এই মুহূর্তে যাঁরা ব্রিটেন যেতে চাইছেন, তাঁরা বড় বাধার মুখে পড়েছেন। কারণ ভিসার বিলম্ব। আর এর জেরে শুধু পর্যটকরাই নন, ছাত্র-ছাত্রীরাও পড়েছেন বিড়ম্বনায়। আসলে অতিমারির জেরে টানা দুবছর ঘরবন্দি ছিল মানুষ। ফলে এখন ভ্রমণের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ছে তারা। আর পাল্লা দিয়ে চাপ বাড়ছে সমস্ত ভিসার ক্ষেত্রেই। এমনটাই জানানো হয়েছে।
এই ভিসা বিলম্বের জেরে সমস্যার মুখে পড়েছেন কলকাতার প্রবীণ নাগরিক রাধিকা রায় (নাম পরিবর্তিত)। তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁর পাসপোর্টের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এ বার ইউকের ভিসা পেতে বিলম্ব হওয়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন রাধিকা। তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইউকে যাবেন বলে স্ট্যান্ডার্ড ভিজিটর ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। গত ১৩ মে ইউকে ভিসার পার্টনার আউটসোর্সিং এজেন্সি ভিএফএস গ্লোবালের মাধ্যমে তিনি ওই ভিসার জন্য আবেদন করেছেন।
কিন্তু মেয়ে এবং নাতনিকে দেখতে লন্ডন যাওয়ার পরিকল্পনা আদতেই কতখানি সফল হবে, সেই নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় দিন গুনছেন রাধিকাদেবী। এমনকী ওই এজেন্সির তরফেও কোনও রকম আশ্বাস মিলছে না জন্য আরও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি। রাধিকাদেবীর বক্তব্য, “ওই এজেন্সির তরফে জানানো হয়েছিল যে, আমরা আগামী ২১টি ওয়ার্কিং ডে-র মধ্যে আমাদের ভিসা পেয়ে যাব। কিন্তু এখন দুই মাসেরও বেশি হয়ে সময় পেরিয়ে গিয়েছে এবং আমাদের কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্যই নেই। আমি প্রতিদিন ভিসা ট্র্যাক করছি। যদি কোনও ভাবে বাড়িতে পাসপোর্ট কুরিয়র করা হয়, সেই জন্য বাড়ি থেকেও সেই রকম খুব একটা বেরোচ্ছি না। এছাড়া সমস্যা হল ভিসা না-পাওয়া পর্যন্ত আমি এয়ারলাইন টিকিট বুকিং বা অন্যান্য প্রি-ট্র্যাভেল প্ল্যানিংও তো করতে পারব না।”
রাধিকাদেবী আশা করেছিলেন যে, তিনি সেখানকার গরমের ছুটির পুরো অবকাশটাই নাতনির সঙ্গে কাটাতে পারবেন। তাঁর মেয়েরও ওই সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকার দরুন তিনি মেয়েকে সাহায্য করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এখন ওই প্রবীণ দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন, “এখন আমার কোনও ধারণাই নেই যে, আমি কবে ওখানে যেতে পারব বা আদৌ যাওয়া সম্ভব কি না!”
