‘অমিতাভ বচ্চনকে আউট করে দেওয়ায় বাবার সঙ্গে তিনদিন কথা বলিনি’

‘অমিতাভ বচ্চনকে আউট করে দেওয়ায় বাবার সঙ্গে তিনদিন কথা বলিনি’

কলকাতা: বিখ্যাত বাবার ছেলে। তার ওপর বাবা আবার রুপোলি পর্দার তারকা। স্বাভাবিকভাবে তাঁর কাছেও ছিল অভিনয় জগতে নাম লেখানোর একাধিক প্রস্তাব।

কিন্তু জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের (Joydeep Mukherjee) আবার অভিনয়ে আগ্রহ নেই। তাঁর মন পড়ে ময়দানে। মুশকিল আসান হয়ে হাজির হলেন বাবা দিলীপ মুখোপাধ্যায় (Dilip Mukherjee)। সব প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। ছেলেকে ডেকে বললেন, খেলার জগতেই থাক।

ফাদার্স ডে-তে (Father’s Day 2022) বাবার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিমেদুর জয়দীপ। এবিপি লাইভকে প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, ‘অনেক অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। আমার আগ্রহ ছিল না। বাবাও চাইতেন না। বলতেন, তুমি খেলার জগতের মানুষ। খেলা নিয়ে থাকো।’

বাড়িতে ছোট থেকে দেখেছেন তারকাদের আনাগোনা। কে নেই সেই তালিকায়? উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন। জয়দীপ বলছেন, ‘ওঁরা আমার বাবার ভীষণ ভাল বন্ধু ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাড়ির পাশেই থাকতেন। আমরা তখন থাকতাম ২৪ এ লেক প্লেসে। পরে বাবার মৃত্যুর পর সেই ভাড়াবাড়ি আমরা ছেড়ে দিই। সেই বাড়ি ছিল সৌমেন্দুবাবু ও সৌমিত্রকাকুর বাজার থেকে ফেরার রাস্তা। ওঁরা প্রায় রোজই আসতেন। হইহই করে কাটত সময়।’

গরমের ও শীতের ছুটিতে বাবার সঙ্গে শ্যুটিয়ে যেতেন জয়দীপ। ‘বাবার শ্যুটিংয়ের পর ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। আমি বরাবরই খেলাপাগল। শুধু অপেক্ষায় থাকতাম কখন শ্যুটিং শেষ হবে আর খেলতে পারব। বাবা খুব ভাল খেলতেন। শ্যুটিংয়ের পরে নিয়মিত খেলা হতো। উত্তম কাকু ভাল ক্রিকেট খেলতেন। সৌমিত্র কাকু ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন দুটোই ভাল খেলতেন। স্টুডিওর সামনে কোর্ট তৈরি করা হতো অক্টোবর মাসে,’ বলছিলেন জয়দীপ। যোগ করলেন, ‘বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় আড্ডা শুরু হতো। উত্তম কুমার, অপর্ণা সেন, বিকাশ রায়, পাহাড়ি সান্যাল বাড়িতে আসতেন। স্ক্রিপ্ট পড়া হতো। সঙ্গে থাকত লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। আমার ঠাকুমা রাঁধতেন। সকলের ভীষণ প্রিয় ছিল সেই খাবার।’

মহানায়কের কোলে বসে ছবি রয়েছে জয়দীপের। বলছেন, ‘উত্তম কুমার বাড়িতে এলে আমাদের বাড়ির সামনে ওঁর গাড়ির নম্বর দেখে ভিড় জমে যেত। তবে তখন ছবি তোলার চল ছিল না। সকলে কাছ থেকে দেখতেন। কথা বলে চলে যেতেন।’ যোগ করলেন, ‘তখন একটা সিনেমার শ্যুটিং দেড় বছর চলত। এখন তো আমার বন্ধু যিশু-জিৎরা বলে ৩৪ দিনে গোটা সিনেমার শ্যুট হয়ে যায়। তখন ভাবা যেত না। আমি ছুটি থাকলে শ্যুটিং দেখতে যেতাম। আমার একঘেঁয়ে লাগত। বাবার একটা সিনেমার গানের রেকর্ডিং করতে মান্না দে এসেছিলেন মনে আছে।’

