‘আত্মমুক্তির সাধনাই হল যোগ’, স্বামীজীর দেখানো পথে কীভাবে হাঁটবে সাধারণ মানুষ?

‘আত্মমুক্তির সাধনাই হল যোগ’, স্বামীজীর দেখানো পথে কীভাবে হাঁটবে সাধারণ মানুষ?

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ’বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’ । কী এই যোগ (Yoga) ? যোগ মানে কি শুধুই শরীরচর্চা ? নাকি ঋষি-মুনিদের ধ্যান তপস্যা ? নাকি একেবারেই অন্যকিছু?  এই প্রশ্নটি রয়েছে অনেকের মনেই। ভারতে হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র যে  যোগের কথা বলে তা কি শুধুই শরীরের কসরত ? এই প্রশ্ন নিয়ে এবিপি লাইভ পৌঁছে গিয়েছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাকেন্দ্র সারদাপীঠে।  সম্পাদক স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ ব্যাখ্যা করলেন, ভারতীয় শাস্ত্রে যোগ কী, কীভাবেই বা তা শুরু করতে পারেন সাধারণ মানুষ। চিত্তবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে এক-পা এক-পা করে এগনো যায় স্বামীজী (Swami Vivekananda) নির্দেশিত আত্মমুক্তির পথে। না, পথটা সোজা নয় ঠিকই। তবে একেবারে অগম্যও নয় !

স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ ব্যাখ্যা করলেন,  স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, ভারতের যোগ-সাধনার হল আসলে আত্মমুক্তির সাধনা। ভগবত গীতায় যোগ শব্দটির নানা ভাবে ব্যবহার হয়েছে। ১৮ টি অধ্যায়ে নানা ভাবে যোগ শব্দটি রয়েছে। যোগ এই শব্দের অর্থ হল যুক্ত হওয়া। শরীর-মনের বৃত্তিগুলিই মূলত আমাদের চালিত করে। অর্থাৎ  কর্ম ও তার থেকে আশা, প্রাপ্তির আনন্দ, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, সবের মূলেই এই চিত্তবৃত্তি। যার জেরেই তৈরি হয় পারস্পরিক সংঘাত। কিন্তু এই চাওয়া-পাওয়া থেকে ঊর্ধ্বে উঠে, নিজের চৈতন্যের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটানোই প্রকৃত যোগ। আর তা আয়ত্তে আনতে পারলেই ক্ষুদ্র-দুঃখ সব তুচ্ছ মনে হবে। দুঃখ বিয়োগ ও চৈতন্যের সঙ্গে সংযুক্তি হওয়াই যোগ। মনটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অভ্যেস করতে হবে। এই পথে সাধারণ মানুষ এগোবে কীভাবে ? স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দ বলছেন,

      • প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় মনকে স্থির করার চেষ্টা করতে হবে, কোনও সুচিন্তায় বা মূর্তিতে মনকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। একদিনে তো সম্ভব নয়। রোজ চেষ্টা করলে মনের বিক্ষিপ্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
      • এরপর মনের নেতিবাচক ভাব দূর করতে, পারিপার্শ্ব থেকে ইতিবাচক দিকটি গ্রহণ করতে হবে। যেমন,  আশেপাশে তো কতকিছু ভাল রয়েছে।  ভাল বই, ভাল মানুষের সঙ্গ, ভাল চিন্তা, সেই সব কিছুর মধ্যে যদি সময় কাটানো যায়, তাহলে মনে সেই ইতিবাচক জিনিসগুলি একটি সংস্কার হিসেবে থেকে যাবে, যা নেতিবাচক ভাবনাকে প্রবেশ করতে বাধা দেবে। যে কোনও স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা, অবসাদ এগুলির সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে। কারণ মন ইতিমধ্যেই নেতিবাচক জিনিসগুলির সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা দিয়েছে। 

    • অনেকেই সবসময় মনে করেন, আমার মতো দুঃখী বোধ হয় কেউ নেই। এর থেকেই জন্মায় হতাশা। মানুষ যদি তার থেকে দুঃখী, আর্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, তাহলে যেমন মনের তৃপ্তিও হবে আর অবসাদের অতলে তলিয়ে যাবে না। নিজের দুঃখের থেকেও অন্য কারও কষ্ট যে বেশি তা অনুধাবন করতে পাবে। স্বামীজীর শিবজ্ঞানে জীবসেবার আদর্শ সেই কথাই বলে। জীবনের একটা অন্য অর্থ আসবে। 
    • গীতা আমাদের শিখিয়েছে “কর্মণ্য বাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন।” অর্থাৎ ফলাফলের বিষয়ে চিন্তা না করে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের কথায়, কাঁঠাল ভাঙার সময় যেমন হাতে তেল মেখে নিতে হয়, তাহলেই আর কাঁঠালের আঠাটা হাতে লাগে না, ঠিক তেমন ভাবে কর্ম করার সময় ফলের আশা ত্যাগ করতে হবে। কারণ ফলের প্রতি এই আশা থেকেই কিন্তু আশাহত হওয়ার যন্ত্রণা শুরু। এই আসক্তি ত্যাগের সাধনাই আসল। যা অতটা সহজ নয়। 

মা সারদা বলেছিলেন, জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো, কেউ পর নয় মা, জগত তোমার। সহজ এই বার্তার মাধ্যমেই শ্রী মা সারদা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,  যোগের মর্মার্থ। অর্থাৎ, নির্বাসনার প্রার্থনা । বাসনা না থাকার প্রার্থনা করার কথা বলেছিলেন মা সারদা। যার অর্থ, আমি শুধু আমার সুখ চাইব, এই বাসনাটা বিয়োগ করতে হবে। সারদাদেবী বলেছেন, যখন মানুষ যে কোনও কাজ থেকে আত্মচিন্তাটুকু বাদ দিতে পারবে, জগতের জন্য ভাবতে পারবে, তখনই সাধনা সার্থক হবে।