এই ঘটনা শুধুমাত্র রাধিকাদেবীরই নয়। এই মুহূর্তে ভারতের বহু পর্যটক এবং শিক্ষার্থীরাও এই সমস্যার সম্মুখীন। এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা এই গ্রীষ্মকালীন অবকাশে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে অথবা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চান। আবার সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া শিক্ষার্থীদের ভিড়ও উপচে পড়ে। কিন্তু ভিসা নিয়ে এই দীর্ঘ দিনের বিলম্বে অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে যাত্রীদের ভাগ্য।
যে সব পর্যটক ছুটি কাটাতে যেতে চাইছেন, তাঁদের জন্য খোলা রয়েছে ইউরোপের ফ্রান্স এবং সুইৎজারল্যান্ড। তবে জার্মানি এখনও পর্যন্ত সেই অনুমতি দেয়নি। আবেদন জমা হওয়ার পরেও অনেকটা সময় পার হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র উপযুক্ত কর্মীদের অভাবে। যার ফলে অনেকের গ্রীষ্মকালীন ছুটির মেয়াদকাল পেরিয়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিটিশ হাইকমিশন (British high commission) এবং ইউকে ভিসা এবং ইমিগ্রেশন (UK Visas and Immigration) ভিজিটর ভিসা পাওয়ার জন্য ছয় সপ্তাহের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। তারা জানিয়েছে যে, “বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমস্ত ভিসা রুট জুড়ে অপ্রত্যাশিত ব্যস্ততা এবং চাহিদা আমরা দেখতে পাচ্ছি। স্ট্যান্ডার্ড ভিজিটর ভিসা প্রক্রিয়াকরণ করতে বর্তমানে প্রায় ছয় সপ্তাহ সময় নিতে হচ্ছে। এটি একটি গড়পড়তা প্রসেসিং টাইম। কারণ কিছু আবেদনের ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিষেবার মান ফিরে পাওয়া যায়। আমাদের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পরিষেবা চালু রাখতে।” দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেছেন।
তবে যাঁদের জরুরি কোনও প্রয়োজন রয়েছে, তাঁদের জন্য দ্রুত ট্র্যাকে ভিসা পাওয়ার একটি অন্য পদ্ধতিও রয়েছে। ব্রিটিশ হাই কমিশনের মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা ভারতে অগ্রাধিকার এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে ভিসা সার্ভিস দিয়ে চলেছি। যদিও এই পরিষেবা অন্যান্য অনেক জায়গায় স্থগিত করা হয়েছে। তবে আসন্ন ভ্রমণ পরিকল্পনা রয়েছে, এমন একক ব্যক্তিদের জন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে আমাদের ভিসা পরিষেবা আবেদনকারীদের পাঁচ দিনের মধ্যে তাঁদের ভিসা অনুমোদন করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার মতো অত্যন্ত সহানুভূতিশীল বা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খুব দ্রুত ভিসা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। তবে এই সব ক্ষেত্রে প্রতিটি কেসকে বারবার পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পর্যালোচনা করা হয়।”
যদিও নিয়ম অনুসারে ইউকে স্টুডেন্ট ভিসার সময়সীমা আবেদনের তিন সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু বেশ কিছু আবেদনকারীও ভিসা সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন।
সঞ্জয় কুমার (নাম পরিবর্তিত) মুম্বই নিবাসী এক অভিভাবক। তিনি বর্তমানে তাঁর ছেলের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন। সঞ্জয়বাবুর ছেলে এই বছরেই ওয়ারিক বিজনেস স্কুলে (Warwick Business School) এমবিএ পাঠ্যক্রমে ভর্তি হবে। তবে এখনও পর্যন্ত তার ভিসা বিলম্বের জট কাটেনি। ইতিমধ্যে আবেদনপত্র এবং বায়োমেট্রিক ডেটা জমা দেওয়া সত্ত্বেও এখনও তিনি ভিসা পাননি। সমস্ত ডেটা জমা দেওয়ার ছয় সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেও ভিসা না-আসায় এখন সঙ্কটের মুখে সঞ্জয় কুমার ও তাঁর পুত্র। এই অবস্থায় আদৌ তাঁর এমবিএ পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, সেই নিয়ে অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছে পরিবারে।
