অনুষ্টুপ রায় বর্মণ
মনে করো সাততলা বাড়িটার
একতলা হাতি আর ইঁদুরের
দোতালায় বুড়ো থাকে রিটায়ার্ড
লাল নীল উল বোনে বুড়ি তার…
এই লেখার মূল বিষয় যদিও এই গান নয়। আসলে আমিও আজ আপনাদেরকে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির গল্প শোনাব। শুনে হয়ত আপনাদের অনেকেরই এই গানটার কথা মাথায় আসতো, তাই গানটা দিয়েই শুরু করলাম।
এটা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ি। এখানকার বাসিন্দারা আদর করে এই বাড়ির নাম রেখেছেন সমাজ। এর প্রতিটি তলায় অদ্ভুত প্রাণীরা বাস করে। এরা দেখতে শুনতে মানুষের মতোই, কিন্তু আসলে মানুষ কিনা তার বিচার তো আপনিই করবেন।
এই বাড়ির সবথেকে নিচের তলায় থাকেন কিছু মানুষ। যাদের ময়লা শরীর, শতছিন্ন পোশাক। এরা দিন আনে দিন খায়। পৃথিবীর জমা-খরচ এদের কোনও হিসাবে আসেনা। আর পৃথিবীর অ্যাকাউন্টে এরা মিসলেনিয়াস এক্সপেন্সে আসে। মানে আপনি যদি অ্যাকাউন্টেন্সির শিক্ষার্থী হন তাহলে বুঝবেন এই মিসলেনিয়াস কতটা জরুরি। যখনই হিসাব মেলাতে পারি না তখনি এর ঘাড়ে চাপাই আমরা সব। ঠিক তেমনি পৃথিবী যখন দোষের হিসাব মেলাতে পারেনা তখন অতিরিক্ত সব দোষ সহজেই চাপিয়ে দেয় এদের ঘাড়ে। এরা পৃথিবীতে আসে, খেতে পাক অথবা না পাক এরা খেটে চলে মুখে রক্ত তুলে, তারপর একদিন মরে যায় চুপচাপ সবার অজান্তে।
এদের উপরের তলা, মানে আমাদের ভাষায় ফার্স্ট ফ্লোর। এই তলাটি দুই ভাগে ভাগ করা। সেখানে থাকেন এক বিচিত্র প্রকারের প্রাণীরা। এদেরকে বলা হয় মধ্যবিত্ত। বড় অদ্ভুত এই প্রাণীরা। নিজেদেরকে এরা মনে করেন বিশাল বড় কিছু। এরা মূলত সরকারি চাকরি করেন, আর ইতিহাস আউরে বেঁচে থাকেন। মুখে এনারা দুনিয়া কিনে ফেলতে পারেন। পেলে থেকে মারাদোনা সবাইকে এনারা খেলা শিখিয়েছেন। অমর্ত্য সেন রোজ আসেন এদের কাছে অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব বুঝতে। এনারা রোজ নিজেরদের চায়ের কাপে ঝড় তুলে ফেলেন এটা বলে যে সবাই একটি অপদার্থ। এই পৃথিবীর ভার সব অকর্মাদের হাতে রয়েছে। আবার পরেরদিন সকালে উঠে এরাই ঘাড় গুঁজে সেই অকর্মাদের দেওয়া কাজ করতে টেবিলে বসে পড়েন। প্রতিবাদ বস্তুটা আজকের যুগে কতটা কাল্পনিক সেটা এদের দেখলে বোঝা যায়।
আবার এই তলার অন্য যে ভাগ, সেখানে থাকেন আরেক প্রকার মধ্যবিত্ত। এদের কাছে সরকারি চাকরি নেই। এরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় ছোটো পদে কাজ করেন। এদের কাছে সময় নেই বিশ্বসংসারের দিকে তাকানোর মতো। এরা কোনও মতে বেশি কাজ কম টাকায় করে, সংসার চালিয়ে সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে ভবিষ্যতের জোগাড় করেন। এদের জীবনে, সরকার থাকা না থাকার কোনও প্রভাব আছে বলে এরা মনে করেন না। এদের মতে যারাই সরকারে থাকবে তারাই আমাদের মারবে অতএব এইসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করা কারোর উচিত নয়।
