‘মিস হাওয়া হাওয়াই’ থেকে ‘ মম’, অভিনয়ের খোলনলচে পাল্টে ফেলার নাম শ্রীদেবী…জন্মদিনে ফিরে দেখা

‘মিস হাওয়া হাওয়াই’ থেকে ‘ মম’, অভিনয়ের খোলনলচে পাল্টে ফেলার নাম শ্রীদেবী…জন্মদিনে ফিরে দেখা

পায়েল মজুমদার, কলকাতা: দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে কী করে পাঁচ বছরের বাচ্চাটা? বাড়ির লোকজনের কৌতূহলের শেষ নেই। একদিন জানলার ফাঁক দিয়ে তাঁরা দেখলেন, রংচঙে জামা পরে আয়নার সামনে নাচছে খুদে। সঙ্গে আপন মনে গান ‘বিজলি গিরানে ম্যাঁয় হু আয়ি…কেহতে মুঝকো হাওয়া হাওয়াই।’ কিন্তু ‘মিস হাওয়া-হাওয়াই’-এর অনন্য ‘স্টাইল’ কি নকল করা সম্ভব? পাঁচ বছরের মেয়েটা চেষ্টা করেই যাচ্ছে। ‘স্টারডম’ নাকি ‘গ্ল্যামার’? কী এমন ছিল শ্রীদেবীর (Sri Devi) যা নাছোড় করে তুলেছিল শিশুকে?

তবে ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া শেখর কপূর পরিচালিত ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ (Mr. India ) ছবির আগেই বলিউডে অত্যন্ত বিখ্যাত শ্রীদেবী। ‘ভারতের প্রথম মহিলা সুপারস্টার’, এমন শিরোপাও তাঁর নামের প্রথমে ব্যবহৃত তখন। শ্রীদেবী নিজে কি সত্যিই এই শিরোপায় বিশ্বাস করতেন ?  পর্দার আড়ালে অত্যন্ত স্বল্পভাষী, ধীর-স্থির মানুষটিকে দেখে উত্তরটা চট করে বোঝার উপায় ছিল না। তবে পরিসংখ্যান সাফল্যের মাপকাঠি হলে, অবশ্যই সমসাময়িক বহু নায়িকার থেকে এগিয়ে ছিলেন জন্মসূত্রে তামিল শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গার আয়াপ্পান ওরফে শ্রীদেবী।

ছোটবেলা…
১৯৬৩ সালের ১৩ অগাস্ট (Sri Devi Birthday)। তামিলনাড়ুর শিবকাশীতে, আয়াপ্পান এবং রাজেশ্বরীর পরিবারে আসে এক কন্যাসন্তান। নাম আয়াপ্পান পেশায় উকিল। অন্য দিকে, রাজেশ্বরী আদতে অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতির বাসিন্দা। বাড়িতে তাই তামিল-তেলুগু দুটো ভাষাই চলে। ছোটবেলা থেকে তাই দুটি ভাষাতেই সড়গড় হয়ে ওঠে আয়াপ্পান-রাজেশ্বরীর মেয়ে  শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গার আয়াপ্পান। মা-বাবা কি তখনও টের পেয়েছিলেন যে এই মেয়ে একদিন ভাষার বাধা ভেঙে হিন্দি বিনোদন দুনিয়ার অবিসংবাদিত নায়িকা হয়ে উঠবে? হয়তো নয়। তবে রুপোলি পর্দায় যে সে সড়গড়, সেটা বোঝা গিয়েছিল চার বছর বয়সেই।  ‘Kandhan Karunai’ নামে তেলুগু ছবিতে অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় শ্রী আম্মার। সালটা ১৯৬৭।
তবে শ্রীদেবী নামটার সঙ্গে আসমুদ্রহিমাচলের পরিচয় হতে তখনও কিছুটা বাকি। চার বছরের বাচ্চাটা অবশ্য থেমে থাকেনি। গুটি গুটি পায়ে অভিনয় করে গিয়েছে। তবে বিনোদন দুনিয়ায় তাজা হাওয়ার মতো তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭৬ সালে। কে বালাচন্দেরের  ‘Moondru Mudichu’ ছবিতে কমল হাসন এবং রজনীকান্তের সঙ্গে একযোগে অভিনয় করলেন ১৩ বছরের কিশোরী। চমকে উঠল দক্ষিণী চলচ্চিত্র জগৎ। নতুন তারকার অভিষেক?