বাবার সঙ্গে প্রচুর আউটডোর যেতেন জয়দীপ। ‘হাজারিবাগ, শিলং অনেক জায়গায় আউটডোরে গিয়েছি। যদি জানতেম, এখানে পিঞ্জর, নগর দর্পণে, এরকম অনেক সিনেমার শ্যুটিংয়ে আউটডোরে গিয়েছি। আউটডোরে গিয়েই সৌমিত্র কাকুর ছেলে বুবুদা ও মেয়ে পৌলমীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। পৌলমী আমার প্রথম বন্ধু। অভিনয় করত বাবারা। আমরা গল্প করতাম। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় যাতায়াতও হতো।’

বাংলা সিনেমার সোনালি অধ্যায়ের অন্যতম বড় নাম দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু ১৯৯০ সালের ৩১ মার্চ। জয়দীপ বলছেন, ‘তখন আমার মাত্র ২৩ বছর বয়স। বাংলা প্র্যাক্টিস থেকে ফিরে দেখি বাবাকে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। শুনলাম হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। চিকিৎসকেরা বললেন পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন দিতে হবে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরই কনভালসন ও মৃত্যু।’

জয়দীপের বাড়িতে এখনও বাবার স্মৃতিবিজরিত প্রচুর জিনিস রয়েছে। ‘বাবার পকেট ডায়েরি, দামি পেন, রূদ্রাক্ষের মালা, চেন, প্রচুর ছবি, সব রাখা রয়েছে,’ বলছিলেন জয়দীপ।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির সঙ্গে পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল মুখোপাধ্যায় পরিবারের। জয়দীপ বলছেন, ‘চণ্ডীকাকু আর বাবা বন্ধু ছিলেন। মহারাজ আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। আমি রাজের (স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়) বন্ধু ছিলাম আগে। হোয়াইট বর্ডার মাঠে গিয়ে বসে থাকতাম। সবাই বলত, আরে চণ্ডী গঙ্গোপাধ্যায় আর দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে ওরা, ক্রিকেট খেলতে পারে নাকি! পরে অবশ্য বাংলার হয়ে একসঙ্গে খেলেছি।’

পিতৃদিবসে জয়দীপের মনে পড়ছে আরেকটি ঘটনা। যখন বাবার ওপর ভয়ানক রাগ হয়েছিল। ‘১৯৭৮ সালের বন্যার পর ত্রাণ সংগ্রহের ম্যাচ হয়েছিল। বাংলা দলের প্লেয়িং ক্যাপ্টেন ছিলেন বাবা, নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন উত্তম কুমার। মুম্বইয়ের প্লেয়িং ক্যাপ্টেন অমিতাভ বচ্চন, নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন দিলীপ কুমার। আমি অমিতাভ বচ্চনের বিরাট ভক্ত ছিলাম। বাবা সেই ম্যাচে ১০-১২ রানের মাথায় অমিতাভ বচ্চনকে কট অ্যান্ড বোল্ড আউট করে দিয়েছিলেন। রাগে, অভিমানে আমি বাবার সঙ্গে দিন তিনেক কথা বলিনি। আমার প্রিয় তারকাকে এভাবে আউট করে দেবে!’ বলছিলেন জয়দীপ। যোগ করলেন, ‘অমিতাভ বচ্চনকে বাবা গিয়ে বলেছিলেন, ছেলে আপনার বড় ফ্যান। অমিতাভ বচ্চন একটা টিস্যু পেপারে ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন আমায়। বলেছিলেন, আমার বাড়িতে তোমার নিমন্ত্রণ রইল। এসো। তবে তোমার বাবার নিমন্ত্রণ নেই। ওকে নিয়ে যেও না। আমাকে আউট করেছে!’

ফাদার্স ডে-তে বাবার স্মৃতি জয়দীপের সেরা সম্বল।

(Source: abplive.com)