তিনতলাটা খালি ছিল কিছুদিন আগে অবধি। সম্প্রতি এক নতুন ধরনের প্রাণী এখানে এসেছেন বাস করতে। এদের সকলেরই অল্প বয়স। এরা আগে ওই ফার্স্ট ফ্লোরে থাকত। এখন এই তিনতলায় এসেছে। এরা সবাই মূলত ইঞ্জিনিয়ার। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি কলেজ থেকে এরা বিভিন্ন বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এবং সব থেকে মজার বিষয় হোল যদিও এদের সবার পড়ার বিষয় ভিন্ন ছিল কিন্তু কাজ এরা করে সবাই একই, অর্থাৎ কোডিং (মূলত)। তার মধ্যে বিভিন্ন ভাগ আছে। যাই হোক। এরা মনে করে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য কিছু পড়া মানে সময় নষ্ট করা। এদের জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই রায় ও মারটিন, ছাত্রবন্ধু, অরগানাইজার সহ অন্যান্য সহায়ক পাঠ্য (যাতে করে কম পড়ে বেশি নম্বর পাওয়া যায়) পরেই কেটে গেছে।
এদের জীবনের আরেকটি প্রধান অংশ হলো অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদেরকে হেয় করা। জীবনে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশুনা না করলে আসলে তুমি জীবনে কিছুই করতে পারলে না এমন একটি ধারনা তাদের চিরকালীন। এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই বিজ্ঞান পড়ুয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই হাতের দশ আঙ্গুলে প্রায় পনেরোটি আংটি এবং অসংখ্য তাবিজ-কবচ-মাদুলিতে ভরসা করে পরীক্ষার খাতা জমা দিয়েছে। যদিও এমন ধরনের ভাবনা তাঁদের মধ্যে আসার আরেকটি কারণ হলো তাঁদের বাবা মায়ের ভাবনা চিন্তা। এর ফলেই এই ছেলে-মেয়েরা সারাজীবন একটি ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে বড় হয়েছে। যেখানে অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই স্বর্গ-সুখ খুঁজে পেয়েছে তারা।
এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হোল রাজনীতির থেকে শতহস্ত দুরে থাকা। রাজনীতিই যে আসলে তাঁদের জীবন নির্ধারণ করছে, তাঁদের চাকরি থাকবে নাকি থাকবে না সেটাও যে বহুলাংশে রাজনৈতিক পলিসির উপর নির্ভর করে সেটা তারা বুঝেও বোঝে না। তাঁদের জীবনে অফিস, প্রমোশন, পার্টি, অনসাইট এরই মধ্যে আবর্তিত হতে হতে একদিন শেষ হয়ে যায়। একটু ভেবে বলুন তো ওই একদম নিচেরতলার বাসিন্দাদের জীবনের সাথে এই তিনতলার বাসিন্দাদের জীবনের ঠিক কতটা পার্থক্য, চাকচিক্য ছাড়া?
