মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিজের সংগঠন, চক্ষু চিকিৎসক থেকে লাদেন-ঘনিষ্ঠ, শেষ দু’দশকের ত্রাস

মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিজের সংগঠন, চক্ষু চিকিৎসক থেকে লাদেন-ঘনিষ্ঠ, শেষ দু’দশকের ত্রাস

নয়াদিল্লি: ওসামা বিন লাদেনের ( Osama bin Laden) উত্তরাধিকার হিসেবেই দুনিয়া চিনেছিল তাঁকে। কিন্তু ‘আলকায়দা’য় নতুন করে প্রাণ সঞ্চার আর করতে পারেননি তিনি। শেষমেশ আমেরিকার ড্রোন হামলাতেই মৃত্যু হল একদা লাদেনের ডানহাত হিসেবে সন্ত্রাসী কার্য পরিচালনায় লিপ্ত আয়মান আল-জওয়াহিরির (Ayman al-Zawahiri)। ৯/১১ হামলার (9/11 Attacks) অন্যতম অভিযুক্ত জওয়াহিরি আফগানিস্তানের (Afghanistan) কাবুলে ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। ড্রোন হানায় তাঁর মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden)। জওয়াহিরির মৃত্যুতে ৯/১১ হামলায় নিহত ৩ হাজার মানুষের পরিবারের এতদিনের জ্বালা-যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটল বলে মত তাঁর।

৯/১১ হামলার অন্যতম চক্রী জওয়াহিরি নিহত

গত ১৯ জুন-ই ৭১ বছর পূর্ণ করেন জওয়াহিরি। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আমেরিকার সেনার হাতে লাদেনের মৃত্যুর পর থেকে এতদিন তিনিই ‘আলকায়দা’র দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। বিগত ১১ বছর ধরে ‘আলকায়দা’ই পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল জওয়াহিরির। আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল আড়াই কোটি মার্কিন ডলার।

আদতে মিশরের কায়রোর আল মাদি শহরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম জওয়াহিরির। কায়রোর যে এলাকায় তাঁদের বাড়ি, সেখানে মূলত অভিজাত, স্বনামধন্য পরিবার, ইহুদি-খ্রিস্টান-সহ নানা ধর্মের মানুষের বসবাস ছিল। এমনকি একসময় ওই এলাকায় মসজিদের থেকে গির্জার সংখ্যা ছিল বেশি। জওয়াহিরির বাবা, মহম্মদ রাবি আল-জওয়াহিরি ঔষধি সংক্রান্ত বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ঠাকুরদা (মায়ের বাবা) ছিলেন কায়রো ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট।

ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন জওয়াহিরি। কিন্তু কিশোর বয়সে কাকা মাহফুজ আজমের দ্বারা প্রভাবিত হন তিনি। মিশরের ধর্ম নিরপেক্ষ সরকারের ঘোর সমালোচক ছিলেন মাহফুজ। জওয়াহিরিকে প্রভাবিত করেছিলেন সইদ কুতুব নামের মিশরের এক লেখকের বইও, বিংশ শতকে ইসলামি চরমপন্থার জনক বলে পরিচিত সইদ। ১৯৬ সালে সইদকে তৎকালীন মিশর সরকার মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাতেই ১৫ বছরের জওয়াহিরি বন্ধুদের  নিয়ে প্রথম সরকার বিরোধী একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তৎকালীন মিশর সরকারকে উৎখাত করাই লক্ষ্য ছিল ওই সংগঠনের। ক্রমে ক্রমে সেই সংগঠন আকারে বেডে় ‘জামাত আল-জিহাদ’-এ পরিণত হয়।

তবে ইসলামি চরমপন্থায় দীক্ষা নিতে শুরু করলেও, পারিবারিক প্রথা মেনে শিক্ষায় ইতি টানেননি জওয়াহিরি। কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিসিনের ডিগ্রি রয়েছে তাঁর। সেনাবাহিনীতে  চোখের অস্ত্রোপচারেও দীর্ঘদিন হাত পাকান তিনি। এর পর নিজেদের বাড়িতেই ক্লিনিক খুলে বসেন। তৎকালীন সরকার বিরোধী শিবির, সুন্নি ইসলামি ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর হয়েও চিকিৎসা করতেন। এর পর সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে আজা নোয়েরর সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হয় জওয়াহিরির। তাঁদের এক পুত্র এবং পাঁচ কন্যাসন্তান হয়।

‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর হয়ে চিকিৎসা করার সময়ই আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে আনাগোনা শুরু জওয়াহিরির। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তৎকালীন মুজাহিদিন যোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন তিনি। আর সেখানেই সৌদির যুবক লাদেনের সংস্পর্শে আসেন। আটের দশকে মিশরে একাধিক রাজনৈতিক হত্যার পিছনে ছিল জওয়াহিরির সংগঠন। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের খুনেও তাঁর সংগঠনের হাত ছিল বলে শোনা যায়।

