা প্রদান করে।
এবার গুজরাতের ওই তরুণী কেমন রীতি মেনে বিয়ে করেছেন, সেটাও তিনি জানিয়েছেন। ক্ষমার বক্তব্য, তাঁর স্ব-বিবাহের অনুষ্ঠানে তিনি সব রীতিনীতি পালন করবেন। সাতপাক ঘোরা থেকে শুরু করে সিঁদুর দান পর্যন্ত এই সব কিছুই করবেন ওই তরুণী।

সারা বিশ্বেই কেন এই ট্রেন্ডের জনপ্রিয়তা?

ম্যারি ইওরসেলফ ভ্যাঙ্কুভারের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেকজান্দ্রা গিল (Alexandra Gill) সংবাদমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, আজকালকার দিনে নিজেদের জীবন চালানোর মতো সামর্থ্য রয়েছে মহিলাদের। তাঁরা কেরিয়ার গড়ছে, নিজেদের বাড়ি কিনছে, নিজেদের মতো করে জীবন কাটাচ্ছে। এমনকী সন্তান নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্তও তারা নিচ্ছে। অথচ আমাদের মা-ঠাকুরমাদের কাছে কিন্তু এই সুযোগগুলো ছিল না। আর স্ব-বিবাহের অর্থ হল নিজের সঙ্গে বিয়ে করা। তবে সেখানেও সমাজ তাদের মাথায় দুঃখী, একাকী- এই ধরনের তকমা লাগিয়ে দেয়। আসলে এই সময়ের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে করে নেওয়া উচিত, এই ধরনের কথা শুনতে শুনতেও মহিলারা ক্লান্ত।
আবার লেখিকা সাশা কেগেন (Sasha Cagen) নিজের কোয়ার্কিঅ্যালোন (Quirkyalone) বইয়ে লিখেছেন, “স্ব-বিবাহের ক্ষেত্রে একটা বিষয় বা ধারণা সবথেকে বেশি শোনা যায়। আসলে প্রচলিত বিয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে একজন আর এক জনের খেয়াল রাখে, ঠিক সেভাবেই স্ব-বিবাহের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে আর নিজেকেই ভালোবাসতে হবে। এটাই প্রচলিত ধারণা। আর মহিলারা এই পথ বেছে নিচ্ছেন, তার আরও একটা কারণ আছে। আসলে অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে সম্পর্কে জড়ালে মহিলাদের নিজের জীবনের চাহিদা অনেক সময় ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু স্ব-বিবাহের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সমস্যা থাকে না। তাই বলা হয়, অন্য কাউকে বিয়ে করার আগে সবার প্রথমে নিজেকে বিয়ে করা উচিত।”

স্ব-বিবাহের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক অবস্থান কী?

বেশ কিছু জনপ্রিয় টেলিভিশন শো-এ স্ব-বিবাহের নজির তুলে ধরা হয়েছে। এই সব বিখ্যাত টিভি শোয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি (Sex and the City), গ্লি অ্যান্ড ডক্টর হু (Glee and Doctor Who)। সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটির ২০০৩ সালের এক পর্বে দেখানো হয়েছিল, ওই শোয়ের চরিত্র ক্যারি ব্র্যাডশ (Carrie Bradshaw) নিজেকেই বিয়ে করছেন। আবার পরে মার্কিন সংবাদপত্রের একটি রিপোর্টে এই কাল্পনিক চরিত্রটিকে স্ব-বিবাহের গডমাদার বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

(Source: news18.com)