এই বাড়িতে একটা সাড়ে তিনতলা আছে। সেখানে থাকে এক ধরনের অতিবিজ্ঞ প্রাণী। এরা মনে করে এরা এত শিক্ষিত যে এদের মাথার পিছন দিয়ে আলো বেরোয়। এরা জীবনের মানে বুঝে গেছে বাইশ-তেইশ বছর বয়সের মধ্যে এবং তাদের জীবনের বোধিলাভ সম্পূর্ণ। এরা প্রতিবাদ করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানে। এরা রাজনীতি করে। এরা বোঝে যে রাজনীতি তাঁদের জীবন নির্ধারণ করে সেই রাজনীতিকে নির্ধারণ করাটা তাদের কর্তব্য।
এতটা পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন যে এরা হয়ত এই বাড়ির শ্রেষ্ঠ বাসিন্দা? আমি দুঃখিত আপনারা ভুল ভাবছেন। এই বিজ্ঞ প্রাণীরা বড়ই বিচিত্র। এরা সবই করে, কিন্তু ভুলে যায় যে আদর্শ জীবন অথবা প্রতিবাদের আদর্শ ধরন বলে কিছুই হয়না। এরা জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনা। মানে ধরুন এরা মনে করে যে এই বাড়ির অন্য বাসিন্দা যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে তারা যেমন অন্যদেরকে হেয় করে সেটা ঠিক নয়। আবার উল্টোদিকে তারাই এটা ভাবে যে আমরা অন্যদের তুলনায় এই পৃথিবীকে অনেক বেশি জানি-বুঝি। পৃথিবীর সমস্যা নিয়ে আমরা অন্যদের থেকে বেশি ভাবিত।
মানে এদের মধ্যে একটা অদ্ভুত সুপ্ত সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স বাস করে। কিন্তু এদের তাত্ত্বিক শিক্ষার গুনে সেই জিনিসটাকে এরা অসাধারণভাবে ঢেকে রাখতে সক্ষম। এরা বলে যে সরকার খারাপ, যারা রাজনীতি করছে তারা খারাপ, কিন্তু মজার বিষয় এরা সেই খারাপের বিকল্প দিতে অপারগ। এদের সঙ্গে আপনি কি ফার্স্ট ফ্লোরের বাসিন্দাদের কোনও অমিল দেখতে পান, তাত্ত্বিক যুক্তির ব্যাকআপ ছাড়া?
এরপর আসা যাক চারতলার কথায়। এখানে যারা বাস করেন তারা এই গোটা বাড়িটার পরিচালনার ভার নিয়ে রেখেছেন। স্বভাবতই আপনার মনে হবে যে এই পরিচালন সমিতিতে বাড়ির সব তলার মানুষ রয়েছেন। আসলে না! এখানে যারা থাকেন তারা শুধু এই ফ্লোরেই থাকেন। হয়ত কোনও সময়ে এদের কেউ নিচের ফ্লোরে ছিলেন কিন্তু তারা সেখানকার সম্পর্কে কোনও খবর রাখার প্রয়োজন মনে করেননা। এঁরা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যাস্ত। নিজেরটা গুছিয়ে নিতে পারলে, বাকি দুনিয়া না খেতে পেয়ে মরলেও তাঁদের খুব একটা যায় আসেনা।
এদের কাছে আছে দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এই গোটা বাড়িটাকে ভালো রাখার, এখানকার বাসিন্দাদের রোজকার সমস্যার সমাধান করার, তাঁদের জীবনযাত্রাকে আরও সুস্থ-সুন্দর করে তলার ক্ষমতা এদের কাছেই আছে এবং যদিও এটা তাঁদের দায়িত্বও হওয়া উচিত, কিন্তু সুকৌশলে প্রতিবারই এরা বাসিন্দাদেরকে বুঝিয়ে দেন যে ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকলেও দায়িত্বটা আসলে বাসিন্দাদের নিজেদের। ঘুরিয়ে বিষয়টা দাঁড়ায় এরকম যে চারতলার বাসিন্দাদের দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর বাকি সকলের ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। দায়িত্ব নিজেদেরকে ভালো রাখার, সমাজের মঙ্গল করার, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর চারতলার বাবুদের কাজ খালি লুটে খাওয়া। এদের সঙ্গে আপনি কারুর মিল পাবেননা। কারণ এনারা এক এবং অদ্বিতীয়।
সাততলা কারোও নয়, কারোও নয়
মেঘ থাকে নীল আকাশ লাল ফুল
তারাদের দুপুরের ভাত ঘুম
সেখানে খোকন সোনা মামনি
চাঁদ ধরে সূর্যের সাথি হয়।
(Feed Source: zeenews.com)