সঞ্জয়বাবু জানাচ্ছেন, “আমি উদ্বিগ্ন কারণ ব্রিটিশ হাইকমিশনার ঘোষণা করেছিলেন যে, ভিসা সার্ভিসের প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ করে তোলা হবে এবং প্রক্রিয়াকরণের সময়সীমা কমিয়ে আনা হবে। এই দিকে আমার ছেলের কয়েক জন বন্ধু তিন সপ্তাহের মধ্যে ইউকে-র জন্য তাদের স্টাডি ভিসা পেয়ে গিয়েছে। আমরা এখনও আশা করছি যে, আমার ছেলে আগামী অগাস্ট মাসের মধ্যে তার স্টাডি ভিসা পেয়ে ইউকে-তে পাড়ি দিতে পারবে, যেমনটা আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম।”
ব্রিটিশ হাইকমিশনের মুখপাত্র সুপারিশ করেছেন যে, শিক্ষার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভিসার জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। যাতে পরে কোনও রকম বিলম্ব না-হয়। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, “ইউকে স্টাডি ভিসার জন্য ভারতীয় আবেদনকারীদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই অনেক বেশি। তবে স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন তিন সপ্তাহের সার্ভিস স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে প্রক্রিয়াকরণ করা হচ্ছে।”
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো, শুধুমাত্র ব্রিটেনই নয়, যে কোনও আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রেই যাত্রীদের চরম হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে গত দু’বছর আন্তর্জাতিক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা উঠে যেতেই অসংখ্য মানুষ আবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করছেন। ভিসার বিলম্ব থেকে শুরু করে শেষ মুহূর্তের ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বা ছুটির জন্য প্রি-বুকিং ঝামেলায় একরাশ যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
দেখা যাচ্ছে. অনেক যাত্রীরাই যাঁরা হয়তো সময় মতো ভিসা পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বের কারণে পুনরায় নাকাল হতে হচ্ছে তাঁদের। হোটেল বুকিং বা অন্যান্য পরিকল্পনায় কাটছাঁট করেই শেষমেষ তাঁরা গ্রীষ্মকালীন ছুটি উপভোগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন বিমানবন্দরগুলিতে গ্রীষ্মকালীন এই বিশৃঙ্খলার ছবি এর আগে সাধারণত দেখা যায়নি।
অত্যধিক যাত্রী এবং অপর্যাপ্ত লাগেজ ইত্যাদি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন বিমানবন্দরের কর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিমানবন্দর এবং বিমান সংস্থাগুলিকে কঠোর পদক্ষেপ করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খলা এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ঘোষণা করতে হয়েছে যে, তারা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাত্রী সংখ্যা সীমিত রাখতে যাত্রী চলাচলে রাশ টানতে চলেছে। কর্মীসংখ্যার ঘাটতির কারণে দীর্ঘ লাইন, ফ্লাইট ওয়েটিং, লাগেজ হারানো এবং শেষ মুহূর্তের ফ্লাইট বাতিলের মতো নানান অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।
সে ক্ষেত্রে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে এই পরিস্থিতিতে তাহলে ভ্রমণকারীদের কী করণীয়? এই নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভিসা গ্লোবাল সিওও প্রবুদ্ধ সেন (Prabuddha Sen) জানিয়েছেন, শেষ মুহূর্তের ফ্লাইট বাতিল বা ভিসার সঙ্কট কমাতে সবচেয়ে ভালো হয়, যাতে যাত্রীরা ফ্লাইট বুকিং এবং লজিংয়ের আগে ভিসার জন্য আবেদন করেন। বিশেষ করে এই বছর অত্যধিক চাহিদা এবং তুলনামূলক কম অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লট থাকায়, সমস্যা এড়াতে যত তাড়াতাড়ি আবেদনকারীরা ভিসার জন্য আবেদন করবেন, ততই ভালো।
কিন্তু কতটা আগে আবেদন করলে সমস্যা এড়ানো সম্ভব? বেশির ভাগ দেশ ভ্রমণের তারিখের ৯০ দিন আগে পর্যন্ত ভিসার আবেদন গ্রহণ করে। সংশোধিত শেঙ্গেন ভিসা কোড অনুযায়ী, ট্র্যাভেলের অন্তত ৬ মাস আগে পর্যন্ত পর্যটকরা শেঙ্গেন ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় যাত্রীদেরই। করোনা আবহের পরবর্তী সময় যাত্রী-জট কাটাতে বিভিন্ন ভিসা কর্তৃপক্ষদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আরও বেশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পূর্ব নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা নিলে হয়তো এই সমস্যা এড়ানো যেত।