রুপোলি পর্দার আলো-আঁধারি…
সেই শুরু। ইতিহাস গড়ার। ছবির-পরিসংখ্যান নিয়ে যাঁদের নিত্য ওঠাবসা, তাঁরা আজও ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যান যে রজনীকান্ত এবং কমল হাসনের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে আলাদা করে ২০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন এমন নায়িকা শ্রীদেবী ছাড়া আর ক’জন? কিন্তু মারকাটারি সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতার হোঁচটও আসে, সেটা ভুললে চলবে না। তামিল, তেলুগু, মালায়ালম ছবির দুনিয়ার নক্ষত্র শ্রীদেবীর প্রথম হিন্দি ছবি ‘সোলওয়া সাওয়ান’বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেটা ১৯৭৮ সাল।
এখান থেকে গল্পটা অন্যরকম হয়ে যেতে পারত। কিন্ত যিনি পাঁচ বছরের শিশুকেও মুগ্ধ করতে পারেন, তাঁর যাত্রাপথ একটু অন্যরকম হবেই। পরের হিন্দি ছবি ‘হিম্মতওয়ালা’ দুরন্ত হিট। এবার বিস্মিত হওয়ার পালা বলিউডের। ‘মাওয়ালি’, ‘তোহফা’, ‘নয়া কদম’, ‘মাস্টারজি’, ‘মকসদ’, ‘নজরানা’ থেকে শুরু করে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’, ‘চাঁদনি’। ৮০-৯০ দশক জুড়ে একের পর এক হিট। শুধু বাণিজ্যিক সাফল্য নয়, ‘সদমা'(১৯৮৩), ‘চালবাজ’ (১৯৮৯), ‘লমহে’ (১৯৯১), ‘লাডলা (১৯৯৪)’ ইত্যাদি ছবির সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছেন ঝুলি ভরে। তবে সবটাই কি এত মসৃণ সুন্দর ছিল?

