ঢাকা: সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছে। সেই আবহে সব ধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস। জানালেন, এত বড় দেশে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা জানা প্রয়োজন, যাতে সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধান করা যায়। যে পক্ষেরই হোক না কেন, দোষীকে বিচারের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব বলেও বার্তা দিলেন ইউনূস। (Muhammad Yunus)
বৃহস্পতিবারও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার একের পর এক ঘটনা সামনে এসেছে। সুনামগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ। দোয়ারাবাজার থানা এলাকায় মঙ্গলারগাঁও গ্রামে হিন্দুরা আক্রান্ত হন বলে খবর আসে। শতাধিক বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি, সুনামগঞ্জের একটি লোকনাথ মন্দিরেও ভাঙচুর চালানো হয় বলেও অভিযোগ সামনে আসে। পাশাপাশি, জানা যায়, পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলাতেও একাধিক মন্দির ভাঙচুর করে মৌলবাদীরা। অন্য দিকে, হিন্দুদের ওপর লাগাতার আক্রমণের প্রতিবাদ করায়,মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুশলবরণ চক্রবর্তী। গোপালগঞ্জের গহরডাঙায় কট্টরপন্থী ইসলামিরা মহিলাদের বাজারে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। (Bangladeshi Hindus)
সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর পর পর হামলার এই অভিযোগের মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকেলে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউনূস। সেখানে তিনি বলেন, “আজ খোলাখুলি আলোচনা করতে এসেছি আমরা। কী ভাবে তথ্য পাব, দোষীকে ধরব, সেই নিয়ে আলোচনা। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, নতুন বাংলাদেশ, এটা করতেই হবে। মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। সেগুলির উত্তর খুঁজে পেতেই আপনাদের সঙ্গে বসা। শুনলাম, এখনও সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হচ্ছে। সকলের সঙ্গে বসলাম যে কী করে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।” (Bangladesh Situation)
সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলনে দেশ যখন উত্তপ্ত, হাসিনা যখন দেশ ছেড়েছেন, সেই সময় বাংলাদেশে ফিরে শান্তি ও সৌহার্দ্যের বার্তা দিয়েছিলেন ইউনূস। আজকের বৈঠকে সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই সরকার যখন গঠন হয়, বিমানবন্দরেই সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, আন্তরিক ভাবেই বলেছিলাম, আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানা মত, নানা ধর্ম, নানা রীতিনীতি থাকবে। কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য বলে জোর দিয়েছিলাম। শত পার্থক্য থাকলেও আমরা পরস্পরের শত্রু নয়। জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে আমরা এককাট্টা হই। আমরা বাংলাদেশি, আমরা এক পরিবারের সদস্য।”
সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, “যখন সরকার গঠন করলাম, শুনতে শুরু করলাম যে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর পরই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলাম, সেখানেও একই কথা বলেছি। আমরা একই পরিবারের সদস্য। অন্য সব দাবিদাওয়া বাদ দিলেও, একটা দাবি একেবারে পরিষ্কার, আমাদের সবার সমান অধিকার, বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার, কাজকর্মের অধিকার। সংবিধান থেকে এই অধিকার এসেছে, নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রাপ্য অধিকার, নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের দায়িত্ব আমাদের হাতে মানে আমাদের দায়িত্ব নাগরিকের কাছে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার পৌঁছে দেওয়া। তার পরও কথাটা উড়ে গেল না। শুনলান এখনও সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হচ্ছে। কী ভাবে উদ্ধার পাওয়া যা এটা থেকে, বসেছিলাম। দুর্গাপুজোর সময় সমস্যা হতে পারে অনুভব করে, বসলাম। সকলেই খুব উৎসাহ সহকারে দুর্গাপুজো করলেন। কয়েক হাজার দুর্গাপুজো হল। তাঁতিবাজারে ককটেল মেরেছিল, এমন একটিই খবর ছিল। তবু আনন্দিত হয়েছিলাম, নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। শুধু হিন্দুদের নয়, জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। মনে তৃপ্তি পেলাম যে একটু তো কাজ করেছি। এখন আবার নতুন কথা, যে হামলা হচ্ছে, অত্যাচার হচ্ছে।”
এর আগে, বাংলাদেশকে বদনাম করা হচ্ছে বলে ইউনূস সরকারের অনেকেই দাবি করছিলেন। এদিন ইউনূস যদিও বলেন, “বিদেশি প্রচার মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে এমন। খোঁজ নিচ্ছি, কেন হচ্ছে, কী হচ্ছে। এক দিক থেকে খবর এল হচ্ছে, অন্য দিক থেকে এল হচ্ছে না বলে। মাঝখানে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এটার অবসান হতে হবে। যে তথ্য পাচ্ছি, তা ভুল হতে পারে। তথ্যের উপর ভরসা করে, কিছু হয়নি বলে বসে থাকলে, অন্ধের মতো বসে থাকা হবে। ভিতরে গিয়ে দেখতে হবে, প্রকৃত ঘটনাটা কী? তথ্যের মধ্যে গরমিল কেন। ওরা যা বলছে, তা মিথ্যে, না আমরা যা বলছি তা মিথ্যে প্রচার! আমাদের লক্ষ্যের মধ্যে কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু তথ্যগুলো কী ভাবে পাব, তা দেখা দরকার। অনেক সময় সরকারি তথ্যের উপর ভরসা করা যায় না। কর্তা যা চায়, সেভাবেই বলে দেয়। আসলটা মন খুলে বলতে চায় না। কর্তা যদি নারাজ হয়! আমরা আসল খবর জানতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।”
দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে এদিন ইউনূস বলেন, “দু’দিনের গোলমালে চঞ্চল হয়ে কথা বলছি তা নয়। এত বড় দেশে কত রকমের ঘটনা ঘটে। হয়ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবে যেন তথ্য পাওয়া যায়। যেদিক থেকেই হোক, দোষী দোষীই। তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এটাই সরকারের দায়িত্ব। না হওয়ার পরিবেশ তৈরি প্রথম লক্ষ্য, হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা, এমনটাই হওয়া উচিত। আমরা এক পরিবারের মানুষ, সেই হিসেবে সামগ্রিক দায়িত্বটা যেন পালন করতে পারি।” ইউনূস এদিন জানান, এমন ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, যাতে গোলমাল করার আগে দু’বার ভাবে কেউ এবং অন্য কেউ উৎসাহিত না হয়।
(Feed Source: abplive.com)