সেই সময় গ্রেফতার হন জওয়াহিরি। গ্রেফতার হন তাঁর শতাধিক অনুগামী। প্রায় তিন বছর জেল খাটার পর ছাড়া পান। নিজের আত্মজীবনীতে জেলের ভিতর নৃশংস অত্যাচারের কথা লিখেছিলেন জওয়াহিরি। জেল খেটে বেরনোর পর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায়শই আনাগোনা ছিল জওয়াহিরির। মুজাহিদিন এবং লাদেনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও আরও দৃঢ় হয়।  একসময় লাদেনের ব্য়ক্তিগত চিকিৎসকের দায়িত্বও পান জওয়াহিরি। রক্তচাপের সমস্যা থেকে লাদেনের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা, সবকিছু নিরীক্ষণ করতেন। সোভিয়েত আমলে আফগানিস্তানে চিকিৎসক হিসেবে মুজাহিদিনদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে জওয়াহিরির। লাদেনেরও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।

১৯৯০-এর আশেপাশে একবার আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন জওয়াহিরি। ছদ্মনামে ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন মসজিদে ঘুরে আফগান শরণার্থী এবং ইসলামি যোদ্ধাদের নামে ত্রাণ এবং চাঁদা সংগ্রহ করেন। একই সঙ্গে মিশরেও অস্থিরতা চালিয়ে যেতে থাকে তাঁর সংগঠন। আফগানিস্তানে থাকাকালীনই ১৯৯৭ সালে মিশরে বিদেশি পর্যটকদের উপর হামলার পরিকল্পনা করেন জওয়াহিরি। তাতে ৬২ জন মারা যান, যাঁদের মধ্যে পাঁচ বছরের ব্রিটিশ এক শিশুও শামিল ছিল।

এই হামলার ঘটনায় মিশরের সাধারণ নাগরিকরা জওয়াহিরির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। তাঁর সংগঠনও ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। এর পর ক্রমশ ইজরায়েলের দিকে নজর পড়ে জওয়াহিরির। তাঁর অনুগামীরা শেষমেশ লাদেনের ‘আলকায়দা’য় মিশে যান। সেই সময় লাদেনের উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন জওয়াহিরি। ১৯৯৮ সালে দু’জনে মিলে কেনিয়া এবং তাজানিয়ায় আমেরিকার দূতাবাসে হামলা চালান। এর তিন বছর পর, আফগানিস্তানে বসেই নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে হামলা চালান তাঁরা, যা ৯/১১ হামলা হিসেবেই নথিবদ্ধ ইতিহাসে।

আফগানিস্তানে আমেরিকার জ্রোন হামলায় নিহত জওয়াহিরি

৯/১১ হামলার আগে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন জওয়াহিরি। আমেরিকার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার ভাবনাও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে জানা যায়।  প্রথমে জৈব হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সেই মতো আফগানিস্তানে একটি ল্যাবরেটরিও গড়ে তোলেন। বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে অ্যানথ্র্যাক্স ব্যাকটিরিয়াকে কাজে লাগিয়ে হামলার পরিকল্পনা কষেন। কিন্তু গবেষণায় অনেক সময় চলে যাচ্ছিল বলে শেষমেশ বিমান হামলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৯/১১ হামলার পর আফগানিস্তানে ‘আলকায়দা’র শরিক তালিবানকে ক্ষমতাচ্যূত করে আমেরিকা। ল্যাবরেটরি ফেলে রেখে পালাতে বাধ্য হন জওয়াহিরি। সেই সময় আমেরিকার হামলায় জওয়াহিরি-সহ ‘আলকায়দা’র অন্য নেতাদের বাড়ি, দফতর সব চুরমার হয়ে যায়। ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়েন জওয়াহিরির স্ত্রী। আমেরিকার সেনা তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে গেলেও, হিজাব এবং বোরখা ছাড়া অন্য পুরুষ মুখ দেখে ফেলবে আশঙ্কায়, ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরোতে রাজি হননি তিনি। পরে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়।

আমেরিকার সেনা আপগানিস্তানের দখল নিলে লাদেনের সঙ্গে পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় গা ঢাকা দেন জওয়াহিরি। ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে তাঁর সম্ভাব্য় বাসস্থান লক্ষ্য করে হামলাও চালায় আমেরিকা। কিন্তু জওয়াহিরি অক্ষতই ছিলেন। বরং মাঝেমধ্যেই ভিডিও বার্তায় দেখা যেত তাঁকে। ২০০৭ সালে ইসলামাবাদে লাল মসজিদ হামলার পিছনেও তাঁর ভূমিকা নিয়ে চর্চা রয়েছে। ২০১১ সালে লাদেনের মৃত্যুর পর ‘আলকায়দা’র রাশ জওয়াহিরির হাতেই ওঠে। ‘আলকায়দা’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জীবিতকালে সেই লক্ষ্যে আর পৌঁছনো হয়নি তাঁর।