বলিউডের ‘রূপ কি রানি’…
শ্রীদেবীর অনুরাগী যে শুধু সাধারণ দর্শকরাই ছিলেন, তা নয়। তাঁর গ্ল্যামারে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রযোজক বনি কপূর। তবে মুগ্ধতা কখন আবেগের রূপ নেয়, সেটা হয়তো আলাদা করে খেয়াল করেননি ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবির প্রযোজক। শুধু মনে আছে প্রথম সাক্ষাতের কথা। কাজের কথাই বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীদেবীকে দেখে মনে হয়েছিল, ‘স্বপ্ন বাস্তবের রূপ নিয়ে সামনে চলে এসেছে।’ যদিও বনি কপূর তখন বিবাহিত, সন্তানও রয়েছে।
‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় থেকেই শ্রীদেবীর ব্যাপারে ধীরে ধীরে আরও ‘সিরিয়াস’ হতে থাকেন বনি। প্রাক্তন স্ত্রী, মোনাকে, একদিন সব কথা খুলেও বলেন। তাতে যা হয়েছিল,সেটা ইতিবাচক নয়। কিন্তু বনির সবটা জুড়ে তখন শ্রীদেবী। এমনকি ‘চাঁদনি’-এর শ্যুটিংয়ে অভিনেত্রী যখন সুইজারল্যান্ডে, তখনও তাঁর পিছু নিয়েছিলেন প্রযোজক, পরে নিজেই সে কথা ফাঁস করেন। স্বল্পভাষী অভিনেত্রীকে বোধহয় তখনও বুঝতে কিছুটা  বাকি ছিল তাঁর। প্রেমের প্রস্তাব দিতেই ভয়ঙ্কর রেগে যান শ্রীদেবী। ছ-আট মাস কথা বলেননি। ১৯৯৩ সালের মুম্বইয়ে  ‘সিরিয়াল ব্লাস্ট ‘-এর পর ছবিটা বদলাতে থাকে। বাণিজ্যনগরীর হোটেলে একা নায়িকাকে থাকতে দিতে চাননি বনি। বাড়িতে নিয়ে আসেন। ১৯৯৫ সালে নায়িকার মা যখন অসুস্থ, তখনও শ্রীদেবীর পাশে প্রতি মুহূর্তে ছিলেন তিনি। এই সময়টাতেই ধীরে ধীরে কাছে আসেন বনি-শ্রীদেবী। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে নিরিবিলিতে বিয়ে করেন যা প্রকাশ্যে আসে ১৯৯৭ সালে। তার পর থেকে তীব্র বিরূপ মন্তব্য সহ্য করতে হয়েছে দুজনকেই।
কিন্তু আত্মমর্যাদা নষ্ট করে, প্রকাশ্যে কখনও এমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি পর্দার ‘মিস হাওয়া হাওয়াই’। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, হিন্দি উচ্চারণ নিয়েও বরাবর সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাঁকে। কখনও আবার বিনোদন ম্যাগাজিনের ‘হট টপিক’ হয়েছে তাঁর সঙ্গে জয়া প্রদা, মাধুরী দীক্ষিতের প্রতিযোগিতা এবং  টানাপড়েনের মুচমুচে খবর। তার কতটা সত্যি-কতটা মিথ্যা, তা আজও আলো-আঁধারির মাঝামাঝি কোনও জায়গায় রয়ে গিয়েছে। তবে ‘রূপ কি রানি চোরো কা রাজা’-এর পর থেকে শ্রীদেবী যে একপ্রকার স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান, সেটা স্পষ্ট।

দ্বিতীয় ইনিংস…
ছবির দ্বিতীয়ার্ধ যে তখনও বাকি, কে ভেবেছিল? দীর্ঘ ১৫ বছর পর ‘ইংলিশ ভিংলিশ'(২০১২) ছবিতে ‘কামব্যাক’ করেন নায়িকা। তত দিনে অবশ্য তিনি দুই কন্যার মা। গুছিয়ে সংসারও করছেন বনি কপূরের সঙ্গে। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় ‘মম’। প্রাণচঞ্চল, গ্ল্যামারাস নায়িকার ভোল পাল্টে, অভিনয়ের ধারা আমূল বদলে তুমুল প্রশংসা পান শ্রীদেবী। এদেশ তো বটেই, পাকিস্তান থেকেও ইতিবাচক সাড়া আসে। ‘মম’ছবিতে শ্রীদেবীর মেয়ের ছবিতে অভিনয় করেছিলেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী সজল আলি। পর্দার বাইরে, বাস্তব দুনিয়ায় দু’জনের মধ্যে সত্যিই এক অদ্ভুত সংযোগ গড়ে ওঠে। পরে সজল জানিয়েছিলেন, শুটিং করাকালীনই তাঁর মা-র ক্যানসারের কথা জানতে পারেন। কঠিন সেই মুহূর্তে ভরসার হাত ধরে থেকেছিলেন তাঁর অনস্ক্রিন ‘মম’, সজলের ‘শ্রী ম্যাম’।
ব্যক্তিগত জীবনেও মেয়েদের নিজ হাতে যত্ন করতেন বলে ঘনিষ্ঠমহলের খবর। তাঁর বড় মেয়ে, জাহ্নবী, সে কথা বলতে গেলে আজও বিহ্বল হয়ে পড়েন।

কী এমন ছিল তাঁর? বিশ্লেষণ করা কঠিন। ঠিক যেমন ভাবে,২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর আচমকা চলে যাওয়াও রহস্যের পরতে ঘেরা। তবে জীবন হোক বা মৃ়ত্যু, শ্রীদেবী মানে একটিই গান। ‘বিজলি গিরানে ম্যাঁয় হু আয়ি…কেহতে মুঝকো হাওয়া হাওয়াই।’

(Feed Source: abplive.com)